ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাঝিরা ক্যান্টনমেন্টে ১২ ল্যান্সারকে পতাকা তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী

পতাকার সম্মান রক্ষায় সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অনেক বেশি

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৩ নভেম্বর ২০১৫

পতাকার সম্মান রক্ষায় সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অনেক বেশি

ফিরোজ মান্না, বগুড়ার মাঝিরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ॥ ‘তোমার পতাকা যারে দাও/তারে বহিবাতে দাও শকতি’। সবুজের বুকে লাল সূর্যের পতাকা অর্জন করতে বাঙালী জাতিকে বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে। ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত পতাকার সম্মান রক্ষা জাতির প্রতিটি নাগরিকের বড় দায়িত্ব ও কর্তব্য। সামরিক বাহিনীর জন্য এ দায়িত্ব আরও অনেক বেশি। বৃহস্পতিবার বগুড়ার মাঝিরা ক্যান্টনমেন্টে ১২ ল্যান্সার কোরকে জাতীয় পতাকা তুলে দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘প্রাণ দেব, মান নয়’ এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত সেনাবাহিনীর সাজোয়া কোরের সদস্যরা দেশের প্রয়োজনে গঠনমূলক এবং শান্তিরক্ষা রক্ষা মিশনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সব সময়ের জন্য প্রস্তুত। সাজোয়া কোরে ইতোমধ্যে অত্যাধুনিক ট্যাংক এমবিটি-২০০০ সংযোজন করা হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আরও দুটি সাজোয়া রেজিমেন্ট গঠনের পরিকল্পনাও বিবেচনাধীন রয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বগুড়া মাঝিরা সেনানিবাসের শহীদ বদিউজ্জামান প্যারেড গ্রাউন্ডে আর্মাড কোরের (সাজোয়া কোর) বাৎসরিক অধিনায়ক সম্মেলন, কোর পুনর্মিলনী ও ১২ ল্যান্সারকে জাতীয় পতাকা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী আর্মাড কোরের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের কুচকাওয়াজ পরিদর্শক ও অভিবাদন গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে এই কোরের একটি ইউনিট ১২ ল্যান্সারকে জাতীয় পতাকা প্রদান করেন। এই ইউনিটের কর্মদক্ষতা, কঠোর অনুশীলন, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দেশের সেবায় স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় পতাকা প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শহীদ বদিউজ্জামান প্যারেড গ্রাউেন্ডে পৌঁছলে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক তাকে অভ্যর্থনা জানান। লে. কর্নেল মোহাম্মদ খায়রুজ্জামান মোল্লার নেতৃত্বে প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন ও ইউনিট কমান্ডারের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেন। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদের কয়েক সদস্য ও এমপিসহ নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল এম ফরিদ হাবিব ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল আবু এসরার ও উর্ধতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী পরে ১২ ল্যান্সার কোর আয়োজিত প্রীতিভোজে অংশ নেন। সেখানে তিনি কেক কাটেন। ১২ ল্যান্সারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে একটি স্মারক উপহার দেয়া হয়। একই অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হকের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে একটি স্মারক তুলে দেয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী ১২ ল্যান্সার কোরকেও একটি উপহার স্মারক তুলে দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে বলেন, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার পরও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার পদক্ষেপ নেন। বঙ্গবন্ধুর প্রবর্তিত ১৯৭৪ সালের প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি ও ফোর্সেস গোল-২০৩০ প্রণয়ন করা হয়। সেনাবাহিনীর উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে ফোর্সেস গোল-২০৩০’র আলোকে বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১৯৯৬-০১ মেয়াদে সরকার পরিচালনার সময় একটি পদাতিক ব্রিগেড, একটি সংমিশ্রিত ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন, একটি সাজোয় ইউনিট, তিনটি পদাতিক ইউনিট, ২টি আর্টিলারি রেজিমেন্ট, একটি রিভারাইন ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন, দুটি ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন ও একটি সাপোর্ট ও ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা ও পুনর্গঠন করা হয়। এই ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নও প্রশিক্ষণের মান করার লক্ষ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে সরকার সেনাবাহিনীর উন্নয়নে বাস্তবমুখী নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যে সিলেট ১৭ পদাতিক ডিভিশনের একটি পদাতিক ব্রিগেড সদর ও দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের নিরাপত্তা ও তদারকির জন্য আরও দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ও একটি ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে একটি কম্পোজিট ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা করা হয়। কক্সবাজারের রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশনের সদর দফতরের অধীনে একটি ব্রিগেড ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেনাবাহিনীর অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধিও লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক এপিসি, এআরভি, ব্যাটেল ট্যাংক-২০০০, আর্মাড রিকভারি ভেহিকল, হেলিকপ্টারসহ প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র কেনা হয়েছে। একইভাবে নৌ বাহিনী ও বিমানবাহিনী আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে ব্যাপক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর্মাড কোরের সদস্যরা অতীতের মতো আগামীতে দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ অর্পিত দায়িত্ব সফলভাবে পালনে সক্ষম হবেন। তারা কর্মজীবনের সবক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়ে জাতি গঠনে বলিষ্ঠ অবদান রাখবে। জাতীয় পতাকা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা যে কোন ইউনিটের জন্য বিরল সম্মান ও গৌরবের। সেই গৌরবের অধিকারী ১২ ল্যান্সারকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কোর হিসেবে তারা নিয়মিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। পাশাপাশি এই ইউনিটের সদস্যরা দেশের প্রয়োজনে যে কোন দুর্যোগ মোকাবেলায় সহায়তা করছেন। পাশাপাশি বিশ্ব পরিম-লেও তাদের কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর রাখছেন। এতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। জাতীয় পতাকা প্রদানের তাৎপর্য ॥ সশস্ত্র বাহিনীর রণাঙ্গনে জাতীয় মর্যাদার প্রতীক ‘পতাকা’ বহনের রীতি রয়েছে। পতাকা একটি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ঐতিহ্যগত একটি ইউনিটের কর্মদক্ষতা, অভিজ্ঞতা, সাফল্য ও অর্জনসহ সামগ্রিক বিবেচনায় প্রথমে রেজিমেন্টাল ও পরবর্তীতে জাতীয় পতাকা প্রদান করা হয়। ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড যে কোন ইউনিট ও প্রতিষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেয়া সর্বোচ্চ সম্মান ও স্বীকৃতি। সেনাবাহিনীর ফিল্ড ইউনিটসমূহের মধ্যে ‘ফাইটিং আর্মস’ বা সাজোয়া এবং পদাতিক ইউনিটসমূহ বিরল সম্মান লাভ করতে পারে। এই সম্মান ও স্বীকৃতি পেতে একটি ইউনিটকে নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী আভিযানিক, প্রশিক্ষণ, খেলাধুলা, প্রশাসনিক ও দেশ গঠনমূলক কাজে নিপুণ দক্ষতা প্রদর্শন করতে হয়। সাজেয়া কোরের অনন্য পাঁচটি ইউনিট ইতিমধ্যে ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড পেয়েছে। একই ধারাবাহিকতায় সাজোয়া কোরের কনিষ্ঠতম রেজিমেন্ট ১২ ল্যান্সার জাতীয় পতাকা পেয়েছে। ১২ ল্যান্সারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ॥ ময়মনসিংহে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৯ পদাতিক ডিভিশনে ১৯৯৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ১২ ল্যান্সার একটি পূর্ণাঙ্গ রেজিমেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে একই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এই ইউনিটের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। এই ইউনিটের প্রধান অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন লে. কর্নেল আবু মোহাম্মদ আসলাম। এই ইউনিটটি এখন পূর্ণাঙ্গ কোর হিসাবে গড়ে উঠেছে। বৃহস্পতিবার এ কোরের পক্ষ থেকে কুচকাওয়াজের মাধ্যমে জানানো হয় অভ্যর্থনা। কুচকাওয়াজ বা প্যারেড পরিচালনা করেন লে. কর্নেল মোহাম্ম খায়রুজ্জামান মোল্লা। তার সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত প্যারেড কমান্ডার লে. কর্নেল একেএম কায়েস, প্যারেড এ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন মাশফিক আহমেদ মোড়ল। সুুসজ্জিত সৈনিক ও বাদক দলের মনোমুগ্ধ ও নৈপুণ্যকর কুচকাওয়াজ উপস্থিত অতিথিরা উপভোগ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী কুচকাওয়াজে অংশ নেয়া সৈনিকদের সঙ্গে ছবি তোলেন।
×