ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিকোলাস স্পার্কসের ‘সী মি’ বইটি নিয়ে ;###;লিখেছেন আরিফুর সবুজ

সী মি

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১৩ নভেম্বর ২০১৫

সী মি

ভালোবাসার তরেই জীবন। জীবনের তরেই ভালোবাসা। নদীর বহমান স্রোতধারার মতোই ভালোবাসার স্রোত মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় গন্তব্যহীন অসীমতায়। ভালোবাসার তল খুুঁজে পাওয়া যায় না। সেই তল খোঁজারও চেষ্টা করে না কপোত-কপোতীরা। ভালোবাসার মহোমুগ্ধতায় শরীর মনে যখন অদ্ভুত সুখের আঁধার ভর করে, তখন তল খোঁজার মতো সময় যেমন থাকে না, তেমনি মনও। তখন সবকিছু, জীবনের সবকিছুই যেন আবর্তিত হতে থাকে ‘ভালোবাসা’ নামের এই একটি শব্দকে ঘিরেই। অতীতের স্বপ্ন ভালোবাসা পরবর্তী স্বপ্নের কাছে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। আবার ভালোবাসার মধ্যে দিয়েই ঘৃণ্য কিংবা কষ্টকর অতীতকে দুমড়ে-মুচড়ে ছুড়ে ফেলে দিতে চায় প্রেমিক-প্রেমিকরা। অনেকে সহজেই মুছে ফেলতে পারে। ভালোবাসার জোয়ারের কাছে অতীত পাত্তাই পায় না। আবার অনেকের পক্ষে ঠিক এ রকম সম্ভব হয় না। বরং অনেক সময় যন্ত্রণাময় অতীত ভালোবাসার মধুর সময়টাতেও তাড়িয়ে বেড়ায়। তবে তা হতে পারে স্বল্পসময়ের জন্য। যদি কেউ ভালোবাসার অতল সমুদ্রে ডুব দেয়, তাহলে তার পক্ষে অতীত নিয়ে ভাবনার সময় কোথায়? ভালোবাসার সমুদ্রে যে অজস্র নুড়ি, তা কুড়াতেই তো কেটে যাবে জীবনের বাকিটা সময়। খুব বেশি সময় ধরে যদি অতীত তাড়িয়ে বেড়ায় তবে বুঝতে হবে ভালোবাসায় ঘাটতি আছে। ভালোবাসা এত ঠুনকো নয়। তবে ভালোবাসা কোন বাধা মানে না। বরং ভালোবাসার শক্তি এতই প্রবল যে অতীতের সবকিছু ধীরলয়ে মুছে যায়। তবে অতীতকে অস্বীকার করা যায় না। আবার ভালোবাসার মাঝে শুধু অতীত নয়, বর্তমানও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যত বাধাই আসুক না কেন, ভালোবাসার যদি শক্তি প্রবল থাকে দু’জনার মাঝে, বিশ্বাসের বন্ধন যদি থাকে অটুট, তবে ভালোবাসার বাধা হয়ে কোন শক্তিই বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না। নিকোলাস স্পার্কস তাঁর ‘সী মি’ বইটিতে ভালোবাসার এই মহৎ দিকটিই অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কলিন হ্যানককের অতীত মোটেও ভালো নয়। সন্ত্রাসী কর্মকা- করতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। মারামারি কাটাকাটির মধ্যেই আবদ্ধ ছিল তার জীবন। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তেই যেন জেলের দরজা কড়া নাড়ত তার। সেই জীবনে উত্তেজনা ছিল, ভীতি ছিল, ক্ষমতার দম্ভও ছিল। কিন্তু ছিল না ভালোবাসা, ছিল না শান্তি। এক মুহূর্তের জন্যও কলিন সে জীবন উপভোগ করতে পারেনি। তাই নিজের সে জীবন থেকে সরে আসতে চেয়েছিল কলিন। খারাপ কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কলিন কিন্তু লেখাপড়া জানত। তাই যখন তিনি নিজেকে বদলানোর সিদ্ধান্ত নেন, তখন পেশা হিসেবে বেছে নেন শিক্ষকতাকে। তিনি জানতেন, এই পেশার মধ্যে দিয়েই তিনি নিজে শুধরাবেন, ভবিষ্যতে শিশুরা যেন দিকভ্রান্ত না হয়, সেই পথ বাতলে দেবেন। অতীত থেকে নেয়া শিক্ষাই তার জীবনের পাথেয় হয়েছিল। পুরো দস্তুর শুধরে যাওয়া কলিনের জীবন শুদ্ধ পথে ভালোই চলছিল, তবে মনের গহীনে অতৃপ্তি লেগেই ছিল। নিজেকে পূর্ণ ভাবতে পারত না কলিন। কিন্তু যখন মারিয়ার প্রেমে পড়লেন, তখনই আসলে উপলব্ধি করলেন জীবনের প্রকৃত সুখ। কলিনের পুরো হৃদয় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল কানায় কানায়। বেঁচে থাকার সত্যিকার মানে যেন খুঁজে পেয়েছিল কলিন মারিয়ার ভালোবাসায়। কলিনের নষ্ট অতীত মারিয়ার ভালোবাসায় শুদ্ধ হয়ে ওঠে। মেক্সিকান অভিবাসী মারিয়া সানচেজের জীবনকেও বদলে দিয়েছে কলিনের বেপরোয়া ভালোবাসা। মারিয়া ক্যারিয়ারিস্ট মেয়ে। নিজের ক্যারিয়ারের স্বপ্নের মাঝেই বিভোর ছিল মারিয়া। স্বপ্ন পূরণে তাকে প্রচুর লেখাপড়াও করতে হয়েছে। উিউক ল স্কুল থেকে পাস করে মারিয়াকে তাই চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ফিরতে হয়নি। উইলমিংটনের একটি ফার্মে বেশ চমৎকার চাকরিও জুটিয়ে ফেলে মারিয়া। চাকরি জীবন বেশ চলছিল। ক্যারিয়ারে উন্নিতির চিন্তায় মগ্ন মারিয়ার ভালোবাসা নিয়ে কোন চিন্তাই ছিল না। কিন্তু কলিনের আবির্ভাব তার জীবনকেও বদলে দেয়। বৃষ্টিস্নাত একদিনে কলিনের সঙ্গে আকস্মিক এক সাক্ষাতই বদলে দেয় মারিয়ার জীবন। মারিয়া উপলব্ধি করে ক্যারিয়ারের স্বপ্নের চেয়েও ভালোবাসার স্বপ্ন অনেক মধুর। কলিন আর মারিয়া যখন হাতে হাত রেখে আগামী জীবনের স্বপ্ন বুনছিল, যখন পরস্পরের উষ্ণ আলিঙ্গনের মাঝে তারা অসীম সুখ খুঁজে পাচ্ছিল, তখনই তাদের জীবনে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটা শুরু হয়। এ যেন ভালোবাসার পরীক্ষা। মারিয়ার জীবনেও অতীতের দুঃসহ বেদনা আছে। দুঃসহ অতীতই তাকে ঘরছাড়া করেছিল। পরিবারশুদ্ধ তাকে মেক্সিকো থেকে চলে আসতে হয়েছিল আমেরিকায়। সেই দুঃসহ অতীতের ভূতই কলিন আর মারিয়ার ভালোবাসার মাঝে এসে দাঁড়ায়। অতীতে মারিয়ার যে শত্রুর কারণে তাদের ঘরছাড়া হতে হয়েছিল, তার আবির্ভাবই মারিয়াকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। সেই শত্রু অনেক চেষ্টা করে মারিয়ার ক্ষতি করার, মারিয়ার ভালোবাসায় ফাটল ধরানোর। কিন্তু কলিন সেই সময়টাতে মারিয়ার পাশে দাঁড়ায় প্রকৃত প্রেমিক হিসেবে। মারিয়াকে কেবল ভরসাই দেয় না, মারিয়ার সঙ্গে একাত্মা হয়ে শত্রুর রোষানল থেকে মারিয়াকে রক্ষা করে সিনেমার নায়কের মতোই। মারিয়া ও কলিনের গভীর প্রেমের আখ্যানের মধ্য দিয়ে নিকোলাস প্রেমের জয়গান গেয়েছেন এই বইটিতে। তবে বইটিকে কেবল প্রেমের বই বললে ভুল বলা হবে। বইটির প্রথম অর্ধেকজুড়ে প্রেম কাহিনী থাকলেও দ্বিতীয় অর্ধেকে রহস্য, রোমাঞ্চ ভরপুর ছিল। এই অংশটিকে থ্রিলার হিসেবে অভিহিতও করা যেতে পারে। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে কলিন ও মারিয়ার মধ্যে ভালোবাসার যে বন্ধন, পরস্পরকে কাছে পাওয়ার যে আকুতি, তাই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ভালোবাসার শক্তি যে কত বড় শক্তি সে বিষয়টি পাঠকের হৃদয়ে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছেন নিকোলাস এই বইটির মধ্য দিয়ে। আর এ কারণেই নিউইর্য়ক টাইমসের বেস্ট সেলারের শীর্ষে অবস্থান করছে নিকোলাসের এই বইটি।
×