বাবুল সরদার, বাগেরহাট ॥ আজ ভয়াল ১৫ নবেম্বর ভয়াল সুপার সাইক্লোন সিডর দিবস। সিডরের আট বছর পূর্ণ হলেও বাগেরহাটে গৃহহীন হাজারো পরিবার। নিশ্চিত করা যায়নি এই জনপদের মানুষগুলোর জন্য পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র। হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ। সৃষ্টি করা যায়নি ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থ-সামাজিক কর্মসংস্থানের সুযোগ। সাইক্লোন সিডরে এ জেলায় মারা যায় প্রায় ১ হাজার মানুষ।
সুন্দরবন সন্নিহিত উপজেলা শরণখোলাতেই সরকারী হিসাবে মারা যায় ৯০৮ জন। এর মধ্যে সিডরের মূলকেন্দ্র (আই) হিসেবে আঘাত হানে বলেশ্বর নদী তীরবর্তী সাউথখালী ইউনিয়নে এতে সাতশ’ মানুষ মারা যায়। যার অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। ল-ভ- হয়ে যায়, ঘরবাড়ি, গাছপালা ও ফসলের ক্ষেত। তবে বেসরকারী হিসাবে এ মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় শরণখোলাসহ বাগেরহাটের ৫টি উপজেলার প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার এলাকা। সিডরের পর বিধ্বস্ত এলাকার মানুষের সাহায্যে ছুটে আসে সরকারী-বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ও সাধারণ মানুষ। সুপার সাইক্লোন সিডরে সেই ভয়াল দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়া করছে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলবাসীকে।
বলেশ্বর নদীর তীরবর্তী উত্তর সাউথখালী গ্রামের ছত্তার ফকির বলেন, ‘পোলা মাইয়্যাসহ ঘরবাড়ি সব হারিয়ে নিঃস্ব জীবন কাটছে কোন মতে। সরকার ও এনজিও থেকে সহযোগিতা পেয়ে বছরের ৬ মাস খেয়ে পড়ে থাকতে হয়। কিন্তু মোগো কেউ কাজের ব্যবস্থা করে দেয় না। মোর ভাইবাগাররা কাজ করতে ঢাকা ও চিটাগাং চলে গেছে। মোগো যদি এহন নিত্য কাজ দেয় তাহলে খেটে পরে জীবন বাছবে’।
একই গ্রামের শাহজাহান খান ও রিপন হাওলাদার বলেন, ছেলে-মেয়ে ও ভাই সিডরে হারাইছি। নদী ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি-জায়গা জমি সব গেছে। এহন ভূমিহীন হয়ে রাস্তার পাশে থাকতে হয়। যদি কমংস্থানের সুযোগ হইতো তাহলে জমি কিনে থাহার ঘর বানাইতাম। মোগো এহন সাহায্যে লাগবে না, কাজ করার জায়গা কইর্যা দিবে সরকার। এভাবে অনেক পরিবার এখন কর্মসংস্থানের জন্য তাকিয়ে আছে ওই এলাকার মানুষ।
সাউথখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, সিডরে তার ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি লোক মারা গেছে। এবং সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। স্বজন হারানো এ জনপদের মানুষের প্রাণের দাবি বসবাসের জন্য একটু ঘর ও টেকসই বেড়িবাঁধ। জনসংখ্যা অনুপাতে হয়নি সাইক্লোন শেল্টার।
ভোলা
হাসিব রহমান, ভোলা থেকে জানান, ভেলুমিয়া গ্রামের বজলু মাঝি। স্ত্রী পাঁচ মেয়ে নিয়ে সুখেই কাটছিল তাদের সংসার। মাছ ধরে তার সংসার চলত। অভাব অনটনের মধ্যেও ছিল তার ছোট ছোট স্বপ্ন। সন্তানদের পড়ালেখা শেখাবে। নতুন ঘর তুলবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ পূরণ হলো না। সিডরের ঝড় তার সব কেড়ে নিয়েছে। ঝড়ের আগে জসিম মাঝির ট্রলার নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। কিন্তু আজও ফিরে আসেনি। বজলুর স্ত্রী মনোয়ারা স্বামীর ভিটেমাটিতেই পড়ে আছে। যদি কোন দিন তার স্বামী ফিরে আসে। তার পাঁচ মেয়ের মধ্যে ২ জনকে পরের বাড়িতে কাজ করে বিয়ে দিয়েছেন। অভাব অনটনে কোন রকমে চলে তাদের সংসার। বজলুর মতো এ রকম ৯ জেলে সিডরের ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তারা ফিরেনি। নিখোঁজ এসব জেলে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তা জানে না পরিবারের সদস্যরা। তবে তাদের পরিবারের সদস্যরা আজও তাদের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। প্রিয়জনের কথা মনে করে কেঁদে ওঠে স্বজনরা। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের না পেয়ে এসব পরিবারে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। স্বামী, সন্তান আর ভাইকে হারিয়ে অভাব অনাটনে তাদের দিন কাটছে।
নিখোঁজ নুরউদ্দিনের বোন মমতাজ বলেন, তার ২ ভাই। নুরউদ্দিন ছিল সবার ছোট। ঝড়ের ৭ দিন আগে সাগরে মাছ ধরতে যায়। কথা ছিল ভাই মাছ ধরে বাড়ি এলে তাকে বিয়ে করাবে। কিন্তু ভাই আজও ফিরে আসেনি। তাদের বিশ্বাস ভাই একদিন ফিরে আসবে। নিখোঁজ ৯ জেলে পরিবারের এমন করুণ গল্প আজও তাদের কাঁদায়।
কলাপাড়া
মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে জানান, প্রকৃতির বুলডোজার সুপার সাইক্লোনখ্যাত ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াল তা-বের কথা কলাপাড়ার মানুষ আজও ভুলতে পারেনি। আট বছর পরও কলাপাড়ায় চার সহস্রাধিক পরিবার বেড়িবাঁধের বাইরে ঝুপড়িতে চরম ঝুঁকিতে বসবাস করছে। এছাড়া যাদের পুনর্বাসিত করা হয়েছিল তারও দুই-তৃতীয়াংশ ঘর বাস অযোগ্য হয়ে গেছে। নতুন করে বেড়েছে গৃহহারা পরিবার।
২০০৭ সালে সিডরের ভয়াল তা-বে কলাপাড়ায় ৯৪ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আজও নিখোঁজ রয়েছে সাত জেলে ও এক শিশু। আহত হয়েছে ১৬৭৮ জন। এর মধ্যে ৯৬ জন প্রতিবন্ধী হয়ে গেছে। বিধবা হয়েছে ১২ গৃহবধূ। এতিম হয়েছে ২০ শিশু। সম্পূর্ণভাবে ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে ১২ হাজার নয়শ’ পরিবার। আংশিক বিধ্বস্ত হয় ১৪ হাজার নয়শ’ ২৫ পরিবারের। তিন হাজার দুইশ’ ২৫ জেলে পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রকৃতির ওই কালো থাবায় শতকরা ৯০ ভাগ পরিবার ক্ষতির শিকার হয়। এর মধ্যে ৫৪৭৩টি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। ৫৪০ পরিবারের মধ্যে ব্যারাক হাউস নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে পাঁচ বছর আগে। কিন্তু এসব ব্যারাকের অন্তত ৩০০ কক্ষে কেউ থাকছে না। ব্যারাক হাউসের চাল বেড়া পর্যন্ত চুরি হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত আরও চার সহস্রাধিক পরিবার আজ পর্যন্ত ঘর পায়নি। আদৌ আর কখনও পাবে কিনা তা খোদ সরকারের মহল থেকে নিশ্চিত করতে পারেনি। বসতঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ১২ হাজার পাঁচশ’ ১৬ পরিবারের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া তিন হাজার, আড়াই হাজার, দুই হাজার এবং এক হাজার টাকা করে আরও ছয় হাজার সাতশ’ পরিবারকে গৃহ নির্মাণে সহায়তা দেয়া হয়। গৃহ নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে সহায়তা দেয়া হয়েছে আরও অন্তত সাত হাজার পরিবারকে। খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে অধিকাংশ পরিবারকে। এ খবর সরকারের বিভিন্ন সূত্রের। তারপরও সম্পূর্ণ এবং আংশিক বিধ্বস্ত চার সহস্রাধিক পরিবার আজও মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এরা বেড়িবাঁধের বাইরে ঝুপড়ি তুলে সন্তান পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছে।