ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মেঘনা-গোমতী ও মেঘনা সেতু

টোল আদায়ে নীতিমালা লঙ্ঘন করে চলছে নানা অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৪ নভেম্বর ২০১৫

টোল আদায়ে নীতিমালা লঙ্ঘন করে চলছে নানা অনিয়ম

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতুতে টোল আদায় নিয়ে চলছে নানা অনিয়ম। সেতুর টোল আদায়ের দায়িত্ব সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের। বাস্তবে মন্ত্রণালয়ের টোল নীতিমালা পুরোপুরি লঙ্ঘন করে টোল আদায় করছে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমস লিমিটেড (সিএনএস) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কোন রকম চুক্তি বা কাজের বৈধতা ছাড়াই দুই মাস এই প্রতিষ্ঠানটি টোল আদায় করছে। বিভিন্ন পরিবহন থেকে টোলের নামে বাড়তি অর্থ আদায়ের অভিযোগ আছে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এদিকে দুটি ব্রিজের পাশে স্থাপন করা ওজন মাপার দুটি যন্ত্রই চালুর পর থেকেই বিকল হয়ে আছে। অতিরিক্ত ওজন নিয়ে সেতু পারাপার হচ্ছে পরিবহনগুলো। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ইতোমধ্যে সেতুর বিভিন্ন অংশ কয়েক দফা মেরামত করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, উচ্চ আদালতে রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে টোলের টেন্ডার প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে। এমন বাস্তবতায় একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে পরীক্ষামূলক কাজ করাচ্ছে মহাসড়ক বিভাগ। পরোক্ষভাবে বাড়তি টোল আদায়ের অভিযোগও স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্টরা। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের টোল নীতিমালা-২০১৪ অনুযায়ী অপারেশন এ্যান্ড মেইন্টেন্যান্স (ওএ্যান্ডএম), ইজারা ও বিভাগীয় এই তিন পদ্ধতিতে টোল আদায় নির্ধারণ করা হয়েছে। মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায় হয় ওএ্যান্ডএম পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতিতে টোল আদায়ে অপারেটর নিয়োগ করতে হয়। নীতিমালা অনুযায়ী অপারেটর উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির মাধ্যমে পাঁচ বছরের জন্য ফির ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। ওএ্যান্ডএম পদ্ধতিতে পরিচালিত টোল বিভাগীয় ও ইজারা পদ্ধতিতে পরিচালনার কোন সুযোগ নীতিমালায় নেই। চলতি বছরের ১ অক্টোবর থেকে সিএনএস নামক প্রতিষ্ঠানটি সেতু দুটির টোল আদায় করলেও তাদের উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে নিয়োগ করা হয়নি। এমনকি তাদের সঙ্গে সড়ক ও জনপথের কোন চুক্তিও হয়নি। নীতিমালায় ওএ্যান্ডএম পদ্ধতিতে আদায়কৃত টোল সংশ্লিষ্ট অপারেটর পরবর্তী ব্যাংকিং কার্যদিবসে পে-অর্ডার/ডিমান্ড ড্রাফ্টের মাধ্যমে নির্দিষ্ট হিসাবে জমা দেয়ার বিধান আবশ্যিক করা হয়েছে। কিন্তু মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতুর গত ১, ২ ও ৩ অক্টোবর আদায়কৃত অর্থ ৫ অক্টোবর এবং ৪ ও ৫ অক্টোবরের আদায়কৃত অর্থ ৭ অক্টোবর ব্যাংকে জমা দিয়েছে। এতে টোল নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিভাগীয়ভাবে টোল আদায় করা হলে নীতিমালা অনুযায়ী দৈনিক আদায়কৃত টোলের অর্থ পরবর্তী দিন ব্যাংকিং সময়ের মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের উপ-বিভাগীয় কার্যালয় পরিচালিত ব্যাংকের নির্ধারিত হিসাবে জমা করার বিধান করা হয়েছে। অথচ মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতুতে টোল আদায় কার্যক্রম পরিচালনায় টোল আদায় নীতিমালার কোন বিধানই মানা হচ্ছে না। এতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায়ের উৎস মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতুতে টোল আদায়ের আর্থিক কার্যক্রম গুরুতর অনিয়মের মধ্যে পড়েছে। টোল আদায়কারী বর্তমান অপারেটরের সঙ্গে কোন চুক্তি না থাকায় টোলের আদায়কৃত অর্থ আত্মসাৎ করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এছাড়া সড়ক ও জনপথের তথ্য অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ের স্মারক নম্বর মোতাবেগ ১ অক্টোবর মধ্যরাত ১২টা ১ মিনিট থেকে মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতুর উভয় স্থানে ওভারলোড কন্ট্রোল মেশিনের দ্বায়িত্বও সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের নারায়গঞ্জ সড়ক বিভাগ গ্রহণ করে। এরপর থেকেই ওভারলোড কন্ট্রোল মেশিন দুটি বন্ধ রয়েছে। ফলে দুটি সেতু দিয়েই ভারি যানবাহন দেদার চলাচল করছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে ওই সেতু দুটি। টোল আদায় নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ ॥ টোল আদায়কারী সিএনএস টেকনোলজি নামের ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে টোল আদায়ের অভিযোগ এনে ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান হাইকোর্টে রিট পিটিশনও দাখিল করেছে। জানা যায়, ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর দাউদকান্দি টোল প্লাজায় স্থাপন করা হয় ওভারলোড কন্ট্রোল স্টেশন। বর্তমানে মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী ব্রিজের ওভারলোড কন্ট্রোল স্কেল বন্ধ থাকায় যেসব অতিরিক্ত মালবোঝাই যানবাহন ফেরত যেত, দায়িত্বরতরা অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে সেসব যানবাহন নির্বিঘেœ চলাচল করতে দেয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে এ সেতু দুটি। সূত্র জানায়, শুধু ওভারলোড কন্ট্রোল স্কেল অচল এমনটি নয়, ইচ্ছাকৃতভাবে অচল করে রাখা হয়েছে। মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতুর কম্পিউটার কন্ট্রোল রুমের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় কখনও রসিদে আবার কখনও বিনা রসিদে দুটি টোল প্লাজার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিএনএসের লোকজনকে নিজেদের ইচ্ছামতো অতিরিক্ত টোল আদায় করতে দেখা গেছে। দুই বছর আগে ৪৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মেরামত করা হলেও বর্তমানে নির্বিঘেœ ভারি যানবাহন চলাচলের কারণে ব্রিজ দুটি আবারও হুমকির মুখে পড়েছে। যানবাহনের কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা হলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, টোল আদায়ের নামে এ দুটি সেতুকে ঘিরে রীতিমতো অর্থের লোপাট চলছে। তারা জানান, বর্তমানে ট্রেইলর ১ হাজার ২৫০ টাকার স্থলে ১৫-১৬শ’ টাকা, থ্রি-এক্সেলের হেভি ট্রাক ৫শ’ টাকার স্থলে এক হাজার ২৫০ টাকা, মিডিয়াম ট্রাক ১৯০ টাকার স্থলে ৫শ’ টাকা, থ্রি-এক্সেলের বাস ৪৫০ টাকার স্থলে ১ হাজার ২৫০ টাকা, মিনিট্রাক ৯০ টাকার স্থলে ১৯০ টাকা, মিনিবাস ১৮৫ টাকার স্থলে ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস ও জীপ ৯০ টাকার স্থলে ১০০ টাকা, প্রাইভেটকার ৬৫ টাকার স্থলে ৯০ কখনও রসিদে কখনও বিনা রসিদে আদায় করছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ি থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ আদায় করা হয়। কখনও কখনও বড় বড় গাড়ির ক্ষেত্রে ‘নো রেজিস্ট্রেশন’ লিখে বাড়তি টাকা নেয়া হচ্ছে। জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী সামসুদ্দিন বলেন, কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণকক্ষ এবং ওভারলোড কন্ট্রোল স্কেল নিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মেঘনা ব্রিজ টোল প্লাজার ম্যানেজার মেজর (অব) জিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, টোলের টেন্ডার প্রক্রিয়া উচ্চ আদালতে রিটের প্রেক্ষিতে স্থগিত থাকায় সিএনএস কোম্পানিকে অটোমেশনের কাজ দেয়া হয়েছে। তাদের এই কার্যক্রমের বৈধতা সম্পর্কে তিনি সঠিক যুক্তি তুলে ধরতে না পারলেও বলেন, সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের বসানো হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি টোল প্লাজার স্থাপন করা নতুন ওয়েস্কেল মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে বাড়তি কত টাকা আয় করা সম্ভব এ নিয়ে কাজ করছে। বাস্তবতা হলো, তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে টোল আদায়ের কাজ দেয়া হয়নি। বাড়তি টোল নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, এই অভিযোগ কেউ প্রমাণ করতে পারলে কাজ ছেড়ে দেব। তবে ১০ চাকার ট্রাক ও বিশাল বডির গাড়ির ক্ষেত্রে বাড়তি অর্থ রাখার কথা নিজেই স্বীকার করে বলেন, এসব পরিবহন বিআরটিএ’র তালিকাভুক্ত হলেও টোল নির্ধারণের বিষয়টি চূড়ান্ত নয়। তবে বেশিরভাগ পরিবহন থেকে সরকার নির্ধারিত রেটের বেশি রাখার সুযোগ নেই বলে দাবি এই কর্মকর্তার। তিনি বলেন, এই টোল প্লাজা থেকে গড়ে প্রতিদিনের আয় প্রায় ৭৭ লাখ টাকা। ৮১ লাখ টাকা উত্তোলনেরও রেকর্ড আছে। ২০১৪ সালে নতুন টোল নীতিমালা সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা হয়। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে টোল বৃদ্ধি করে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এতে ৫০ টাকার গাড়ি ৬৫ টাকা ও ৭০ টাকার গাড়ি ৯০ টাকাসহ প্রকারভেদে টোল বাড়ানো হয়। বাস্তবতা হলো, নতুন করে টোল বাড়ানো হয়নি। সরকারী রেটে টোল আদায় করা হচ্ছে।
×