বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্যারিসে ভয়াবহ জঙ্গী সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় প্রায় দেড়শ’ মানুষের হত্যার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেও জঙ্গীবাদের ভয়াবহতার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। জঙ্গী মৌলবাদীদের একের পর গুপ্ত হত্যাসহ রাষ্ট্রবিরোধী অব্যবহত তৎপরতায় উদ্বেগ বাড়ছে জনমনে। এ অবস্থায় নতুন করে জোরালো হচ্ছে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত আদালতে ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত জামায়াত নিষিদ্ধ করার দাবি। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সকল জঙ্গী সংগঠনের মূল হচ্ছে জামায়াত। বাংলাদেশে জামায়াত থাকলে ‘জঙ্গীবাদের চাষ’ হবেই। দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে তারা বলছেন, যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের রায় কার্যকর হলেই দেশে গুপ্ত ও প্রকাশ্যে হামলা বন্ধ হয়ে যাবে।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে শুক্রবার সন্ধ্যায় জঙ্গী হামলায় এখনও স্তম্ভিত সারাবিশ্ব। উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে জঙ্গীবাদের আছর লাগা প্রতিটি দেশেই। একটি কনসার্ট হলো ও স্টেডিয়ামসহ পাঁচটি স্থানে অ্যাসল্ট রাইফেল ও বোমা নিয়ে ওই হামলায় নিহত হয়েছেন প্রায় দেড়শত মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্যারিসে এতবড় হত্যাকা- আর ঘটেনি। হামলার পরপরই জঙ্গী সংগঠন আইএস ঘটনার দায় স্বীকার করেছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ ইতোমধ্যে প্যারিসের হামলাকারীদের ‘নির্দয় জবাব’ দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, যুদ্ধের মুখে দাঁড়িয়ে জাতিকে আজ অবশ্যই সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। আইএসএর বিরুদ্ধে যুদ্ধের নেতৃত্বে থাকা যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট চেষ্টা করছে না বলে ঘরে বাইরে অভিযোগ উঠছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। প্যারিসের হামলার পর ওয়াশিংটন এখন তাদের ইউরোপীয় ও আরব মিত্রদের নিয়ে ইরাক ও সিরিয়ায় সামরিক শক্তি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে বাধ্য হবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ার বিশাল ভূখ- দখলে নিয়ে খেলাফত কায়েমের ঘোষণা দেয়া ইসলামিক স্টেট বা আইএস গত দুই বছরে পুরো বিশ্বের জন্যই বড় ধরনের হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গতবছর থেকে আইএসের অবস্থানে আকাশপথে যে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছে, শুরু থেকেই তার সঙ্গে রয়েছে ফ্রান্স। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট দলের সিনেটর দিয়ানে ফেইনস্টেইন বলেছেন, ইরাক ও সিরিয়ায় স্থানীয় স্থলবাহিনীর সমর্থনে সীমিত আকারে বিমান হামলার যে কৌশল নিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কাজ করছেন, তা আর কাজে দিচ্ছে নাÑ এটা স্পষ্ট। আমাদের দেশ এবং আমাদের মিত্রদের রক্ষায় তা যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, ইরাক ও সিরিয়া ছাড়িয়ে যুদ্ধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কাজেই আমাদেরও তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। ওবামার সাবেক উপদেষ্টা ব্রুস রিডেল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, আইএস কেবল ইরাক ও সিরিয়া নিয়েই মনোযোগী থাকবে কি নাÑ সেই প্রশ্নের অবসান হয়েছে প্যারিসে হামলার পর। এদিকে আইএস প্রতিষ্ঠা হওয়ার পেছনে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে বলে রবিবার অভিযোগ তুলেছেন, কিউবার সাবেক নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো। কিউবার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থায় প্রকাশিত ক্যাস্ট্রোর লেখা এক প্রবন্ধের বরাত দিয়ে রাশিয়া টুডেসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম একথা জানিয়েছে। ক্যাস্ট্রো তার প্রবন্ধে বলেছেন, ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও মার্কিন সিনেটর জন ম্যাককেইন ষড়যন্ত্র করে আইএস গঠন করেছে। যে দলটি এখন ইরাক এবং সিরিয়ার অনেক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। আইএস গঠনের এই পুরো প্রক্রিয়াকে জার্মানির এসএস ট্রুপের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ন্যাটোর নেতৃত্বও হিটলারের মতোই আধিপত্যবাদী। তাদের আবস্থানও এ্যাডলফ হিটলারের সাম্রাজ্যের লোভের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
অন্যদিকে জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে ইরাকে আক্রমণের ফলেই ‘অনিচ্ছাকৃতভাবে’ আইএসের (ইসলামিক স্টেট) উত্থান ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আইএসের উত্থানের পেছনে কারণ হিসেবে ওবামা বলেন, ‘দুইটি বিষয় : একটা হলো ইরাকে আল-কায়েদার কর্মকা-ের প্রত্যক্ষ ফল আইএস, যা আমাদের আক্রমণের কারণে বেড়ে উঠেছে। এটা অনিচ্ছাকৃত পরিণতির উদাহরণ। গুলি করার আগে ভাবতে হবে আমরা কেন তা করছি।
বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ উত্থানের জন্য
জামায়াত দায়ী ॥ জঙ্গীবাদ একটি জাতীয় সমস্যা। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থানের জন্য জামায়াতে ইসলামী দায়ী। জামায়াতে ইসলামী এদেশে থাকলে জঙ্গীবাদের চাষ হবে। এ দলটিকে দ্রুত নিষিদ্ধ করতে হবে। সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে ‘জঙ্গীবাদের হুমকি : বাংলাদেশ ভাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। আলোচনা সভায় জানানো হয়, দেশে শতাধিক জঙ্গী সংগঠন ক্রিয়াশীল। জঙ্গীবাদের কারণে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ২২ হাজার ৭০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেছেন, কেবল জঙ্গীবাদ উত্থানের কারণে বাংলাদেশের মানবাধিকার হুমকির মধ্যে রয়েছে। জঙ্গীবাদকে নির্মূল করায় এখন দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বা গুমের মাধ্যমে জঙ্গীবাদ নির্মূল সম্ভব নয় বলে মত দেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। সাবেক সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ বলেন, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডাঃ সরোয়ার আলী বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয় সমগ্র উপমহাদেশে দুটি কারণে মূলত জঙ্গীবাদের উত্থান হয়। প্রথমত, নিরাপত্তাজনিত এবং তারপর মৌলিক ভাবাদর্শগত পার্থক্যের কারণে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি ভাবাদর্শের সংগ্রাম। এ অর্জনকে ধ্বংস করে দিতে এখন ইসলামের উগ্রবাদী ব্যাখ্যা তৃণমূল মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ এখন নিরাপত্তা আর ভাবাদর্শ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে দাবি করে এ থেকে উত্তরণে শুধু সরকারের দিকে চেয়ে না থেকে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে তা মোকাবেলার আহ্বান জানান সরোয়ার আলী।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত আলাদা কেউ নয়। এটি অনুধাবন করতে হবে। জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক। জঙ্গীবাদ নির্মূলে সরকারকে সক্রিয়তাও প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, আমলা ও গোয়েন্দানির্ভর হলে জঙ্গী দমন কঠিন হয়ে উঠতে পারে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির জঙ্গী উত্থানের জন্য সরাসরি জামায়াতকে দায়ী করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী থাকলে ‘জঙ্গীবাদের চাষ’ হবে। এ দলটিকে নিষিদ্ধ করতে হবে। জঙ্গীবাদের গ্লোবাল নেটওয়ার্ক সম্পর্কে না জানলে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ব্যাপ্তির ব্যাপারে সঠিক তথ্য জানা যাবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
শোলাকিয়া ঈদগাহ-এর ইমাম মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসুদ জনকণ্ঠকে বলেন, যে ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম, সেই ইসলামের নামে জঙ্গীবাদ এবং সহিংসতা করা হচ্ছে। তিনি জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় সবাইকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় ধর্মীয় ব্যক্তিদের কাজে লাগাতে হবে। আর জামায়াত যেহেতু জঙ্গী সন্ত্রাসী দল, তাই জামায়াতের সব প্রকাশনা বন্ধ করতে হবে। দলটিকে নিষিদ্ধ করতে হবে। বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট সভাপতি মাওলানা মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, জঙ্গীবাদ আমাদের দেশে শুরু হয়ে গেছে। এর প্রতিরোধ আগেই দরকার ছিল। জঙ্গীবাদের দ্বারা যারা ব্যবহৃত হচ্ছেন তারা অশিক্ষিত এবং কুশিক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছেন। এরা ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। দেশে জঙ্গীবাদ প্রতিষ্ঠার জনক জামায়াত। স্বাধীনতার পরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ব্যাপক অর্থ সংগ্রহ করেছে জামায়াত। লন্ডনে বাংলাটিভির মাধ্যমে ইসলামের কথা বলে অর্থ সংগ্রহ করছে এই জঙ্গীবাদী জামায়াতে ইসলামী। দেশে জঙ্গীবাদীরা জিহাদ ও পর্দার অপব্যাখ্যা দিচ্ছে।
অর্ধশত দেশে সক্রিয় শিবির ॥ বিশ্বের দশ সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকায় তিন নম্বরে উঠে আসা জামায়াতের সংগঠন ছাত্রশিবিরের নেটওয়ার্ক এখন আর কেবল দেশে সীমাবদ্ধ নেই। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন, পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’সহ বিদেশী মুরব্বিদের সহায়তায় দেশের গ-ি ছাড়িয়ে শিবির বিশ্বের অন্তত ৫০ দেশে বিস্তৃত করেছে তার সাংগঠনিক কর্মকা-। গোপনে সদস্য হিসেবেও শিবির সক্রিয় অনেক আন্তর্জাতিক উগ্রবাদী ফোরামে। ছাত্রশিবিরের সভাপতিদের এ সব আন্তর্জাতিক ফোরাম বা জোটে মহাসচিবের দায়িত্ব পালনেরও নজির আছে।
অনুুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ সন্ত্রাসী সংগঠনটির আন্তর্জাতিক নানা অপতৎপরতার তথ্য। জানা গেছে, নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করলেও শিবির আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে একেক নামে একেক দেশে সংগঠিত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে নাম পাল্টানো শাখার রয়েছে আলাদা কর্মপদ্ধতি। তবে দেশের মতো বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রেও শিবিরের নাম পাল্টানো এ সব সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করছে জামায়াত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। জামায়াত-শিবিরের বিষয়ে আর কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। জঙ্গীবাদ দমনে অবিলম্বে জামায়াত-শিবিরসহ সন্ত্রাসী জঙ্গীবাদী ও তাদের মদদদাতাদের রাষ্ট্রের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করতে হবে। বিলম্ব হলে দেশের অবস্থা হবে ভয়াবহ। জানা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফেডারেশন অব স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনের সদস্য হিসেবে ছাত্রশিবিরের আন্তর্জাতিক লবিং সক্রিয় আছে। অর্গানাইজেশনের সঙ্গে রয়েছে শিবিরের সাংগঠনিক সম্পর্ক। ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ডাঃ আবদুল্লাহ তাহেরসহ একাধিক সভাপতি এক সময় এ ফেডারেশনের মহাসচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ডাঃ আবদুল্লাহ তাহের বর্তমানে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য হিসেবেও আন্তর্জাতিক ওই গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু তাই নয়, ‘ওয়ার্ল্ড এ্যাসেম্বলি অব মুসলিম ইয়ুথ’ নামক একটি জোটেরও সদস্য হিসেবে সক্রিয় ছাত্রশিবির। পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) সঙ্গে সর্বদা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলে ছাত্রশিবির। আইএসআই তাদের আর্থিক সহায়তা দেয়Ñ এমন তথ্যও বেরিয়েছে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুসন্ধানেও। দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদ নিয়ে গবেষণারত ‘সাউথ এশিয়ান টেররিজম পোর্টাল’ নামক সংস্থা একাধিকবার বলেছে, শিবির একটি জঙ্গী সংগঠন। যার সঙ্গে রয়েছে আইএসআইয়ের সম্পর্ক। সংস্থাটি এও বলেছে, নিষিদ্ধ সংগঠন হরকত-উল-জিহাদসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের নেটওয়ার্কে কাজ করছে ইসলামী ছাত্রশিবির।
জামায়াতের সহযোগী আর্থিক প্রতিষ্ঠান ১২৭টি ॥ যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর পৃষ্ঠপোষকতায় সারাদেশে পরিচালিত হচ্ছে দেশী-বিদেশী ৪৩টি এনজিওসহ ১২৭টিরও বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান ধর্মের নাম ব্যবহার করে নানা কৌশলে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখে আর্থিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে। যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুফল পাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ‘রাজনৈতিক দল’ বা ‘সংগঠন’ হিসেবে জামায়াতের বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে তদন্ত সংস্থার দাখিল করা প্রতিবেদন’ পর্যালোচনায় এ তথ্য পাওয়া যায়। তদন্ত সংস্থা এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনগত দিক খতিয়ে দেখতে প্রস্তাবও দিয়েছে। জামায়াতের প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকায় রয়েছে দেশী-বিদেশী এনজিও ৪৩, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২২ এবং হাসপাতাল-ক্লিনিক ১০টি। যুদ্ধাপরাধী ‘দল’ বা ‘সংগঠন’ হিসেবে জামায়াতের বিচার শুরুর পাশাপাশি দলটির অর্থের উৎস চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াফতের দাবি জানিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, জামায়াতের বিচার করলেই হবে না, দলটির অর্থের উৎসও বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় দেশকে জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত করার অপতৎপরতা প্রতিরোধ করা যাবে না।
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া এমেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রসঙ্গে বলেছেন, ইরাক, সিরিয়াসহ সারা বিশ্বে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গীদের ধরা হচ্ছে। ইরাক-সিরিয়ায় হলো ইসলামিক স্টেটের শাখা, তাদের হেডঅফিস হচ্ছে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এদের বিরুদ্ধে তদন্ত করলেই জঙ্গীবাদের উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে। তারা শুধু যুদ্ধাপরাধীদেরই পক্ষাবলম্বন করছে না, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার ওপর আঘাত হানছে। যদি আমরা এখনই এদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত না করি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকেও সিরিয়ার আইলান কুর্দিদের মতো বঙ্গোপসাগরে ভাসতে দেখা যাবে। তিনি বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদীদের তৎপরতার কথা উল্লেখ করে বলেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের রায় কার্যকর হলেই দেশে গুপ্ত ও প্রকাশ্যে হামলা বন্ধ হয়ে যাবে। ডাঃ ইমরান বলেন, যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের রায় আপীল বিভাগে চূড়ান্ত হয়েছে। এরপরও তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে ভিডিও বার্তা ছড়িয়ে কুৎসা রটাচ্ছে। তাদের বিচার বিলম্বিত হওয়ার কারণেই একের পর এক গুপ্ত ও প্রকাশ্যে হত্যা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এই কুখ্যাত খুনীরা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি বরং তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ব্যবস্থা নিয়ে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তার বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বানও জানান ডাঃ ইমরান।
জামায়াত নিষিদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদেও বিচার দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ইসলামকে বলা হয় ‘শান্তি’র ধর্ম। জামায়াতে ইসলামী দাবি করে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবুল আলা মওদুদী কোরান ও ইসলামের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যারা তা মানবে না তারা মুসলমান নয়, কাফের এবং হত্যার যোগ্য। কোরানের বহু আয়াতে পরমতসহিষ্ণুতার কথা বলা হয়েছে, ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি বারণ করা হয়েছে; কিন্তু মওদুদী কোরানের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেখানে জীঘাংসা, সন্ত্রাস এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা সবই বৈধ। কোরানে ভিন্নমত পোষণকারীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যাহারা দীন সম্পর্কে নানা মতের সৃষ্টি করিয়াছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হইয়াছে তাহাদের কোন দায়িত্ব তোমার নয়, তাহাদের বিষয় আল্লাহ ইখ্্তয়িারভুক্ত। (সূরা : আন’আম, আয়াত ১৫৯) মওদুদী এবং তাদের অনুসারীরা আল্লাহ ও বান্দার এখতিয়ারের সীমারেখা মানেন না।
ইসলাম সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণকারীদের সম্পর্কে মওদুদী বলেছেন, ‘আমাদের জগতে আমরা কোন মুসলমানকে যেমন ধর্ম পরিবর্তন করতে দিই না, তেমনি অন্য ধর্মাবলম্বীকে তার ধর্ম প্রচারও করতে দিই না। (মুরতাদ কি সাজা ইসলামী কানুন মে’, ইসলামিক পাবলিকেশন লি., লাহোর, ১৯৮১, ৮ম সংস্করণ, পৃষ্ঠা. ৩২) ভিন্নমতাবলম্বী মুক্তচিন্তার ব্লগারদের ধারাবাহিক হত্যাকা- থেকে শুরু করে দুর্গাপূজার ম-পে কিংবা শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে হামলা ও হত্যাকা- জামায়াতের এই দর্শনেরই অভিব্যক্তি।
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা ও আদর্শিক গুরু মওদুদী এবং তার সমসাময়িক মিসরের ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর হাসান আল বান্না ও সাঈদ কুত্্ব রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করার জন্য যেভাবে ইসলামের নামে যাবতীয় সন্ত্রাস ও হত্যাযজ্ঞকে বৈধতা দিয়েছেন বর্তমান বিশ্বে ‘আল কায়েদা’ ও ‘আইএস’-এর সকল কর্মকা- তারই আলোকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে হবে। ‘আল কায়েদা’ ও ‘আইএস’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নীতিনির্ধারকরা নিজেদের গড়ে তুলেছেন মওদুদী, হাসান বান্না আর সাঈদ কুত্্বদের রচনাবলীর নির্দেশনা অনুযায়ী।