ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উগ্রবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী উচ্চারণ;###;শব্দের শক্তি দিয়ে দুনিয়াটাকে বদলে দেয়ার ডাক;###;বাংলা একাডেমিতে ১৪ দেশের ২৫০ লেখক-সাহিত্যিকের মিলনমেলা

ঢাকা লিট ফেস্ট

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২০ নভেম্বর ২০১৫

ঢাকা লিট ফেস্ট

মনোয়ার হোসেন ॥ সাহিত্য মানেই নিছক বিনোদন কিংবা মনের খোরাক মেটানোর উপাদান নয়। ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি নিয়েই এগিয়ে যায় সাহিত্যের গতিধারা। সেই বাস্তবতায় বিশ্বব্যাপী গজিয়ে ওঠা উগ্রবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী উচ্চারণে শুরু হলো ঢাকা লিট ফেস্ট। আন্তর্জাতিক এই সাহিত্য উৎসবের আয়োজকসহ অতিথি লেখকদের কণ্ঠেও উচ্চারিত হলো সেই কথা। তাঁরা বললেন, এই আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শব্দের শক্তি দিয়ে পৃথিবীকে বদলে দেয়া এবং লেখক-পাঠক ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে উপলব্ধি করা ও সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। আর সেই ভাষার শক্তি দিয়েই প্রতিবাদ করা হবে উগ্রবাদ ও মৌলবাদের। বৃহস্পতিবার থেকে বাংলা একাডেমি আঙিনায় শুরু হলো তিন দিনের ঢাকা লিট ফেস্ট। উৎসবের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘সারা বিশ্ব বাংলাদেশকে সাহিত্যসমৃদ্ধ জাতি হিসেবে চিনুক।’ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ১৪টি দেশের ২৫০ জন লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ ও প্রকাশক অংশ নিচ্ছে এই উৎসবে। এর মধ্যে রয়েছেন ১৪ দেশের ৬০ জন আমন্ত্রিত সাহিত্যিক। উৎসবে অংশ নিয়ে লেখক সাহিত্যিকরা বললেন, দেশে দেশে অস্থিরতা, জঙ্গীবাদের উত্থান, বাকস্বাধীনতা আক্রান্তÑএসব বাধা মোকাবেলা করেই মুক্তিচিন্তার ধারকদের সামনে এগিয়ে যেতে হয়। যুগে যুগে কালে কালে লেখকদের এই বাধা অতিক্রম করেই সত্য ও সুন্দরের কথা বলে যেতে হয়েছে। লেখকরা নানা দেশের হলেও তাদের লক্ষ্য এক আর হচ্ছে মানুষের মুক্তি। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বাংলা একাডেমির সবুজ আঙিনা মুখর হয়ে ওঠে লেখক-পাঠক ও প্রকাশকদের আনাগোনায়। নানা দেশ থেকে এসেছেন লেখকরা। বাংলাদেশের লেখকদের সঙ্গে পাঠকদের নানা আলোচনায়, উৎসবের বিভিন্ন নির্ধারিত বক্তৃতায় অংশ নিচ্ছেন। মূল আনুষ্ঠানিকতার আগেই উৎসবকে রাঙিয়ে তুলেছিলেন গানের দল ঘাসফড়িং কয়্যার। শান্তির বার্তাবহ সাদা পোশাক পরিহিত শিল্পীরা গানের সুরে সুরে শ্রোতার মনে ছড়িয়ে দেন শান্তির বারতা। একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে শুরু হয় মূল উদ্বোধনী পর্ব। প্রধান অতিথি হিসেবে উৎসব উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক নয়নতারা শেহগাল। সম্মানিত অতিথির বক্তব্য রাখেন কথাসাহিহিত্যক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও কবি কায়সার হক। স্বাগত বক্তব্য রাখেন তিন উৎসব পরিচালক সাদাফ সায সিদ্দিকী, কাজি আনিস আহমেদ ও আহসান আকবর। মূল প্রবন্ধে নয়নতারা শেহগাল বলেন, সাহিত্য হোক আমাদের আনন্দ উদযাপনের অংশ। এখানে সেটাই হচ্ছে, এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে। সারাবিশে^ লেখকরা নানাভাবে আক্রান্ত। ভারতেও লেখকদের চিন্তার স্বাধীনতা আজ আক্রান্ত। কিন্তু আমরাও বসে নেই, আমরাও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। এখানে লেখকদের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী, অভিনেতা, সংস্কৃতিকর্মী, বিজ্ঞানীরাও আমাদের সঙ্গে আছেন। মানুষের ধর্ম থাকতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকতে পারে না। প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলা একাডেমি ও তার আশপাশের এই অঙ্গন বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র। এই জায়গাটিকে আমার বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্রাণের স্থান মনে হয়। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ হচ্ছে অত্যন্ত উদার। এই জায়গাটিতে এই সাহিত্য সম্মেলন নতুন প্রাণের সঞ্চার করবে। সারা বিশে^ই মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সাহিত্য সম্মেলন হতে পারে এই বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, এটি বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। এখানে অনেকেই এসেছেন যারা তাদের পৃথিবী তাদের লেখা সম্বন্ধে আমাদের জানাবেন। সারাবিশে^ই উগ্রবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এই সন্ত্রাস মোকাবেলায় শেখ হাসিনার সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। কারণ, শান্তি ও সৌহার্দ্যরে রক্ষায় আমরা দায়বদ্ধ। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এই উৎসব হচ্ছে মনের মিলন। এটি বংলা ভাষা উদযাপনেরও উৎসব। আমরা বাংলা সাহিত্যকে বিশে^র নানা প্রান্তে পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টায় অবিরাম কাজ করে যাচ্ছি। স্বাগত বক্তব্যে কাজী আনিস আহমেদ বলেন, বাংলা সাহিত্যকে বিশে^র দরবারে তুলে ধরাই এই উৎসবের মূল লক্ষ্য। বাংলা সাহিত্যিকদের মধ্যে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে পঞ্চকবিসহ বাংলা ভাষার অনেক লেখকই উঁচুমানের সাহিত্য রচনা করেছেন। কিন্তু ইংরেজী ভাষায় তাদের সাহিত্যকর্মগুলো প্রকাশিত না হওয়ায় তারা অনেকেই অন্তরালে রয়ে গেছেন। আমরা সেই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে বাংলা ভাষার লেখকদের সাহিত্যকর্ম ইংরেজীতে অনুবাদের উদ্যোগ নিয়েছি। এই সাহিত্য সম্মেলনে শতাধিক অধিবেশনে ২৫০ প্যানেলিস্ট আলোচনা করবেন রাজনীতি, সাহিত্য, ক্রিকেট, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও যাপিত জীবন নিয়ে। বৃহস্পতিবারের অধিবেশনসমূহ ॥ এদিন বেলা ১২টায় মূল মঞ্চে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ রাউন্ড’ শীর্ষক অধিবেশনে কাজী আনিস আহমেদের পরিচালনায় অংশ নেন ব্রিটিশ সাংবাদিক জন স্নো, ভারতীয় শিক্ষাবিদ রমাচন্দ্র গুহ ও নারীবাদী সংগঠন ওয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা জুড কেলি। বেলা ১টায় শুরু হয় ফারুক ওয়াসিফের সঞ্চালনায় ‘জাতীয়তাবাদের বৃত্ত ভেঙ্গে’ শীর্ষক সেমিনার। একই সময় ফাররুখ ধোন্ডি কেকেটি মঞ্চে ভারতে ইংরেজী ভাষার বিবর্তন নিয়ে আপন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। দুপুর দুইটায় মূল মঞ্চে প্রখ্যাত অভিনেতা আলী যাকের এবং সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর আলোচনা করেন তাঁদের ‘মঞ্চ জীবন নিয়ে।’ এছাড়া দিনব্যাপী ছিল কবিতা পাঠ, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, নৃত্য, ব্রিটেনের ওয়াসাফিরি জার্নালের বাংলাদেশ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন, শিশুদের জন্য গল্প বলাসহ নানা আয়োজন। সাহিত্যের এ উৎসবের দেশের খ্যাতিমান লেখকদের পাশাপাশি শামিল হয়েছেন নানা ক্ষেত্রের আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের জনপ্রিয় নারীবাদী লেখক শোভা দে এবং একই দেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক নয়নতারা শেহগাল, ব্রিটিশ সাংবাদিক ও টেলিভিশন উপস্থাপক জন স্নো, কিউবান শীর্ষ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক ইয়োস, কেনিয়ার শিশু সাহিত্যিক ও বক্তা মুথোনি গারল্যান্ড, ফিলিস্তিনী কবি ঘাসান জাকতান, ঔপন্যাসিক অমিত চৌধুরী ও কবি অরবিন্দ কৃষ্ণ মেহরোত্রা। বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ জার্নাল ওয়াসাফিরিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সংখ্যার প্রকাশনা অনুষ্ঠিত হবে এ উৎসবে। এ সংখ্যায় প্রকাশিত হবে বাংলাদেশের লেখকদের লেখা। এছাড়া এদেশের সাহিত্যিকদের বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার লক্ষ্যে ঢাকা ট্রান্সলেশন সেন্টারের ‘লাইব্রেরি অব বাংলাদেশ’ নামের গ্রন্থাগার উদ্বোধন হবে। এই ট্রান্সলেশন সেন্টার থেকে প্রকাশিত হবে সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বইয়ের ইংরেজী অনুবাদ। ফেস্ট উপলক্ষে ট্রান্সলেশন সেন্টার নতুন অনুবাদক প্রজন্ম তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে। এর তত্ত্বাবধানে রয়েছেন ভারতীয় অনুবাদক অরুনাভ সিনহা। এছাড়া উৎসবে বাংলার আদি সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে মঞ্চস্থ হবে মনসা মঙ্গলের বিশেষ অংশ বেহুলার লাচারি। এই অংশটি মঞ্চায়নের জন্য টাঙ্গাইল থেকে এসেছে যাত্রাদল। প্রকাশিত হবে কায়জার হকের ইংরেজী ভাষায় অনূদিত ‘মনসা মঙ্গল’। উৎসবের বিভিন্ন আয়োজন অংশ নেবেন বাংলাদেশী কবি নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মদ নূরুল হুদাসহ অনেকে। তিন দিনের এ উৎসব শেষ হবে শনিবার। সকাল ৯টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত চলবে নানা আয়োজন। দেশের সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে এই ফেস্টের আয়োজন করছে যাত্রিক। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সহযোগী আয়োজক হয়েছে বাংলা একাডেমি। এটির টাইটেল স্পন্সর ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন, প্ল্যাটিনাম স্পন্সর সিটি ব্যাংক। এছাড়াও গোল্ড স্পন্সর হিসেবে রয়েছে, ওরিয়ন ফুটওয়ার, ইউল্যাব ও ব্র্যাক ব্যংক। সিলভার স্পন্সর হিসেবে রয়েছে, পুনর্ভা লিমিটেড ও ইগনাইট পাবলিকেশন লিমিটেড।
×