ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

শেকড় সন্ধানী সুরে শ্রোতার প্রাণ স্পন্দনে উদ্দীপ্ত ফোক ফেস্ট

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৩ নভেম্বর ২০১৫

শেকড় সন্ধানী সুরে শ্রোতার প্রাণ স্পন্দনে উদ্দীপ্ত ফোক ফেস্ট

মনোয়ার হোসেন ॥ অবিনশ্বর অনুভূতির প্রতিরূপ সঙ্গীত। তাই তো গান শুনলে ভাল হয়ে যায় মন। জুড়িয়ে যায় প্রাণ; আত্মা হয় পরিশুদ্ধ। আর সেটা যদি হয় শেকড়সন্ধানী লোকসঙ্গীত তবে উপলব্ধির মাত্রাটা সহজেই স্পর্শ করে হৃদয়ের গহীনে। মরমি সাধকদের মানবতার ও অধ্যাত্মবাদী দর্শনের বাণীময় শব্দতরঙ্গে আলোড়িত হয় শ্রোতার প্রাণ। বৃহস্পতিবার হেমন্তের পড়ন্ত বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সুরের অবগাহনে এমন বিচিত্র অনুভূতির সঙ্গী হলেন রাজধানীর কয়েক হাজার গানপ্রেমী। তারা সবাই হাজির হয়েছিলেন রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে। এখানে শুরু হলো তিন দিনের আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন ও আয়ারল্যান্ডের প্রখ্যাত লোকগানের শিল্পী ও সাধকদের সম্মিলিত এ সঙ্গীতাসরের শিরোনাম ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট। লোকজ আঙ্গিকের কণ্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে যন্ত্রীসঙ্গীত ও লোকনৃত্যে সজ্জিত উৎসবে পাঁচ দেশের শতাধিক শিল্পী। মেরিল নিবেদিত এ উৎসবের যৌথ আয়োজক মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টস। এই প্রথম অনুষ্ঠিত হলো সবার জন্য উন্মুক্ত লোকসঙ্গীতের বিশাল পরিসরের এমন মনমাতানো সাংস্কৃতিক আয়োজন। দেশজ লোকসঙ্গীতের চর্চা ও প্রসার এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। লোকসঙ্গীতের উৎসবে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের লোকগানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লোকজ বাদ্যযন্ত্রের পরিবেশনা। লোকগানের সুরে লোকনৃত্যের পরিবেশনা দিয়েছে উৎসবে ভিন্ন মাত্রা । উদ্বোধনী দিনের পরিবেশনায় অংশ নেন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের শিল্পীরা। তবে আয়োজনটি অনন্য হলেও আয়োজকদের অব্যবস্থাপনার কারণে ফিরে গেছেন অনেক শ্রোতা। নিবন্ধনের সময় শ্রোতারা ব্যাগ নিয়ে উৎসবস্থলে প্রবেশ করতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে কোন নির্দেশনা ছিল না। তাই কর্মস্থল থেকে ব্যাগ নিয়ে সরাসরি চলে আসেন উৎসব আঙিনায়। এমন শ্রোতাদের আটকে দেয়া হয় প্রবেশদ্বারে। বাধ্য হয়ে অনেকেই ফিরে গিয়েছেন বাড়িতে। যদিও নারী দর্শক কিংবা শ্রোতারা ব্যাগসহই প্রবেশ করেছেন উৎসবস্থলে। স্বামীবাগ থেকে গান শুনতে এসে বিড়ম্বনার শিকার হন শিকদার নিজামুল হক। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাগ নিয়ে যদি অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ না করা যায় তাহলে নিবন্ধনের সময়ই আয়োজকদের বিষয়টি জানানো উচিত ছিল। এমন দাযিত্বহীন ও অব্যবস্থাপনাপূর্ণ আচরণের কারণে আমাকে আবার বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে। স্টেডিয়ামের প্রবেশদ্বারে তার মতো এমন অসংখ্য গানপ্রেমীকে ব্যাগ বিড়ম্বনায় শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানস্থল থেকে ফিরে যেতে হয়। উৎসবের প্রথম প্রহরটি নিজের করে নেন দেশবরেণ্য লালনগীতি সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন। প্রথমেই গেয়ে শানান লালনের অমর গান ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’। এরপর ছিল তার সুরের খেলা। পর পর তিনটি গান গেয়ে শোনান এ শিল্পী। দ্বিতীয় গানটি ছিল ‘মিলন হবে কতদিনে’ এবং তৃতীয় গানটি ছিল ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। দর্শকশ্রোতাদের লালনের মরমি সুধায় প্রথমেই সিক্ত করে নেন এ শিল্পী। এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শুরু হয় উৎসবের পরিবেশনা। প্রথমেই মঞ্চে আসেন নৃত্যশিল্পী মিনু হক ও তার দল এবং পল্লবী ডান্স গ্রুপের নৃত্যশিল্পীরা। লোকগানের সুরে পরিবেশিত হয় নৃত্য। নাও ছাড়িয়া দে পাল উড়াইয়া দে, টেউ খেলানি দিয়া নাচে গোলাপি, তোর মাদলেরই তালে আমার মন ঝুমুর নাচে উঠলো মেতে এমনি সব নাচের সঙ্গে নেচে গেয়ে মাতিয়ে তোলেন উৎসবস্থল। এমনকি আদিবাসী গানের সুরে লোকনাচেও দর্শক হয়েছে বিমুগ্ধ। তারপরই ছিল উদ্বোধনী পর্ব। তিন দিনের এ উৎসব উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বরেণ্য শিল্পী ফেরদৌসী রহমান। স্বাগত বক্তব্য দেন মাছরাঙা টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। সাবলীলভাবে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কণ্ঠশিল্পী তপন চৌধুরী। শেকড়সন্ধানী এ আয়োজনের প্রশংসা করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সঙ্গীতের প্রতি বাঙালী জাতির যে আকর্ষণ ও আবেগ, তা নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। এ দেশে রয়েছে সঙ্গীতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। এর মধ্য লোকসঙ্গীত অন্যতম। এ গানের মধ্যে এক ধরনের আন্তর্জাতিকতা রয়েছে। সব দেশের লোকসঙ্গীতের মধ্যেই কোথাও না কোথাও মিল বিদ্যমান। উদ্বোধনী পর্বে মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী বলেন, স্কয়ার বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান। আমাদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেমন দেশীয় অঙ্গনে সেবা দিচ্ছে তেমনি সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রয়েছে। ফোক ফেস্ট যেমন স্কয়ারের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত হলো, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উৎসবও স্কয়ার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান বলেন, লোকসঙ্গীত বাংলা গানের আদি ঠিকানা। ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, জারি, সারি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদী প্রভৃতি বাংলার জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার অন্তরের গান। এই গানকে আমরা বড় অবহেলা করেছি। এই লোকসঙ্গীত এখন ব্রাত্য হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমগুলোতেও লোকসঙ্গীতের স্থান কমে গেছে। ফলে যারা গ্রামে এই লোকসঙ্গীতের চর্চা করেন তাদের সঙ্গে শহরের সঙ্গীতধারার যোগ ঘটছে না। আশাকরি এ উৎসবের মধ্য দিয়ে আবার লোকসঙ্গীত ফিরে পাবে তার হারানো ঐতিহ্য। সুরের কাছে সমর্পিত গানপ্রেমীদের আগমনে উৎসব প্রাঙ্গণটি যেন হয়ে ওঠে মহাসঙ্গীতযজ্ঞ। আর এই সুরের তীর্থভূমিতে উপস্থিত হয়েছিলেন একেবারে তরুণ থেকে মধ্যবয়সী পেরিয়ে বয়স্ক সঙ্গীতানুরাগীও। সুরের মায়াজালে ঘুচে গিয়েছিল বয়সের সীমারেখা। আর সুরের এই বৈভবে সকলের মাঝে বয়ে গেছে প্রাণস্পন্দন। হাজার শ্রোতার আগমনে প্রথম রাতটি হয়ে ওঠে অনবদ্য। চারপাশে বিরাজ করেছে শুধুই সুন্দরের আবহ। রাত যত গড়িয়েছে, তাল মিলিয়ে বেড়েছ শ্রোতার সংখ্যা। এক সময় জনারণ্যে পরিণত হয় উৎসব আঙিনা। দ্বিতীয় পর্বে মঞ্চে আসেন শিল্পী চন্দনা মজুমদার ও কিরণ চন্দ্র রায়। লালনের ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ গানটি গেয়ে পরিবেশনা শুরু করেন চন্দনা। প্রথম গানেই শ্রোতাকে আলোড়িত করেন এই শিল্পী। এরপর বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমের গান ‘সোনা বন্ধুরে ভ্ইুলো না আমারে’ ও রাধারমণের ‘জলে যাইও নাগো রাই’। কিরণ চন্দ্রের পরিবেশনা শুরু হয় ‘আয় দেখে যা জগতবাসী বাংলাদেশ ঘুরে’। তিনিও শ্রোতাদের মাতিয়ে একে একে গেয়ে শোনান ‘আমার মন তো বসে না গৃহকাজে/অন্তরে বৈরাগীর লাউয়া বাজে’ ও ‘আমার ভিতরে-বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয়জুড়ে’। তাদের মাটির গানে যেন ফিরে আসে নবপ্রাণের জোয়ার। এর পর মঞ্চে ওঠে ভারতের লোকগানের ব্যান্ডদল অর্ক মুখার্জী কালেক্টিভ। ফিউশন আঙ্গিকে লোকসঙ্গীত পরিবেশন করে দলটি। দলটির পরিবেশিত গানগুলোর শিরোনাম ছিল ‘ও সে এক রসিক পাগল’, ‘দুয়ারে আাইসাছে পালকি/নাইওরিগো তোলো’, ‘আল্লাহ ম্যাঘ দে পানি দে ছায়া দেরে তুই’, ‘খাজা বাবা খাজা বাবা/মারহাবা মারহাবা’, ‘তুমি জানো নারে প্রিয় তুমি মোর জীবনের সাধনা’সহ বেশ কিছু গান। এরপর লাবিক কামালের সঙ্গে মঞ্চে আসেন রব ফকির ও শফি ম-ল। তিন শিল্পীর পরিবেশাটিও ছিল দারুণ উপভোগ্য। এরপর মঞ্চে আসে পাকিস্তানের বিখ্যাত শিল্পী সাঁই জহুর। ২০০৬ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড মিউজিক পুরস্কারজয়ী এই শিল্পী ছিলেন উৎসবে প্রথম রজনীর বিশেষ আকর্ষণ। সব শেষে মধ্যরাতে শ্রোতাদের মন ভরিয়ে দেন ভারতের পাপন ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শিরোনামের লোকজ ধাঁচের ব্যান্ড দলটি। আজকের আয়োজন ॥ আজ শুক্রবার উৎসবের দ্বিতীয় দিন। এদিনের অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল ৫টায়। এদিন গান শোনাবেন শ্রোতা মাতানো জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত শিল্পী মমতাজ। লোকজ ধারার গানের বিশেষ উপস্থাপনা নিয়ে আসার কথা রয়েছে তার। এছাড়াও দ্বিতীয় রাতে শোনা যাবে বাংলার কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল আলীমের গান। মহান শিল্পীর পুত্র আজগর আলীম, জহির আলীম, নূরজাহান আলীম বাবার গান থেকে গেয়ে শোনাবেন। গানে গানে শ্রদ্ধা জানানো হবে ভাওয়াইয়া গানের রাজা আব্বাস উদ্দীনকে। তাকে উৎসর্গ করে গাইবেন নাতনি নাশিদ কামাল। উকিল মুন্সির গানের জন্য বিশেষ খ্যাতি বারি সিদ্দিকীর। গাইবেন তিনিও। আধুনিক শহুরে প্রজন্মের একটি অংশ বাউল গান নিয়ে নানা ধরনের নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেই প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করবে অর্নব এ্যান্ড ফ্রেন্ডস। গাইবেন বাউলিয়ানার শিল্পীরা। এদিনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হতে পারেন পবন দাশ বাউল। ভারতের এই বাউল ফিউশনের জন্য পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। বাংলাদেশে তার অগণিত ভক্ত শ্রোতা। তাদের জন্য গাইতে বৃহস্পতিবার ঢাকায় এসে পৌঁছে গেছেন তারকা শিল্পী। একই দিন গাইবে নুরান সিস্টার্স। এই দুই বোনের পরিবেশনার পর থাকছে চীনের ইউনান আর্ট ট্রুপের পারফরমেন্স।
×