ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রামপালে বিবর্ণ জীববৈচিত্র্য

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৪ নভেম্বর ২০১৫

রামপালে বিবর্ণ জীববৈচিত্র্য

বাবুল সরদার, বাগেরহাট ॥ ধান-পান, নারকেল-সুপারি মিলিয়ে ফল-ফসলে গাঢ় সবুজের জনপদ রামপাল এখন বিবর্ণ। সুন্দরবনের কোল-ঘেষা বাগেরহাটের ২৭৬.৪৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলায় নদী খালের সংখ্যা ২০৫টিরও বেশি। স্বাভাবিকভাবেই এখানে সবুজের সমারোহ থাকার কথা। ছিলও তাই। রামপালকে বলা হতো ফসলের গোলা। কিন্তু গত তিন দশকে এ চিত্র পাল্টে গেছে। এখন সবুজ হারিয়ে গেছে। মাঠে ফসল নেই, গোলা ভরা ধান নেই, গোয়াল ভরা গরু নেই, বরজে পান নেই, বাগানে নেই নারিকেল-সুপারি। মরে যাচ্ছে গাছপালা, কমে গেছে চাষের জমি। সবুজে ঘেরা সেই প্রকৃতি এখন নোনা রুক্ষতায় ধুঁকছে। জনসংখ্যাও ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এই চিত্র। তবে সবুজে ঘেরা প্রকৃতির এমন বিপর্যস্থ রূপ যে এক দিনে হয়নি, তা জানা গেলো স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে। উপজেলার বাঁশতলী ইউনিয়নের চন্ডিতলা গ্রামের শেখ ফজলে আলী ও শেখ ইসাক আলী জানান, গত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে প্রকৃতির এমন বিরূপ চিত্র। ৩০-৪০ বছর আগে এখানকার মানুষের জীবিকা চলত ক্ষেত কৃষিতে। এখন লবণাক্ততা মারত্মক বেড়ে যাওয়ায় মাঠে ফসল ফলছে না, গাছপালাও মরে যাচ্ছে। কমে গেছে নারকেল, সুপারি, পানসহ এ অঞ্চলের প্রায় সব ফলের উৎপাদন। এমনকি লবণ সহিষ্ণু তাল পর্যন্ত কমে যাচ্ছে। রামপাল উপজেলা পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল জলিল মনে করেন, ১৯৭৯-৮০ সাল থেকে লবণ পানি আটকে এই অঞ্চলে শুরু হওয়া চিংড়ি চাষের প্রভাবেই এখনকার জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। জীবিকার সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। জীবন বাঁচাতে মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। পাখিদের সেই কলকাকলিও যেন হারিয়ে গেছে। ইসলামাবাদ গ্রামের ভ্যানচালক রউফ শেখ মনে করেন, লবণাক্ততার কারণেই বিরান হয়ে যাচ্ছে রামপাল। বাঁধের কারণেই এমন দশা। বাঁধ দিয়ে নোনা পানি আটকে চিংড়ি চাষ হয় এখানে। গত প্রায় ৩৫-৩৬ বছর থেকে এভাবে লবণ পানি আটকে রাখার কারণে তৈরি হয়েছে এই ভয়ঙ্কর অবস্থার। চন্ডিতলা গ্রামের সত্যেন্দ্রনাথ মিস্ত্রির ছেলে গৌরঙ্গ মিস্ত্রি বলেন, ‘আমার বয়স যখন ১৪-১৫ বছর তখনও এ এলাকায় কোন নোনা ছিল না। বছরে একবারই আমন ধান হতো। এক বিঘা জমিতে তখন ৬০-৭০ মণ ধান উৎপাদন হতো। বছরের খোরক হয়েও তখন ৫০ মণ ধান বিক্রি করতে পারতাম। একশ’র মতোন নারকেল গাছ এবং সুপারির বাগান ছিল। প্রচুর ফলন হতো। এখন নোনার কারণে তা মরে যাচ্ছে, আর যা আছে তাতেও কোন ফলন হয় না। আম-জাম-কাঁঠাল তো কবেই হারিয়ে গেছে।’ তার মতে, তখন কোন বাঁধ ছিল না, নোনা পানিও আটকে থাকত না। যে গতিতে পানি আসত সেই গতিতে নেমে যেত। নদী খালে জোয়ার-ভাটা ছিল। আর নদীর পানির সঙ্গে যে টুকু নোনা আসত বর্ষা মৌসুমে তা ধুয়ে যেত। নোনা পানি আটকে চিংড়ি চাষ বন্ধ, নদী-খাল আটকে বিভিন্ন সময় তৈরি সকল বাঁধ অপসারণ এবং নদীকে নাব্য করতে খনন ও নদী তীরে প্লাবন ভূমি রক্ষা করা গেলে আবারও এই অবস্থা থেকে মুক্তি মিলতে পারে বলে মনে করেন গাববুনিয়া গ্রামের শেখ রুহুল আমীন। কোস্টাল ডেভলপমেন্ট পার্টনারশিপর (সিডিপি) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী ইকবাল হোসের বিপ্লব জানান, অপরিকল্পিত বাঁধের কারণে গত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যে চিংড়ি চাষের জন্য বাঁধ দিয়ে নোনা পানি আটকে রেখে আজ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে, অতিরিক্ত লবণাক্ততায় সেই চিংড়ি চাষেও বিপর্যয় নেমে আসছে। ক্রমশ চিংড়ির উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার রামপাল উপজেলায় দুই শতাধিক খালের অধিকাংশই গত প্রায় ৩০ বছর ধরে ছিল অবৈধ দখলদারদের দখলে। যার একটি বড় অংশ ভরাট হয়ে গেছে। বাকিগুলোতে বাঁধ দিয়ে আটকে মাছের চাষ করছে প্রভাবশালীরা। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, অনেক সরকারী খালের জমি বিভিন্ন সময়ে বেআইনীভাবে ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডভুক্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি স্থানীয় প্রশাসনের নিয়মিত তদারকির অভাবে সরকারী রেকর্ডভুক্ত খালগুলোকে দখলমুক্ত ও প্রবাহমান করা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশে গত ৫ আগস্ট থেকে দখল খালগুলো আবারও তালিকা তৈরি করে মাঠে নামে জেলা প্রশাসন। বাগেরহাট জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, মোট ৮২টি খাল চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে খালগুলোর সকল বাঁধ অপসারণ করা হচ্ছে। রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিব কুমার রায় জানান, এসব খালে যেন আর কেউ বাঁধ দিতে না পারে সে ব্যাপারে মনিটরিং চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমান জানান, দখলের ফলে ভরাট নদী খাল পুনরুদ্ধারে তারা প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর আলম জানান, বাঁধ অপসারণ এবং সরকারী রেকর্ডভুক্ত এসব খালের নাব্য ফিরিয়ে আনতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেলা প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। খাল দখলমুক্ত রাখতে খাল পাড়ে রাস্তা/বেড়ি নির্মাণ ও গাছ লাগানো হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এই কাজ শেষ হলে আবারও স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে বলে তিনি আশাবাদী।
×