ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খুলেছে নবান্নের দুয়ার-গৃহস্থ বাড়িতে নতুন ধানের ম ম গন্ধ...

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৬ নভেম্বর ২০১৫

খুলেছে নবান্নের দুয়ার-গৃহস্থ বাড়িতে নতুন ধানের ম ম গন্ধ...

সমুদ্র হক ॥ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলায় নবান্নের দুয়ার খুলে গেছে। আমন ধানের ম ম গন্ধে বাঙালীর শেকড় সংস্কৃতির আবহমান চিরন্তন ধারায় গৃহস্থ ও কিষান বাড়ির আঙিনা এখন ঝকঝকে। গেল ক’দিনে কাদাজলে উঠান লেপে নতুন ধান বিছিয়ে দেয়ার আয়োজন শেষ হয়েছে। গোধূলি পেরিয়ে কিষান ধান কেটে আঙিনায় এনেছে। রোদে শুকিয়ে কুলা দিয়ে চিটা উড়িয়ে নতুন ধান তুলেছে বড় কড়াইয়ে। সিদ্ধ শুকান করে নতুন চালও ছেঁটে নিয়েছে। একটা সময় অঘ্রাণের আগেই গ্রামের ঢেঁকি সচল হয়ে উঠেছে। ‘ও ধান ভানিরে ঢেঁকিত পার দিয়া...’ এমন কথার গানে গাঁয়ের নববধূরা পা দিয়ে ঢেঁকি ঠেলে ধান ছেঁটে চাল বের করে এনেছে। সেদিনের সেই ঢেঁকি আজ আর নেই। তবে নবান্নের গীত হয়ে গাঁয়ের বধূর কণ্ঠে ভেসে আসে। যান্ত্রিক কৃষিতে এখন ধান ভানা হয় শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ভ্রাম্যমাণ যন্ত্রে। প্রযুক্তির যুগে এই যন্ত্রওয়ালাদের মোবাইল ফোনে খবর দিলেই উঠানে হাজির হয়ে যায়। এভাবে নতুন ধান ভেনে চাল করা হয়েছে। গ্রামের উঠানে এখন সন্ধ্যাবাতি দেয়ার পরই আঙিনায় চুলা জ্বেলে অনেকটা সময় ধরে থাকে। রাতের খাবার তৈরির পর শুরু হয় নতুন চালের পায়েস, চালের আটার পিঠাপুলি বানানোর আয়োজন। অঘ্রাণের প্রথম দিনে নবান্নের প্রহরে গাঁয়ের বধূরা আগেভাগেই ঘুম থেকে উঠে আঙ্গিনা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে হেঁশেলে গিয়ে বসেছে। তারপর আগের রাতের আয়োজন শেষ করতে ফিরনী পায়েস তৈরি। গৃহস্থ ও কিষান বাড়ির নবান্নের প্রথম দিনের এই চিরন্তন চিত্র আজও পাল্টায়নি। বরং দিনে দিনে আরও উন্নত হয়েছে। বগুড়ার বাঙালী নদী তীরের রানীরপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নবান্নের উৎসবের গতি বাড়িয়ে দিতে বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা মেতে উঠেছে। সেদিনের খেয়াঘাট আজ আর নেই। তারপরও নদী তীরে নৌকা ভিড়েছে। ক’জন তরুণ বলল, নবান্নের আনন্দে তারা নদীতে নৌকা বাইয়ে আনন্দ করবে, করলও তাই। ঘরে ফিরে নতুন চালের ভাতের সঙ্গে ফিরনী পায়েস খেল। গ্রামের তরুণীরাও এইদিনে শাড়ি পরে গীত গেয়েছে। ছেলেবেলার মধুময় দিনে খেলা খেলেছে। গ্রামের গৃহস্থ অবসরপ্রাপ্ত কৃষি গবেষক জহুরুল ইসলাম বললেন, কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে গ্রামের বধূরা নবান্নের উৎসবের সব আয়োজন করছে। সেদিনের সেই উৎসবের সঙ্গে বর্তমানের উৎসবের মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। দিনে দিনে নতুন অনুসঙ্গ যোগ হয়েছে। গ্রামটি অনেক আগেই বিদ্যুতায়িত হয়েছে। পাকা সড়কে জেলা ও উপজেলা সদরের উন্নত যোগাযোগের ব্যবস্থা হওয়ায় শহরের মতো গ্রামেও নানা আয়োজন হয়। এবারও তাই হয়েছে। এ যুগের তরুণ-তরুণীদের হাতের স্মার্ট ফোনে ও ঘরে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখে তারাও নবান্নের অনুষ্ঠান সাজিয়েছে। বগুড়া শিশু একাডেমি চত্বরে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরণীরা মেতে উঠেছিল নবান্নের অনাবিল আনন্দে। নেচে গেয়ে মজা করে গ্রামীণ খেলায় অংশ নিয়ে মাতিয়ে তোলে চত্বর। নবান্নের এই দিনে এখন আর মনেই হয় না কোনটি শহর আর কোনটি গ্রাম। নবান্নের সব আয়োজন মিলেছে এক পথে, যে পথ বাঙালীর শেকড় সংস্কৃতির পথ...।
×