ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দিলরুবা শাহানা

গল্প ॥ মনে পড়ে রুবী রায়

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ১৩ নভেম্বর ২০১৫

গল্প ॥ মনে পড়ে রুবী রায়

উইনরক স্কলারশিপদাতাদের বিচিত্র ধারার চিঠিটা ইরাকে ভাবনায় ফেললো। স্কলারশিপের জন্য মোটেও সে মরিয়া নয়। শাশুড়ির উৎসাহে চার-পাঁচ শ’ শব্দের রচনাটা লিখে ফেলেছিল। উনিই তাঁর দারোয়ান বা আর্দালী দিয়ে পোস্টও করিয়েছিলেন। তারপরে যখন দেখা গেল সমস্ত পৃথিবীর পাঁচ মহাদেশের পাঁচজন মাত্র নির্বাচিত হয়েছে এবং তাদের মাঝে মেয়ে একমাত্র ইরা। শাশুড়ির আনন্দ আর ধরে না। তাঁর ছেলে যে একটি রতœকে বিয়ে করেছে তা উনি আগেই বুঝেছিলেন। পরীক্ষাতে হয়তো স্টারমার্ক বা লেটারমার্ক পায়নি কখনো তবে ইরার প্রধান শিক্ষিকা শাশুড়ি ওকে উৎসাহ দিয়ে এমএ পাস করিয়েছেন। মেধার অপচয় যাতে না হয় তাই এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেও উৎসাহ জুগিয়েছেন। একমাত্র ছেলের বউকে শাশুড়ি আদর ও শাসনে স্থিতধি রাখতে দারুণ সফল। শিক্ষকের দৃষ্টিতে ইরার শক্তি ও সম্ভাবনা এড়ায়নি। ইরা বুদ্ধিমতী তবে খেয়ালী বড়। খেয়ালী মনের তাগিদে ‘আরও কতদিন বাকি তোমারে পাওয়ার আগে বুঝি হায় নিভে যায় মোর আঁখি’ এই উদাস করা গান শুনে এমএ পরীক্ষায় বসলো না। উদাসীর পাশে সানন্দে কনে সেজে বিয়ের আসনে বসলো। বিয়ের সময় ইরার বাবা বলেছিলেন ‘আমার সবচেয়ে বুদ্ধিমতী মেয়েটিই অন্য সন্তানদের মতো পরীক্ষাতে দারুণ কিছু করেনি কখনো, আপনার গুণী ছেলে ওর গুণ খুঁজে পাবে আশা করি’ শাশুড়িই গুণ বুঝেছিলেন আগে। বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে সবাই যখন দৌড়াচ্ছে সবকিছু পাওয়ার উদগ্র বাসনার পেছনে। আর ইরা? ওকে দেখলে মনে হয় ও আছে সব পেয়েছির ভুবনে। বন্ধুরা সবাই নানা জায়গায় অমুক তমুক হয়ে বসেছে। কমনওয়েলথ আর ফুলব্রাইট স্কলারশিপে নন্দিত হচ্ছে। ইরার কোনই তাগাদা নেই। উইনরকের নয় মাসের অত্যন্ত প্রেস্টিজিয়াস ফেলোশিপ এটা। অর্থমূল্যও অনেক। সমস্ত পৃথিবী ছেঁকে মাত্র পাঁচজনকে বেছে নিয়েছে। যখন সব চূড়ান্ত হয়ে গেছে তখন আবার এই চিঠি কেন? সারমর্ম হলো রিজিওনাল চিফ ইরফান জুবের ঘটনাক্রমে এখন এখানে। এই ভদ্রলোক সরাসরি স্কলারশিপ হোল্ডারকে দেখতে চান। এই নাম কখনো শুনেছে বলে মনে পড়লো না ইরার। যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছে রিসেপশনে বসতেই অল্প অপেক্ষার পরই ওকে এক দরজার পাল্লা খুলে ভেতরে যেতে ইঙ্গিত করল রিসেপশনিস্ট। সুন্দর টেবিলের ওপাশে জমকালো চেয়ারে কাঁচাপাকা ঘন চুলের লম্বা মুখাকৃতির আকর্ষণীয় উজ্জ্বল চেহারার দীর্ঘদেহী পাতলা গড়নের এক ভদ্রলোক কিছু যেন লিখছেন। মুখ না তুলেই টেবিলে তবলায় বোল তোলার ভঙ্গিতে মৃদু আঙ্গুল ঠুকে বললেন, ‘ঞধশব ধ ংরঃ’. বসার পরপরই ভদ্রলোক মুখ তুলে ভাল করে ইরাকে দেখলেন। ইরা ভাবছিল কি ভাষাতে না জানি ইনি কথা বলবেন। ভদ্রলোক কৌতুকের হাসি চোখে নিয়ে যা বললেন তাতে ইরার পায়ের নিচে ভূ-গোলক দুলে উঠলো আর মনে হলো কবে কোনকালে কৃত অপকর্মের জন্য আজ ওর স্কলারশিপ বুঝি ভ-ুল হতে চললো। চোখে রহস্যের হাসি আর ঠোঁটে উচ্চারিত হলো অবিস্মরণীয় জিজ্ঞাসা। ‘মনে পড়ে রুবী রায়?’ ফর্সা গোলগাল, মাঝারি আকৃতি, উগ্র নয় তবে বর্ণনাতীত নম্র সৌন্দর্যের প্লাবণে স্নাত পরিপূর্ণ তরুণী ইরার ভীতশঙ্কিত সুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে ইরফান জুবেরের মনে হলো একে দেখে অনেকে নিশ্চয় গেয়েছে ‘বিধি ডাগড় আঁখি যদি দিয়েছিল সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না।’ তার মনে হলো মেয়েটির চেহারায় বুদ্ধির ছাপ আছে অবশ্যই। তবে ভাবেভঙ্গিতে, পারিপাট্যে তা ফুটিয়ে তোলার চৌকস প্রয়াসের অভাব লক্ষণীয়। ইরফান কোথায় যেন পড়েছেন খুব সুন্দরী মেয়েরা হয় মাথায় গবেট নয় স্বভাবে তরল, আবার তাদের মাঝে কেউ মনে অর্থহীন গরিমার গরল নিয়ে চলে। তবে এই মেয়েটি গবেট নয়। ইরফানের ভাগ্য ভাল সুন্দরী গবেট কেউ তাকে ভোলাতে পারেনি কখনো। ইরফান জুবের উচ্চারিত ‘মনে পড়ে...’ গানের কলি মুহূর্তে ইরার সামনে কোন দূর অতীতের স্মৃতির জানালা খুলে দিল। পিচঢালা সড়কের পাশে দাঁড়ানো হালকা হলুদ রঙের স্কুলবিল্ডিং থেকে নানা বয়সের মেয়েরা বেরয়। কেউ ডানদিকে, কেউ বাঁ-দিকে, কেউবা দলবেঁধে পিচের সড়ক পেরিয়েই উল্টোদিকের ইটবিছানো পথে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরে। তখন মানুষের অফুরান ঢেউ যেমন ছিল না, গাড়ি-ট্রাকের স্রোতের গর্জনও তেমন হতো না। ইটের পথের ডানদিকেই ছিল বইয়ের দোকান। বই ছাড়াও কাগজ-কলম, পেন্সিল-রাবার পাওয়া যেত। স্কুলছাত্রীরাও দরকার মতো টুকটাক জিনিস কিনে নিতে পারত। বড় মেয়েরা নিজেরা দোকানে না গিয়ে নিচের ক্লাসের কাউকে বলতো ‘যাতো ভাই, আমার জন্য এক দিস্তা কাগজ নিয়ে আয় আমরা দাঁড়াচ্ছি এখানে’ কখনো কেউ বলতো ‘কলমটা এনে দেনা ভাই’। ছোটরা দায়িত্ব পেয়ে নিজের গুরুত্ব বাড়ার গৌরবে ভর করে প্রজাপতির মতো ছুটে যেত। এমনি এক রোদ চকচকে, বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে নাইনে বা টেনে পড়ুয়া দীর্ঘাঙ্গী, লম্বা চুল, খাড়া নাক, খয়েরি চোখের রচিআপা ফাইভের ইরার হাতে পয়সা দিয়ে বলেছিল ‘এই আমার জন্য রাবার কিন্বি একটা আর ওই যে তিনটা ছেলে দাঁড়িয়ে দোকানে তাদের মাঝে লম্বাটেফর্সা, লালচে চুলের যে তাকে একটা ভেংচি কেটে দৌড়ে চলে আসবি, ঠিক আছে।’ সঙ্গের একজন বললো ‘ভেংচি কেন কাটবে?’ ‘শুনিস্নি ওই ক্যাডেটপড়ুয়ারা পরীক্ষা শেষে এখানে পাড়ার দোকানে বসে গান গায় ‘মনে পড়ে রুবী রায়...’ কথাটা শুনেই ছেলেটিকে শাস্তি দেয়ার জন্য পড়িমরি করে ছুটেছিল ইরা। চোখ ট্যারা বানিয়ে, জিব বের করে ভেংচি কেটে সাঁ সাঁ করে ফিরে এসেছিল ও। শুনলো একজন বলছে ‘তুই মনে হয় ওই গান শুনার জন্য কান পেতে রাখিস রচি’ ‘কি বলিস না বলিস তোরা!’ ‘শোন্ ইরা তুই যে ভেংচি কাটলি তোর নামে বিচার দেবে বাসাতে, একলা পেলে তোর কান মলে দেবে দেখিস’। ভয় পেয়ে কান ব্যথার মিথ্যা দোহাই দিয়ে ইরা এক সপ্তাহ স্কুলে যায়নি। ওই ছেলেদেরও আর দেখেনি পরে। তবে ইরার সে দুঃসাহসী দুষ্টামির গল্প স্কুলের সবাই জেনে ফেলেছিল। বড়মেয়েরা জিজ্ঞেস করতো ‘কোন গানটা গেয়েছিলরে ছেলেটা?’ ছোটরা সাহসিনীকে বলতো ‘কি রকম ভেংচি দিয়েছিলি দেখাতো।’ ইরা পরে ‘মনে পড়ে রুবী রায়’ গানটা যতোবার শুনেছে নিজের ওইটুকু বয়সে করা দুঃসাহসী দুষ্টামির জন্য হেসেছে। হিন্দীতেও এই সুরের গানটি শুনে সেই স্মৃতি মনে পড়েছে। ভদ্রলোকের মুখটি পলকে দেখে বিষণœ না প্রসন্ন তা যাচাই করতে পারলো না। ইরা নিজেই বিষণœ আর বিপন্ন। ওইদিন ভেংচি কেটে ওদের বইয়ের দোকান থেকে তাড়িয়ে না দিলে কত মনোরম মনোহর কিছু ঘটতে পারতো। মুহূর্তে অভিনব এক চিত্রকল্প ওর মনে ভেসে উঠলো। রচি আপা একদিন ইরফান জুবেরের সাথে ইটের সড়ক ছেড়ে ঝাউবনের ছায়ায় ছায়ায় পথ চলতে শুরু করলেন। মায়াবী ছায়াবীথির শেষে উথালপাতাল ঢেউ নিয়ে জীবনের সমুদ্র সামনে হাজির হলো। ওই সমুদ্র পাড়ি দিতে দু’জনে একই নৌকায় চড়ে বসলেন। তারপরে দু’জনে ঢেউ ছাপিয়ে গলা ছেড়ে গাইলেন। ‘পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙ্গে যদি ছিন্ন পালের কাছি মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায় জানিব তুমি আছ আমি আছি।’ কিন্তু হায় সেসব কিছুই ঘটেনি। তার উপর কালের স্রোতে ইরার পুরাতন অপরাধ তামাদি হয়নি। সেই অপরাধের শাস্তি হিসাবে ওর স্কলারশিপ আজ বাতিল হতে চলেছে বোধহয়। একটা ব্যাপারেই খট্কা লাগছে তা হলো ওর নাম উনি জানলেন কিভাবে? এসব চিন্তায় মুহূর্ত ব্যয় হয়নি। ভদ্রলোকের গলার স্বরে চমকে গেলেও আনন্দের স্রোতে ছুটলো রক্তে ‘কংগ্রাচুলেশন স্কলারশিপের জন্য আর গোপন খবর হলো তোমার রচিআপা আমার সঙ্গেই আছেন, উনি আনন্দেই আছেন।’
×