ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লোক গানে মাতোয়ারা দর্শক

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৪ নভেম্বর ২০১৫

লোক গানে মাতোয়ারা দর্শক

গৌতম পাণ্ডে ॥ বিকেল থেকে রাত গভীর হচ্ছে কিন্তু গান শোনার আকাক্সক্ষা যেন কমছে না শ্রোতাদের। শিল্পীরা একের পর এক লোকগানের আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছেন পুরো আর্মি স্টেডিয়াম জুড়ে। কোন কোন সময়ে অস্থির হয়ে শ্রোতাদের বলতে শোনা যায়, আরও গান চাই আরও গান। লালন সাঁইজির গানের শিল্পী ফরিদা পারভীন একে একে গেয়েছেন ‘পারে লয়ে যাও আমায়’, ‘মিলন হবে কতদিনে’ এবং ‘সময় গেলে সাধন হবে না।’ অনুষ্ঠানে তাঁকে সম্মাননা স্মারকও প্রদান করা হয়। শিল্পী কিরন চন্দ্র রায় ও চন্দনা মজুমদার দম্পতি মঞ্চে উঠলে মুহূর্তের মধ্যে লোক গানের এক ভিন্ন আবহ তৈরি হয়। চন্দনা গেয়েছেন ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’, শাহ আবদুল করিমের ‘সোনাবন্ধু ভুইলো না আমারে’ এবং রাধারমণ দত্তের ‘ও জলে যাইয়ো না’। তারপর কিরণ চন্দ্র রায় গেয়ে শোনান ‘আয় দেখে যা জগৎবাসী বাংলাদেশ ঘুরে’, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ এবং কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক গান ‘অন্তরে বৈরাগীর লাউয়া বাজে’। মঞ্চে আসেন ভারতের শিল্পী অর্ক মুখার্জি। লম্বা চুল-দাড়িতে ঢাকা চেহারা। যেমন ভারি শরীর তেমনি গম্ভীর কণ্ঠ। যতক্ষণ অর্কর গান ছিল, কথা ছিল, যন্ত্রসঙ্গীত বেজেছে; স্টেডিয়াম যেন ফেটে পড়তে চেয়েছে দর্শকদের উচ্ছ্বাসে-আবেগে। দর্শক মাতানোর এক অদ্ভুত কৌশল তাঁর কণ্ঠে। দু’জন সঙ্গী নিয়ে তিনি মঞ্চে ওঠেন। এসেই ‘হাই-হ্যালো’র সুরে, ‘বাংলাদেশ, ভালো আছো?’ এরপরের কথায় কণ্ঠে পর্যাপ্ত বিনয়, যে স্টেজে ফরিদা পারভীনের মতো শিল্পী, সাঁই জহুরের মতো শিল্পী, পবন দাশ বাউলের মতো শিল্পীরা অনুষ্ঠান করেন; সেই পাড়ার বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ানোর অধিকারও আমার নেই। এমন বিনয় তো প্রকৃত শিল্পীদের কণ্ঠেই মানায়। সবাই তাই মুহূর্ত গোণে কখন অর্ক তার কণ্ঠ ছড়িয়ে দেবেন রাতের আকাশে! তিনি ঠোঁটে রাখলেন কাজু নামক যন্ত্র, সুর তুললেন তাতে। হাজার দর্শকের চিৎকার একটা কোরাস তুলে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছড়িয়ে গেল। শুরু করলেন প্রভাতী গান দিয়ে, এরপর গুজরাটি ফোক, ‘সে এক রসিক পাগল’, ‘বিয়াতে আইসাছে পালকি’, ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে’, মাঝে একটি ফরাসী ফোকও শুনিয়ে দিলেন অর্ক। ঢাকা আন্তর্জাতিক ফোক ফেস্ট-এর প্রথম দিন বিদেশী শিল্পীর তালিকায় আরও ছিলেন সাঁই জহুর। তার গানের সময় পুরো মঞ্চ যেন কোন দরগাহ! পবিত্রতা ছড়িয়ে যাচ্ছে! একসময় দরগাহ-মাজারেই গান করতেন সাঁই। পোশাকে-নৃত্যের তালে, এমনকি তিনি যে একতারাটি ব্যবহার করেন, সেটিতেও এনেছেন স্বকীয়তা। সুন্দর করে সাজিয়েছেন। ভারি কণ্ঠে তিনিও মাতিয়ে গেলেন উর্দু সুফিতে। প্রথমদিনের আয়োজনে একেবারে শেষ শিল্পী হিসেবে মঞ্চে ওঠেন পাপন। সঙ্গে তার ব্যান্ড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তার নাম ঘোষণার পর থেকে গান শুরু হওয়া পর্যন্ত মিনিট বিশেকের অপেক্ষা। এমটিভির কোক স্টুডিওর কল্যাণে পাপনকে চিনতে বাকি নেই কারও। খুঁজে খুঁজে তার প্রত্যেকটি গান শুনে ফেলেছেন, এমন শ্রোতারও অভাব নেই। আসামে জন্ম নেয়া পাপন বাংলা বলতে পারেন ভাঙা ভাঙা। তার সঙ্গে ইংরেজী, হিন্দী মিশিয়ে তিন-ভাষায় প্রয়োজনীয় কথা বলে গেলেন গানের ফাঁকে ফাঁকে। বুঝিয়ে গেলেন কেন এই গান, এই শব্দ, বাক্যের প্রেক্ষাপট, গান-গল্প। পাপনের গানের শেষদিকে গিয়ে দর্শক বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ল, হঠাৎই। একদল উদ্দাম নাচতে নাচতে ছুটে চলে আসতে চাইল মঞ্চের দিকে। একদল সমস্বরে বলে উঠল, আরও আরও গান চাই। কিন্তু ততোক্ষণে যে ঘড়ির কাঁটা রাত একটা পেরিয়ে আরও অনেকটা দূর গড়িয়ে গেছে। পাপন তাই ‘দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে’, ‘ও মেঘ কেন চলে যাও’, ‘কে তোকে নজরি লাগায়’, ‘দমাদম মাস্ত কালান্দার’সহ আরও ক’টা গান গেয়ে বিদায় নিলেন। এবারই ছিল পাপনের প্রথম বাংলাদেশ সফর। মেরিল নিবেদিত এবং মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টস আয়োজিত এ ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট আজ শেষ হচ্ছে।
×