ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আটপৌরে দিবসের ছায়া

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ২০ নভেম্বর ২০১৫

আটপৌরে দিবসের ছায়া

কবিতার একটা আলাদা রূপ, আলাদা অভিব্যক্তি আছে। এই রূপ আর অভিব্যক্তির ভিতর দিয়ে যে ইটের সোলিং জ্বলা লাল রাস্তাটি চলে গেছে সাহিত্যের প্রধান হাইওয়েতে- সেখানে কবিতারই এক উজ্জ্বল স্টোনে যুগ যুগান্তের কবিতার শিল্পময় আলোকপুঞ্জ ঝিলিক দিয়ে ওঠে থেকে থেকে। কবিতার বয়স কতো? এক হাজার দুই হাজার কিংবা তারও বেশি। বয়স যেটুকুই হোক- কবিতা যে সময়ের কালস্রোতকে ধারণ ও লালন করে এবং তার ছিপ-নৌকাটি চালিয়ে যায় -তার বর্ণোজ্জ্বল স্বাক্ষরটি রেখে চলেন হালের তরুণতম একজন কবি। পৃথিবীর অজস্র ভাষাভাষী কবিদের এই তরুণ প্রজন্ম তাদের দৃষ্টিসীমার ছবিগুলোকে স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্য আর অভিজ্ঞতার রঙে কবিতার ধূসর ক্যানভাসে এঁকে চলেছেন অনুপম নৈপুণ্য আর মহিমার তুলিতে। কখনো মূর্ত, কখনো বিমূর্ত ফর্মেটে আঁকা সেই কবিতার মুখটুকু সবার জন্যই থাকে গ্যালারির দেয়ালে টানানো নানা ফ্রেমে। আর তখনই প্রেমে পড়ে যায় কবিতার বোদ্ধা পাঠক। তার সজল চোখের অপাঙ্গে তখন কবিতার তারাগুলো ঝলমল করে ওঠে। ফোটে গন্ধরাজ ফুলের মতো শাদা ভোর। আর ওই শুভ্রতা-ভেজা ভোরের সিঁড়িতে এসে দাঁড়ায় নব্বই দশকের প্রতিভাময়ী কবি রুনু আঞ্জুমান। তার গলায় জড়ানো সিল্কি স্কার্ফের প্রান্তগুলো কবিতার অক্ষর, শব্দে, পঙক্তিতে থাকে মাখামাখি। তার চোখের রোদচশমার কাচে উদ্ভাসিত হয় কবিতারই এক ধুলাডোবা মাঠ। আর ওই মাঠের ভিতর ফুটে ওঠে কবিতার এক ঝাউফুল ফোটা নিউটাউন। দূরে, অনেক দূরের এক রেললাইন ধরে তখন কি ছুটে যায় রুনু’র কবিতার চিত্রকল্প বোঝাই আবছা স্টিম ইঞ্জিনের আন্তঃনগর ট্রেন। আর ওই ট্রেনের নিঃসঙ্গ ব্যুফে কারের শার্সিতে কি জেগে ওঠে দূরপাল্লার বন- অরণ্যের আবছা বিরতিটানা সবুজ সিনারি। রুনু আঞ্জুমানের কবিতার মর্মে যে মেঘলা আকাশ আছে ফুটে সে আকাশেও কি উড়ে উড়ে জীবনানন্দের চিলগুলো আজও কাঁদে। ধানসিঁড়ি নদীর রুপালি ফুলকায় জেগে ওঠে হেমন্তে আর শীতে হিমজ্বলা শিশির- কুয়াশা? রুনু’র কবিতায়ও আছে পাখি, প্রকৃতি, প্রেম, বেদনাবোধ, নৈঃসঙ্গ, নির্জনতার আকণ্ঠ উৎসারণ। ‘কুয়াশা ঠোঁটে সেই গ্রাম’ কবিতায় কি সেই আর্তিই ঝলসে উঠেছে! ‘ শীতের সকাল হাসে কুয়াশার ঠোঁটে পিঠার ঘ্রাণের সাথে মন ভরে ওঠে পুকুর জলের স্রোত ছুটে নিয়ে যায় মাঠের প্রান্তরে বোসে আহা কেউ গায় বাঁশের পাতার বুকে সুর দোলা দেয় বাতাস কোমর দুলে পথ চিনে নেয় ’। এক্কেবারে নির্মল আস্বাদ কি এই কবিতার পল্অনুপলে মন্দ্রিত হয়ে ওঠেনি! গীতিময়তার যে আভা রুনু উদ্ধৃত কবিতার অবসরে ছড়িয়ে দিয়েছেন সেটাকে তো দূরে ঠেলে দেয়ারও কোনো অবকাশ নেই। ‘নীলগিরি’ কবিতার টিলে পথে যেতে যেতে শুনতে কি পাওয়া যাবে না সেই ছোট্ট হিল স্টেশনের টিকেট ঘরের টালির ছাদে অবিশ্রাম ঝরে পড়া বৃষ্টির ঐক্যতান। শুনুন ওই সুর মূর্ছনা- ‘ হেমন্ত সকাল যেন যৌবনের গান আবছা কুয়াশা খেলে নীলগিরি প্রাণ জানালা বাতাসে দেখি পাহাড়িকা মন ভেসে চলে- চলে ভেসে জীবনের ক্ষণ রমণী চুলের ঢেউ চিম্বুকের বুকে লাইসি থান্চি পথ বয়ে যায় সুখে হেমন্ত রাতের আলো তারা হয়ে হাসে পাতার মিছিলে দেখি জোনাকিরা ভাসে। ’ নিসর্গ আর পর্যটনের এক আটপৌরে চিত্রাবলি রুনু তার কবিতার কার্নিশে জমিয়ে তোলেন দিনান্তে তা আঁজলায় তুলে নেবেন এই প্রত্যাশায়। কতো সাবলীল, ছন্দমধুর রিদমিক পঙ্ক্তিগুচ্ছের সন্নিবেশ তার কাব্য চিন্তার রেলিঙে রুমালের মতো দুলছে। তা যেন আরো বাক্সময় হয়ে যায় রুনু আঞ্জুমানের বিশুদ্ধ কাব্যময় হাতের ছোঁয়ায়। বিশেষত, প্রাকৃতিক উপাদান রুনু’র কবিতার এক প্রধান অঞ্চল। যে অঞ্চলে জ্যোৎস্নার ভেলভেট্ বিছানো লনে নেমে আসে রূপকথার রাজকন্যা আর তার চারপাশে জড়ির পোশাক পরা পরী। তখন কি ওই পরীরা রাজকন্যাকে ঘিরে ছো’- নৃত্য নাচে? নাচে রুনু’র কবিতায় নীলাম্বর পালক ছড়িয়ে ময়ূরের মতো পরীরাও! নাচে ‘শরতের ভেজা পাখি’ মেঘের বেদনা কালো চোখে- ‘শরতের ভেজা পাখি মেঘের বেদনা কালো চোখে কখনো সফল রোদে সূর্য¯œাতা উষ্ণতা আদরে আবার কখনো যেন চোখের পলকে কাশফুলে ছুঁয়ে যায় চুম্বনে চুম্বনে শরত আকাশ শুধু রং বদলায় ’ শরত, হেমন্ত, শীত এই তিন ‘ঋত’ুর উপস্থিতি যেমন গভীর ব্যঞ্জনায় রুনু’র কবিতার কোথাও না কোথাও ঝিলিক দিয়ে ওঠে। তেমনি কবিতাগুলোও যেন কখনো শরতের মতো মেঘলা, হেমন্তের মতো উজ্জ্বল আবার শীতের মতো ঝাপসা মনে হয়। মনে হয় যেন মেঘ শিরিষের চূড়ায় বসে ঝিরঝিরি বাতাস- সেতারে কবিতার পঙ্ক্তিগুলো বেজে চলেছে আপনা থেকেই। কোথাও কেউ নেই। চারদিক সুনসান, স্তব্ধ। আর এই স্তব্ধতা ডোবা সেগুন সড়ক ধরেই ছুটে যাচ্ছে রুনু’র কবিতার রোল্স রয়েল্স। রুনু’র কবিতা এমনই সারি সারি দেবদারু’র মর্মরিত ছায়ার কিনারে এসে দাঁড়ায় এবং কোনো কোনো দিন ঘাটে ফিরে আসে তার কবিতার ছই নৌকো। আর রুনু’র কবিতার রানওয়েতে যখন ধুম বৃষ্টি নামে তখন তার কবিতার ককপিটে একপশ্লা শালিকের টুটাফাটা ছায়ার শবনম যায় ঝরে। পোর্টিকোতে জমে থাকা রোদে ভেসে ওঠে দূর বাল্যস্মৃতির অমোঘ স্মারকগাঁথা। আর ওই অমোঘ স্মারকগাঁথার প্রতিটি পরতে ছলকে ওঠে পাহাড়ি ঝর্ণার জলতরঙ্গের মতো একেকটি স্বর্ণোজ্জ্বল অটোগ্রাফ। রুনু’র কবিতার প্যাটার্ন, ম্যানারিজম, এতোটাই সহজ- সরল যে সাধারণ পাঠকও সেটা অনায়াসে পাঠ করে ভীষণ আনন্দিত হবেন। আর এভাবেই রুনু আঞ্জুমান কবিতার ভিতর দিয়ে যেতে যেতে নিজের কবিতার গুরুত্বটুকু ভীষণ পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। সুন্দর উপমা, চিত্রকল্প, শব্দচয়ন, অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে আধুনিক ইউটিলাইজেশনের মধ্য দিয়ে রুনু’র কবিতা হয়ে উঠেছে এক একটি স্বকীয় পাখির ডানা।
×