ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সেলিনা হোসেন

অভিজ্ঞতার সূত্র

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ১৩ নভেম্বর ২০১৫

অভিজ্ঞতার সূত্র

গ্রামবাংলার নিপীড়িত মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার নানা সূত্র আবিষ্কৃত হয় সৃজনশীল রচনার নানা প্রকাশে। গ্রামীণ জনপদে মুখে মুখে ছড়িয়ে থাকা ছড়া এমন একটি উপাদান। বেশিরভাগ ছড়ায় দেখা যায় নারী জীবনের নানা অনুষঙ্গ বিধৃত হয়েছে। একদিকে তা সমাজ বাস্তবতার স্বরূপ, অন্যদিকে সময়ের দলিল। সময়ের যে প্রবহমান স্রোত জীবন চিত্রকে ধরে রাখে তার রূপান্তরের চিত্রটি এসব নিরক্ষর সাধারণ মানুষের আলোকিত চেতনায় বিমূর্ত হয়ে ওঠে। মুখে মুখে প্রচলিত এসব ছড়া নারীর রচনা নাকি পুরুষের, তা বলা কঠিন। নারীকেন্দ্রিক রচনা নারীর মুখেই চিত্রিত হয়েছে এমন ভাবনা থেকে একটি ছড়ার উল্লেখ করছি : খাইতে পিনতে টানাটানি হারাদিন ঘ্যানঘ্যানানি পানচুনের লেশ নাই হারাদিন তুই তাই এর উপরে মারধোর কেমন করে হাইর ঘর? বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু সমাজব্যস্থার অধীনে বাঙলার নারী সমাজের এই হলো বাস্তব চিত্র। পুঁথিগত বিদ্যার অভাব আছে, কিন্তু ঘাটতি নেই আবেগ প্রকাশের ব্যাকুলতায়। বড় বেশি সহজ এবং তীক্ষè প্রাখর্যে বিমূর্ত করেছে নিজের সামাজিক অবস্থান। সামন্তবাদী অর্থনীতি যেমন সামগ্রিক সমাজব্যবস্থাকে পঙ্গু করে রেখেছে তেমনি এর দায়ভাগ বহন করতে হচ্ছে সমাজের দুর্বল অংশকে, যারা নিগ্রহের নিগড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ক্রীতদাসী। নিজের ইচ্ছাশক্তি যাদের ধূসর ম্লান ভুবনের নিয়ন্ত্রক নয়। উপরের ছড়াটি তার প্রমাণ। কোন অসহনীয় যন্ত্রণায় হয়ত মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় যে, কেমন করে হাইর (স্বামী) ঘর। কিন্তু ঐ পর্যন্তই, এর কোন সমাধান নেই। উপরের ছড়ায় আরও একটি জিনিস লক্ষণীয় যে, এখানে সমস্যা শুধু ভাত-কাপড়ের নয়, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যেও কোন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নেই। ভাত-কাপড়জনিত সমস্যার কারণে সাময়িক পারিবারিক কলহ হতে পারে, কিন্তু সেটা অশ্রদ্ধায় পর্যবসিত হলে বুঝতে হবে যে, এর মূল অনেক গভীরে। এঙ্গেলস বলেছিলেন, ‘আধুনিক ব্যক্তিগত পরিবার স্ত্রীলোকের প্রকাশ্য অথবা গোপন গার্হস্থ্য দাসত্বের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং বর্তমান সমাজ হচ্ছে এসব ব্যক্তিগত পরিবারের অণুর সমষ্টি।’ (কার্ল মার্কস-ফ্রেডারিক এঙ্গেলস; রচনা-সংকলন, দ্বিতীয় খ-, পৃঃ ২২৯)। বাংলাদেশের এই ছড়াগুলোর মধ্যে উপর্যুক্ত বক্তব্যের আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে। সম্পর্ক যখন মনিব-দাসে পরিণত হয় তখন আর শ্রদ্ধা অবশিষ্ট থাকে না, থাকে ক্রীতদাসের ভাষা। সে জন্যই রাতদিন চলে তুই-তোকারি, সম্মানজক ভাসা ব্যবহারেও অপারগ তার মনিব। খাওয়া-দাওয়া অভাব-সামান্য পানচুনও পাওয়া যায় নাÑ এর ওপর স্বামীর অকথ্য ব্যবহার-নির্যাতন এবং মারধর। এসব কিছুর মধ্যেও বাংলার নারী স্বামীর ঘর করে। নিরুপায় অক্ষমতার বলি হয়; কেননা, বেরিয়ে আসার মতো অর্থবল এবং মনোবল কোনটাই নেই। উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন বলেই দাসত্ব অনিবার্য। উপরন্তু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বলয় থেকে বেরিয়ে আসার দেউড়িগুলো লোহার দেয়াল, সেহেতু এ ক্ষোভ ও আক্রোশ প্রকাশ পায় ছড়ার মধ্যে কিংবা মেয়েলি গানে। এই মর্মজ্বালার চিত্র শুধু একতরফা নয়, আছে উল্টো পিঠও। পারিবারিক গ-ীর বাইরের বিশাল ক্ষেত্রও রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে থাকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জো নেই। যেমনÑ পান তামাক খাইয়ে বুড়ি বাজারে চলিল পথে ছিলো প্যায়াদা বেটা তাড়া করিল। সেই তাড়া খাইয়ে বুড়ি গাছে উঠিল। গাছে ছিল ঠক্কর পাখি ঠোঁক মারিল। ঠোঁক খাইয়ে বুড়ি তলায় পড়িল তলায় ছিল বুদির কাঁটা পাছায় ফুটিল। দাঁড়াই ছিল প্যায়াদা ব্যাটা বাড়ি কশিল বাড়ি খেয়ে ফোঁকটা বুড়ি কান্দিতে লাগিল। পেয়াদা এখানে ব্যক্তি নয়- সমষ্টি, অন্য অর্থে সমাজ। এই সমাজ বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন মুখোশের আড়ালে তাকে তাড়া করে ফেরে। গাছের উপরে স্বস্তি নেই, নিচেও কাঁটা অর্থাৎ ঘরে-বাইরে সর্বত্র তার জ্বালা। পরনির্ভরতার এই দেউলেনার কারণেই অত্যাচার সীমাহীন। সইতে হয় বহু বিবাহের নামে সতীনের যন্ত্রণা, যৌতুকের নামে অপমান-লাঞ্ছনা, ঘরগেরস্তির নামে স্বেচ্ছাচারী পুরুষের দাসত্ব। বচুনি গেছে নাক ফুটোতি কলুই ডাঙার মাঠে, সেই খবর শুনে আলাম আমতলার হাটে। আম পড়ে আলু আলু কাগে খুইচে খায়, আষাঢ় মাসে খাজনা দিতি পিয়াস ফাইটে যায়। আপাতদৃষ্টে মনে হয় অসঙ্গত, অসংলগ্ন চিত্র, কিন্তু অন্তরে প্রবহমান ফল্গুধারার স্রোত। যে বচুনি কলুই ডাঙার মাঠে নাক ফুটো করতে যায় সে জানে না জীবনের সবটাই তার ফুটোয় ভরা। গাছের অসংখ্য আম কাকে খায়। এই কাক শোষকের প্রতীক, যারা সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে সব ফসল গোলায় তোলে। শুধু আষাঢ় মাসে খাজনা দিতে বচুনিদের পরাণ যাবে না, তাদের পরাণ ফাটে প্রতিপদক্ষেপে। গ্রামবাংলার অশিক্ষিত, মূর্খ মানুষ শুধু অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধিতে কত চমৎকার করে সাহিত্যের আবরণে নিজেদের প্রস্ফুটিত করেছে। এখানে শুধু চিত্র নয়, আছে ধ্বনিও। যে ধ্বনি কানের মধ্য দিয়ে মরমে পশে। ব্যথিত হৃদয় অস্থির হয় সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তায়। তবে এই ছড়াগুলো জীবনব্যবস্থার অসঙ্গতির নিদারুণ মর্মজ্বালার বহির্প্রকাশ মাত্র, সমাজকে কোন প্রচ- আঘাতে বিপর্যস্ত করে না, ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যায় না নিয়মের বেড়ি। বরং ছড়াগুলো লোকসাহিত্যে হাস্যরসের উপাদান হিসেবেই বিবেচিত হয় বেশি, অন্তর্নিহিত ভাবটুকু তলিয়ে দেখে সত্য আবিষ্কারে ব্রতী হয় না। খুব সচেতনভাবে নয়, বিদ্রোহ কখনও দপ করে জ্বলে ওঠে লোকচক্ষুর আড়ালে, আবার মিলিয়েও যায়। তখন দেখি একজন নারী তার প্রেমিকের মৃত্যুতে নিজেকে বিধবা ভাবে আর স্বামীর মৃত্যুর পর মাছ-ভাত খাওয়ার উল্লাস প্রকাশ করে। ফলে ভেঙে যায় সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের পাথুরে দেয়াল। মেয়েলি গানটির অংশবিশেষ এমন: বালুতে রান্ধিনু বালুতে বাড়িনু জলেতে ভাসায়েরে দিনু হাঁড়ি বিয়ার সোয়ামী মরলে মাছ-ভাত মুই খাইমুরে বন্ধু মরিলে রে হব রাঢ়ি। এই বিদ্রোহের অন্তরালে নিহিত অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষার দীপ্রশিখা, যা সুযোগ পেলে পোড়ায় তথাকথিত ঐতিহ্যের শোলার বেদি। ছড়া কিংবা মেয়েলি গানের আপাত বহিরঙ্গের আড়াল থেকে এই তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থ হলে সমাজের প্রবহমানতা আমাদের কাছে অস্পষ্ট হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের অখ্যাত ছড়াগুলো এ দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক রূপটি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। শুধু সাহিত্যের মানদ-ে বিচার করলে এর সামগ্রিক অর্থকে খ-িত করা হবে মাত্র। বরং এসব ছড়া অবলম্বনে বিভিন্নমুখী গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কৃত হবে লোকজ মানসের পরিবর্তন, যে পরিবর্তন আপন নিয়মে পথ করে চলে। কোন ধরনের বৃহৎ বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে না ঠিকই, কিন্তু পরিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে সক্রিয় রাখে। এজন্যই এগুলো এত বাস্তব এবং জীবন্ত। এই সূত্রের জের টেনেই বলতে হয়, যে সমাজব্যবস্থা পুরুষশাসিত, যেখানে পুরুষের স্বেচ্ছাচার অবাধ এবং স্বীকৃত, যেখানে নারী পণ্য বলে বিবেচিত, পরনির্ভর, অশিক্ষিত এবং অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন থেকে বঞ্চিত; সে সমাজব্যবস্থায় যৌতুকপ্রথা একটি অনিবার্য উপাদান। এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, মূলের সঙ্গেই এর গভীর যোগাযোগ। এই পরিস্থিতিতে বক্তৃতা, বিবৃতি, লেখালেখি বা দু’চারজনের সাক্ষাতকার খুব একটা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না। কিংবা গুটিকয় সংস্কারমুক্ত উদারমনা যুবকের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন এই প্রথাকে বিলোপ করার পক্ষে সহায়ক নয়। এই সমাজের বহুবিধ স্থায়ী অসুখের মধ্যে যৌতুকপ্রথা একটি। এর উৎসারণ ঐ একই উৎসে, যেখানে নারী হাঁড়িভরা ভাত রেঁধেও পেটপুরে খাবার যোগ্যতা রাখে না। আমাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান এখন কোন্ পর্যায়ে এবং কোন্ পর্যায়ে হওয়া উচিত বলে মনে করেন? বলেছিলাম, দেখেশুনে মনে হয় বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থান প্রশ্নটি অত্যন্ত অবমাননাকর। কেননা, এটা স্পষ্ট যে, কোথাও কোন সুস্থ-সম্মানমাফিক অবস্থান নেই বলেই এ ধরনের প্রশ্ন ওঠে। নারী এখানে পণ্যের দরে বিকোয় এবং প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবেই সমাজে তার অবস্থান নির্ধারিত হয়। সুতরাং, এই সমাজব্যবস্থার অধীনে ভবিষ্যতে নারীর অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটা বলাই বাহুল্য। অর্থনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের মাধ্যমে নিজের পায়ে দাঁড়ানো ছাড়া এই সমাজে নারী পণ্য হিসেবেই বিবেচিত হতে থাকবে। এবং এই সমাজব্যবস্থা চলতে থাকলে অনন্তকাল ধরে নারীমুক্তির কোন সম্ভাবনা নেই। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাতেই পুরুষ-নারীর প্রশ্নটি এমন অশালীন মর্যাদায় উচ্চারিত হয় না। ঐতিহ্যের এ মূল্যবোধের ফলস্বরূপ আমরা পাচ্ছি অসঙ্গতি এবং এ অসঙ্গতি উদ্ভূত হতাশা ও জীবন-জটিলতা। জনৈক লেখক এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আমি ওকে ঘৃণা করা সত্ত্বেও এক সঙ্গে ঘুমাই এবং ও আমাকে ঘৃণা করা সত্ত্বেও এক সঙ্গে ঘুমোয়। তবুও আমরা এক সঙ্গে বাস করি কেন? কেননা, আমরা দুজনই দু’জনকে চাই। আমার ঘুমোবার সাথী হিসেবে তাকে আমার প্রয়োজন, আর ভাত এবং কাপড়ের জন্য আমাকে তার প্রয়োজন। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক সমতার অভাবে ভালবাসা নয়, পারস্পরিক ঘৃণার ওপরই সমাজ প্রতিষ্ঠিত। পারিবারিক জীবনের এ গোঁজামিলের প্রবণতা থেকে আজ আমাদের মুক্তি দরকার। নইলে ক্ষয়িষ্ণু সমাজব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি আমাদের নিয়তই জীর্ণ করতে থাকবে। আমাদের সন্তানরা ঘুরে মরবে একই আবর্তে। সমৃদ্ধশালী সুখী জীবনব্যবস্থার নাগালের বাইরে ছিটকে পড়ে মেকি ভালবাসার দাসীবৃত্তির অপর নামই যদি হয় বেঁচে থাকা, তবে এই বেঁচে থাকার শেকল ভাঙা প্রয়োজন। পারিবারিক জীবনের সুসঙ্গতি এবং নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক সমতার মধ্যে ভালবাসার সত্যিকার মূল্যায়ন নবপর্যায়ে ঐতিহ্য সৃষ্টির দিকদর্শন হওয়া উচিত। অন্যথায় প্রচলিত ঐতিহ্যের বেড়ি ভাঙা এক দুরূহ সাধনায় পরিণত হবে।
×