ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিংহ রাজা শিয়াল মন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১৪ নভেম্বর ২০১৫

সিংহ রাজা শিয়াল মন্ত্রী

বনের রাজা সিংহ। যেমন তার শক্তি-সাহস, তেমনই ক্ষমতা। বনের সব প্রাণী তার কথামতো চলে। ওঠ-বসে। রাজার কথা অমান্য করলেই ভয়ঙ্কর শাস্তি। শাস্তির ভয়ে সবাই সাবধানে থাকে। রাজার আইনের একচুলও নড়চড় করে না। সমস্যা হলো, বনের ছোট ছোট প্রাণীগুলোকে রাজা তেমন একটা ভালবাসে না। ওদের প্রতি দয়া-মায়া নেই বললেই চলে। ওদের অভাব-অভিযোগ শুনতেই চায় না। ছোট হলেও ওরা তো বনেরই বাসিন্দা। রাজারই প্রজা। প্রজাদের সুখ-দুঃখের খবর রাজা যদি না রাখে, তাহলে কি রাজ্যে শান্তি থাকে? থাকতেই পারে না। বাঘ, ভালুক আর হাতি হলো রাজার তিন মন্ত্রী। মন্ত্রীরা সিংহরাজার খুবই প্রিয়। প্রয়োজন হলেই রাজদরবারে ডেকে আনে। মিটিং করে। কিভাবে রাজ্য পরিচালনা করা যায়- সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে। দামী-দামী খাবার খেতে দেয়। আনন্দ-ফুর্তির ব্যবস্থা করে। কিন্তু ছোট ছোট প্রাণীদের কথা রাজার মনেই থাকে না। ওদের রাজদরবারে প্রবেশ করার সুযোগও নেই। রাজার পরেই তিন মন্ত্রীর ক্ষমতা। রাজার অনুপস্থিতিতে রাজ্য চালায়। বনের প্রায় সবটুকু অধিকার তারাই ভোগ করে। যেমন রাজা, তেমন মন্ত্রী। ছোট প্রাণীদের প্রতি মন্ত্রীদের একটুও দয়া-মায়া নেই। ওরা যেন বানের জলে ভেসে এসেছে। বনবিড়াল, বেজি, খরগোশ শিয়ালেরা বনে খাবার সংগ্রহ করতে গেলেই বাঘ-ভালুক-হাতিরা বাধা দেয়। হামলা করে। মেরে ফেলতে চায়। বনের যত ফল-মূল, খানা-দানা, সবই মন্ত্রীদের কব্জায়। এদিকে ছোট ছোট প্রাণীদের জীবন যায় যায় অবস্থা। ক্ষুধার জ্বালা সইতে সইতে শরীর শুকিয়ে কাঠ। শাস্তির ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না। রাজদরবারে গিয়ে অভিযোগ পেশ করার অধিকারও নেই। তাছাড়া, ভয়াল সিংহের মুখে কে বা প্রাণটা তুলে দিতে চায়? শেষে অন্য কোন পথ না পেয়ে ছোট ছোট প্রাণীরা মিলেমিশে শিয়ালের কাছে গেল। বলল, শুনেছি তোমার খুব বুদ্ধি। ভেবে-চিন্তে দেখ তো, রাজার কাছ থেকে আমাদের অধিকার আদায়ের কোন উপায় খুঁজে পাও কি-না। শিয়াল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, হুঁম, আমি অনেকদিন ধরেই এ ব্যাপারে ভাবছি। কেননা, আমিও তো তোমাদেরই দলে। কোন চিন্তা কর না। একটা বিহিতব্যবস্থা হবেই। শিয়াল বংশের চৌদ্দ পুরুষ বুদ্ধির জোরেই কঠিন কঠিন সমস্যা সমাধান করে গেছে। আমিও পারব। শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছি। রাজাকে দেখিয়ে দেব। শুধু বাঘ, ভালুক, হাতিরাই উপকারে আসে না, ছোটরাও উপকারে লাগে। শিয়ালের কথা শুনে বনবিড়াল বলল, শিয়াল পণ্ডিতের জয় হোক। বেজি ও খরগোশ বলল, শিয়াল তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সঙ্গে। শিয়াল আরও উৎফুল্ল হয়ে বলল, আমি তোমাদের সমস্যা সমাধান করবই, করবই। মাত্র কয়েকটা দিন তোমরা বাঘ-ভালুক-হাতির চোখ এড়িয়ে জীবনযাপন কর। সুদিন আমাদের আসবেই। বুনোপথে কাঁটাময় ঝোপ-জঙ্গল ঠেলে ঠেলেই সিংহরাজার চলাফেরা। একদিন হঠাৎ কাঁটা ফুটল সিংহের পায়ে। সে কী ব্যথা! ব্যথার জ্বালায় পা ফুলে কলাগাছ। উহ্... আহ্... ককাতে লাগল রাজা। জ্বর এসে গেল শরীরে। খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। হয়ে পড়ল ভীষণ অসুস্থ। অনেকবার চেষ্টা করেও কাঁটা তুলতে পারছে না। কী মুশকিল! সারা বনে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। পৌঁছে গেল শিয়ালের কানেও। সিংহ কাঁটা তুলতে না পেরে প্রথমে বাঘকে ডেকে আনল। বাঘ কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলল, হয়ত আপনার পা-টাই কেটে ফেলতে হবে রাজা। চিন্তা আরও বেড়ে গেল সিংহের। পা কেটে ফেললে আমি হাঁটব কেমন করে? রাজ্যটা দেখাশোনা করবে কে? এবার কাঁটা তুলতে ভালুককে ডাকল। ভালুক কাঁটা তুলে দেবে তো দূরের কথা, ফুলে কলাগাছ হওয়া পা দেখে ভয়েই অস্থির। বলল, হে রাজা, অপরাধ নেবেন না। হয়ত আপনার পায়ে পচন ধরে গেছে। আপনাকে বাঁচানোই কঠিন। ভালুকের কথা শুনে সিংহের চোখ-মুখ চিন্তায় শুকিয়ে একেবারে শুঁটকিমাছ। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তোমরা হাতিকে ডাকো। হাতিই পারবে কাঁটা তুলে দিতে। নাদুস-নুদুস শরীর নিয়ে হেলে-দুলে হাতি এলো। বলল, হে রাজা, আমার একটা শুঁড় আছে। এটা দিয়ে প্যাচ মেরে গাছ উপড়ে ফেলা সম্ভব। কিন্তু কাঁটা তোলার মতো সূক্ষ্ম কাজ করা তো সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, আমার দাঁত দিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু দাঁতগুলো তো অনেক শক্ত আর মোটা। খোঁচা দিলে আপনার পা-টা যদি ভেঙ্গে যায়! হাতির কথায় ভরসা না পেয়ে খুবই মর্মাহত হলো সিংহরাজা। নিরুপায় হয়ে চিৎকার করে বলল, এই, কে আছ? আমাকে বাঁচাও! বাঁচাও! রাজার বাড়ির পাশেই ঝোপে লুকিয়েছিল শিয়াল। চিৎকার শোনা মাত্র একটা ঝুলি গলায় ঝুলিয়ে সিংহরাজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মনে মনে বলল, আমি তো এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম। তারপর রাজাকে বলল, হে সিংহরাজা, আপনার আর কোন চিন্তা নেই। আপনি শান্ত হন। আমি বাঘ, ভালুক ও হাতির চেয়ে আকারে ছোট। কিন্তু বুদ্ধিতে বড়। আমিই পারব কাঁটা তুলে দিতে। সিংহ শিয়ালকে বলল, এই বিপদের মুহূর্তে তুমি কি আমার সঙ্গে তামাশা করছ? বাঘ-ভালুক-হাতি পারল না, তুমি পারবে এই কাজ? শিয়াল বলল, আপনার পা-টা আমার দিকে এগিয়ে দিন রাজা। দেখুন, পারি কি-না। সিংহরাজা পা এগিয়ে দিল। শিয়াল তার ঝুলি থেকে প্রথমে বের করল একটা শাবল। বলল, এটা শক্ত, মোটা ও লম্বা একটি লৌহদ-। এক মাথা চ্যাপ্টা। এই যন্ত্র খোঁড়াখুঁড়ির কাজেই ব্যবহৃত হয়। এর মাধ্যমেই আপনার পায়ের কাঁটা খুঁচিয়ে বের করব। কী বলেন রাজা? সিংহ চেঁচিয়ে উঠল। এ কী বলছ তুমি? এই শাবল দিয়ে খোঁচা দিলে আমার পা যে ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে! শিয়াল বলল, হ্যাঁ, রাজা, আপনি ঠিকই বলেছেন। শাবল দিয়ে কাঁটা তোলা সম্ভব নয়। কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হয়। তারপর শিয়াল তার ঝুলি থেকে বের করে আনল একটা খেজুর কাঁটা। খেজুর কাঁটার সাহায্যে দু’তিন মিনিটেই সিংহের পা থেকে কাঁটা তুলে ফেলল। খুব আরাম পেল সিংহ। খুশি হয়ে বলল, হে বুদ্ধিমান শিয়াল, বলো, তুমি কী চাও? শিয়াল বলল, আমি কিছুই চাই না। আপনি অনুমতি দিলে একটা কথা বলতে চাই। -একটা কেন? হাজারটা কথা বলো। আমি ধৈর্য ধরে শুনব। -দেখুন রাজা, এই শাবলটা অনেক বড়। শক্ত ও মোটা। আর এই খেজুর কাঁটা খুবই ছোট্ট। বড় যন্ত্রটি দিয়ে কাঁটা তোলা সম্ভব হলো না। কিন্তু ছোট্টটি দিয়েই সম্ভব হলো। বাঘ-ভালুক-হাতিকে নাদুস-নুদুস শরীর ও শক্তি দেখে আপনি মন্ত্রী বানিয়েছেন। আজ তারা আপনার কোন উপকারই করতে পারল না। আর বনের ছোট ছোট প্রাণী, যাদেরকে আপনি ভালবাসেন না। তাদের দলেরই একজন আমি শিয়াল। আপনার পায়ের কাঁটা তুলে দিয়ে মস্তবড় বিপদ থেকে আপনাকে রক্ষা করলাম। প্রমাণ পাওয়া গেল, ছোটরাও উপকারে লাগে। সিংহরাজা বলল, হে বুদ্ধিমান শিয়াল, তুমি আমার ভুল ভেঙ্গে দিয়েছ। কথা দিচ্ছি, আজ থেকে ছোট ছোট প্রাণীদের আমি বেশি বেশি ভালবাসব। আজ থেকে তুমি আমার একমাত্র মন্ত্রী। অথর্ব তিন মন্ত্রীকে আমি ঝেটিয়ে বিদায় করব। এতদিন দামী-দামী খাবার খাইয়ে বোকা বাঘ-ভালুক-হাতি পুষেছি। এর চেয়ে ছাগল পুষলেও ভাল হতো। সিংহ রাজার কথায় শিয়াল তো মহাখুশি। লেজ নাচিয়ে নাচিয়ে, ঠ্যাং দুলিয়ে দুলিয়ে বলল, আপনি খাঁটি কথাই বলেছেন রাজা। ছাগল পুষলেও মন্দ হতো না। ছাগল যে আমার বড্ড প্রিয় খাবার, হেঃ হেঃ হেঃ।
×