ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

প্যারিস হামলা আইএস এবং ক্ষমতার লড়াই

প্রকাশিত: ০৩:২৭, ১৮ নভেম্বর ২০১৫

প্যারিস হামলা আইএস এবং ক্ষমতার লড়াই

এবার সম্ভবত বিশ্ব অডিয়েন্সের আইএস নাটকের বিস্তার ও পরিণতি দেখার পালা। তেরো নবেম্বর প্যারিসে এক সঙ্গে ছয় জায়গা থেকে সন্ত্রাসী হামলার পর ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের তাৎক্ষণিক মন্তব্যে আইএসকে দায়ী করে ‘নির্মমভাবে’ এর জবাব দেয়ার অঙ্গীকার এবং পেন্টাগন সূত্রের ‘আইএস বিরোধী লড়াইয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়’- এ দুই তথ্যের পর ধরে নেয়া যায় এ নাটক দ্রুত ক্লাইমেক্সের দিকে যাচ্ছে। গত বছর গাজায় ইসরাইলী সর্বাত্মক হামলা চলার সময় বিশ্ববাসী পরিচিত হয় ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এ্যান্ড সিরিয়া’ বা ‘আইসিস’ নামের সঙ্গে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নানারকম তা-ব ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে শেষে ইসলামিক স্টেট বা আইএস নাম নিয়ে ইরাকের সবচেয়ে বড় শহর মসুল দখলের মধ্য দিয়ে যে সন্ত্রাসী সংগঠনটি নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল সবশেষ প্যারিস হামলার দায় তারাই স্বীকার করেছে। প্যারিসের মতো শহরে এরকম হামলায় দুই গোলার্ধের মানুষ হকচকিয়ে গেছে। নইলে ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের প্রতিক্রিয়ায় সম্ভবত অনেকে অসঙ্গতি দেখতে পেতেন। আইএস হামলার দায় স্বীকার করার আগেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় স্থির নিশ্চিতভাবে তিনি আইএসকে দায়ী করেছেন। তিনি কি করে এত নিশ্চিত ছিলেন? প্রশ্নটি মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের মনে পড়ত সহস্রাব্দ শুরুর ভয়াবহ সেই ঘটনা। হ্যাঁ, দু’হাজার এক সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জন্য কোনরকম তদন্ত ছাড়াই দায়ী করা হয়েছিল ওসামা বিন লাদেনকে। ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের খবর শুনে সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার লাইভ ভিডিও দেখে অনেকে বিস্মিত হয়েছিলেন। এত বড় ঘটনা অথচ প্রেসিডেন্ট শান্ত সৌম্য নির্বিকার। সম্ভবত শিশুদের একটি অনুষ্ঠানে ছিলেন তিনি তখন। খবর শুনে দু’দশ মিনিট নীরব থেকে যা করছিলেন তাতে মনোযোগ দেন। প্রশ্ন উঠেছিল, তবে কি তিনি আগে থেকেই জানতেন এমনটা ঘটবে? (পরের ঘটনাবলী সাক্ষ্য দেয় তিনি আগে থেকেই জানতেন)। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনা নিয়ে পরে তদন্ত বিশ্লেষণ আলোচনা ইত্যাদি অনেক হয়েছে। ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করা এবং তাকে না পেয়ে আফগানিস্তানে লঙ্কাকা- ঘটানো- এ সবই যে নাটকের একেকটি সিকোয়েন্স ছিল, তা এখন মোটামুটি পরিষ্কার। নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞরা একমত হয়ে এটাই বলছেন যে, টুইন টাওয়ার ধ্বংস করার মতো প্রযুক্তি এবং সক্ষমতা কেবল বিশ্বের দুটো গোয়েন্দা সংস্থারই আছে। যা হোক, প্যারিস হামলা সম্পর্কে বলা হচ্ছে- পরিকল্পনা ফ্রান্সের বাইরে হলেও হামলা করেছে অভ্যন্তরের সন্ত্রাসীরা। এও বলা হচ্ছে- সন্ত্রাসীদের অনেকে এসেছে সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থীদের মধ্য থেকে। দুয়ে দুয়ে চারের সরল হিসাবে খুব সহজে শরণার্থীদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। কিন্তু পশ্চিমা গোয়েন্দা কাহিনীর হিসাব এত সহজ নয়, সচেতন পাঠকমাত্রই তা জানেন। গত বছর প্রথম দফায় সিরিয়া আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বাশার আল আসাদের উদ্দেশে বলেছিলেন- ‘একজন স্বৈরাচারী নিষ্ঠুর শাসকের বেপরোয়া রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের জবাবদিহিতা চাওয়া হবে। কোন ধরনের ঘৃণ্য অস্ত্র এ পৃথিবীতে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না, এটাই এ গ্রহের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার।’ অর্থাৎ পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার মহৎ উদ্দেশ্যে তারা নিবেদিতপ্রাণ! যারা সারা পৃথিবীর সামরিক ব্যয়ের শতকরা ষাট ভাগেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করে এবং অস্ত্র অর্থনীতির একচেটিয়া দখল বজায় রাখতে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধ জিইয়ে রাখে তাদের মুখে এমন ভাল মানুষী কথার তাৎপর্য বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কার। প্রখ্যাত তাত্ত্বিক আই কে শুক্লা (ইন্দু কান্ত শুক্লা) এই শান্তিবাদীদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘পুঁজিবাদী তত্ত্বাবধানে শান্তি মানেই পরবর্তী যুদ্ধের প্রস্তুতি। যুদ্ধ ছাড়া পুঁজিবাদ টিকে থাকতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদীরা যত বেশি করে শান্তির কথা বলে, ততই তারা গোপনে ও প্রকাশ্যে আরও বড়, আরও বর্বর যুদ্ধের পরিকল্পনা আঁটে’Ñ (নতুন সহস্রাব্দের দোরগোড়ায়)। সত্যি তাই। নইলে কি দরকার ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর? তখন তো যুদ্ধ শেষে আসন্ন শান্তির সময়। সেই উনিশ শ পঁয়তাল্লিশ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গনগনে সূর্য অস্তমিত। পুঁজিবাদী কেন্দ্রের ভর তখন ইউরোপ থেকে সরে আটলান্টিকের ওই পাড়ের উত্তর আমেরিকায়। শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার নতুন পর্ব। যার সেলিব্রেশন হয় পারমাণবিক বোমায় লাখ লাখ মানুষ হত্যা করে। নতুন সাম্রাজ্যের চরিত্র কি হবে শুরুতেই সম্ভবত শেষ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছিল। একদিকে চীন কোরিয়া ভিয়েতনামসহ বিপ্লবী পূর্ব এশিয়া, অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়ার ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র কাঠামোর দেশগুলোর দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয় নবীন সাম্রাজ্য। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরই মধ্যপ্রচ্যের জন্য ‘ট্রুম্যান ডকট্রিন’ নামে যে ফর্মুলা ঘোষিত হয় তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল নতুন বিশ্ব নিয়ন্তাদের হাত শক্তিশালী করতে দক্ষিণপন্থী ইসলামী শক্তিকে শাণিত করা। সমাজতন্ত্র ও সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে উপসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্রগুলোকে গড়ে তোলা। এজন্য অর্থ ও অস্ত্রের যোগান এসেছে জোয়ারের মতো। দীর্ঘমেয়াদী সেই পরিকল্পনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফল ইসলামের নামে এক বিকৃত দানবীয় শক্তির উত্থান। এ কাজ তারা করেছিল কমিউনিজম-ভীতি থেকে। স্ট্যালিনের নেতৃত্বে রেড আর্মি প্রবল পরাক্রমে হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে পরাজিত করেছিল। যুদ্ধের প্রচ-তায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল ইউরোপ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। তারপরও সমাজতান্ত্রিক এ বিশাল রাষ্ট্র শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছিল চারপাশে পুঁজিবাদী দেশগুলো ঘিরে থাকার পরও। তা ছিল পুঁজিতান্ত্রিক দেশগুলোর দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ। বিশেষ করে যুদ্ধে রেডফোর্স যে প্রবল শক্তিমত্তা দেখিয়েছে তাতে যুদ্ধ জয়ের মূল কৃতিত্ব তাদের পকেটেই যায়। যুদ্ধোত্তর বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে যাওয়ার কথা। তা যাতে না হয় সেজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল বিধ্বংসী শক্তি প্রদর্শনের, যাতে তার শক্তির কাছে নত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। আরও অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম নতুন কালের নতুন সাম্রাজ্যের শোষণ প্রক্রিয়ার বাধা দূর করা। শাসন শোষণের মরচে ধরা পুরনো কলকব্জা বাতিল করে তার প্রয়োজন নতুন কৌশল। যা প্রয়োগে অন্যতম প্রতিবন্ধক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সুতরাং যে করেই হোক এ প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলাই হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সাধনা। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু নিজেই রাজনৈতিক অর্থনৈতিক শক্ত ভিত গড়েনি। গোটা পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণী এবং উপনিবেশগুলোর নিপীড়িত জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করছিল। প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার কাজে মার্কিনী অধ্যবসায় এক সময় সফল হয়। দুই পরাশক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব, ঠা-া লড়াই শেষ হওয়ার পর মার্কিন ভাষ্যানুযায়ী বিশ্বে শান্তির নহর বয়ে যাওয়ার কথা। দুই মেরুতে বিভক্ত বিশ্ব ব্যবস্থার অবসানের পর যুক্তরাষ্ট্র একাই নেতৃত্বে। বিশ্বময় অবারিত নেতৃত্ব তার। গত শতকের নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রের ‘নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার অঙ্গীকারে যারা আস্থা রেখেছিলেন অচিরেই তারা সেই ‘নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার’ স্বরূপ দেখলেন আফগানিস্তানে। সেখানে সোভিয়েত সমর্থিত সরকার উৎখাতের পর ক্ষমতার প্রশ্নে বেশ কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহের এক পর্যায়ে তালেবানরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। তাদের অন্যান্য বর্বরতার সঙ্গে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের বিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শন বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস ছিল অন্যতম। মূলত, নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি ছিল ‘ঠা-া লড়াই’ চলার সময় থেকে। তারা বুঝেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অবর্তমানে এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের মোক্ষম অস্ত্র হবে ধর্ম এবং পাকিস্তান হচ্ছে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আদর্শ ঘাঁটি। স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের সহায়তায় বেশ কিছু উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলে তারা। পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনী তাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে দক্ষ করে তোলে। এদেরই একটি অংশ তালেবান। আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের সব বর্বরতা দেখেও না দেখার ভান করে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এ ঔদাসীন্য ছিল তখন পর্যন্ত যতদিন তাদের স্বার্থে আঘাত লাগেনি। যখনই তা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বমূর্তি ধারণ করতে এক মুহূর্ত সময় লাগেনি। মধ্য এশিয়া থেকে পাকিস্তান হয়ে আরব সাগরে তেল বহনের জন্য আফগানিস্তানের ওয়াখান করিডর ছিল একমাত্র রুট, যেটা তালেবানরা মার্কিনীদের ব্যবহার করতে দিতে রাজি হয়নি। যে উদ্দেশ্যে দুধ-কলা দিয়ে পুষে যতœ করে ক্ষমতায় বসানো, তা পূরণে বাধা আসার সঙ্গে সঙ্গে তালেবান উৎখাতে উঠেপড়ে লাগে যুক্তরাষ্ট্র। এ প্রক্রিয়ার সূচনা হিসেবেই সংঘটিত হয় দু’হাজার এক সালের এগারো সেপ্টেম্বরের ঘটনা। ওসামা বিন লাদেনকে ওই ঘটনার নায়ক বানিয়ে কি দক্ষযজ্ঞ ঘটানো হয়েছে ইতিহাস তার সাক্ষী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব আজ যে ‘ইসলামী মৌলবাদ’কে প্রতিপক্ষ বানিয়ে সুবিধা মতো যেখানে সেখানে যুদ্ধ ঘোষণা করছে তাকে তারা ধরে নিয়েছে পূর্বতন শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নের বিকল্প হিসেবে এবং এক সময়ের কমিউনিজম বিরোধী সাহিত্য চলচ্চিত্রসহ শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমের জায়গা এখন দখল করেছে ইসলাম বনাম খ্রিস্টান, ইসলাম বনাম পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব-বিরোধের গালগল্প। ‘নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার’ স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছিল সহস্রাব্দের শুরুতেই। ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ নাম নিয়ে দু’হাজার এক-এ সেই যে যাত্রা শুরু নানান নাম ও বিশেষণ নিয়ে তা ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে চলছে। আইএস হচ্ছে তার আপডেট সংস্করণ।
×