ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ওয়াহিদ নবি

ইতিবাচক অবদানই হোক রাজনৈতিক দলকে সমর্থনের কারণ

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ১১ নভেম্বর ২০১৫

ইতিবাচক অবদানই হোক রাজনৈতিক দলকে সমর্থনের কারণ

হেনরি কিসিঞ্জার যে দেশটি স্বাধীন হওয়ার অব্যবহতি পূর্বে ‘তলাবিহীন ঝুলি’ বলে উপহাস করেছিলেন। আজ সেই দেশ মাত্র ৪৫ বছরের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। জাতিসংঘও এই উন্নতি অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বাধীনতার চেতনা জনগণকে কত অনুপ্রাণিত করতে পারে বাংলাদেশ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এ উন্নতি কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বাংলার ইতিহাসে স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র একসঙ্গে একাত্তরের আগে কখনও ছিল না। দেশ শাসনের অভিজ্ঞতা তাই রাজনীতিবিদদের খুবই সীমিত ছিল। আমলারা কোন সময়ই রাজনীতিবিদদের আদর্শে পরিচালিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে দেশ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। এসব অবস্থার সুযোগ নিয়ে প্রথমে সেনানায়করা দেশ দখল করে। পরে তাদের সাহায্যে স্বাধীনতাবিরোধীরা দেশ দখলে রাখে বহুদিন ধরে। আমাদের দেশের বাস্তবতায় উন্নতি সাধন খুব সহজ ছিল না। উন্নতির গতি খুব দ্রুত ছিল না। আমরা আবার সহজেই হতাশ হয়ে পড়ি। এর কারণ হচ্ছে আমরা বাস্তবতার নিরিখে কোনকিছু মূল্যায়ন করি না। এসব কারণে খারাপ আমাদের চোখে যতটা পড়ে ভাল ততটা পড়ে না। আমরা দেখেছি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির একমাত্র শক্তি হচ্ছে নিন্দা করা। ভারত সব নিয়ে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ সব দিয়ে দিচ্ছে- এই ছিল তাদের বুলি। আর তার সঙ্গে তারা যোগ দিয়েছিল ধর্মের সেøাগান। স্বীকার করতেই হবে যে, এতে তাদের কাজ হয়েছিল। একাত্তরের খুনীরা স্বাধীনতার পতাকা দখল করেছিল। স্বাধীনতা ফলপ্রসূ হয় না যদি তার সঙ্গে দায়িত্ববোধ না আসে। গণতন্ত্র ফলপ্রসূ হয় যদি তার সঙ্গে থাকে সহনশীলতা। বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা সময় পেলাম কখন? আমরা চেতনা লাভ করবার সময় পেলে স্বাধীনতাবিরোধীদের জিজ্ঞেস করতাম, ‘আপনারা দেশের মানুষের জন্য কী করেছেন?’ অপরদিকে অভিজ্ঞতার স্বল্পতার জন্যই হোক বা বিরোধী শক্তির হট্টগোলের জন্যই হোক, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি তাদের অবদানের কথা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। যা কিছু তারা করতে পারেনি, কোন অসুবিধার জন্য তারা সেটা ব্যাখ্যা করেনি। বর্তমান সরকারের কিছু কিছু ইতিবাচক কাজের কথা উল্লেখ করতে চাই সংক্ষেপে। একটি শুধু সাবধানবাণী উচ্চারণ করব। এ সংক্ষিপ্ত আলোচনাকে কেউ যেন অবদানের স্বল্পতা মনে না করেন। কম্পিউটার যে কত উপকারী সে কথা আমরা সবাই জানি। এ লেখাটা তৈরি করবার জন্য যদি কম্পিউটারের সাহায্য না পেতাম তবে আমার অনেক বেশি সময় ও শক্তি ব্যয় করতে হতো। সরকার কম্পিউটার সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করে মানুষের উৎসাহ বাড়িয়েছে। সস্তায় কম্পিউটার সবার জন্য বাজারে ছেড়ে মানুষের বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের উৎসাহিত করেছে। ভবিষ্যত প্রজন্ম এ প্রচেষ্টায় উপকৃত হবে। বিনামূল্যে বই বিতরণ একটা অভূতপূর্ব ব্যাপার। জ্ঞানার্জন ছাড়া কোন জাতি কবে বা কোথায় উন্নত হয়েছে। এসব বই সবার জ্ঞান তৃষ্ণা বাড়িয়ে তুলবে আশা করি। কতবার দুর্ভিক্ষ হয়েছে এই দেশে। রাজনৈতিক কারণে হয়েছে, অন্যান্য কারণেও হয়েছে। কৃষি পদ্ধতির উন্নতি আর উন্নত বীজ অবশ্যই উৎপাদনে সাহায্য করে। সরকারের সাহায্য অবশ্যই প্রয়োজনীয় নানাভাবে। আজ আর দেশে মঙ্গা নেই। যেখানে আমাদের খাদ্য আমদানি করতে হতো আজ সেখানে আমরা খাদ্য রফতানি করছি। বর্তমান সরকারের সময়ে খাদ্য উৎপাদন ২০ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন হয়েছে। বর্তমান যুগে বিদ্যুত শুধু আরামের জন্য বা শুধু বিলাসিতার জন্য ব্যবহার করা হয় না। উৎপাদনের জন্য বিদ্যুত অপরিহার্য। বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুত উৎপাদন ৩০০২ মেগাওয়াট থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট হয়েছে। এতে মানুষ হঠাৎ করে বিদ্যুত চলে যাওয়ার আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়েছে। মানুষ এখন দৈনন্দিন জীবনের পরিকল্পনা করতে পারে। কৃষি আর কল-কারখানার উৎপাদন বেড়েছে, আরও বাড়বে বিদ্যুত উৎপাদন বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে। গার্মেন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান চীনের পরেই। প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার উপার্জিত হয় গার্মেন্ট শিল্পের কল্যাণে। বাংলাদেশের অর্থনীতি গার্মেন্ট শিল্পের ওপর বেশ কিছুটা নির্ভরশীল। বাংলাদেশের গার্মেন্ট উৎপাদনের রফতানির পরিমাণ নানা অসুবিধা সত্ত্বেও এটি একটি বিরাট অর্জন। এ অর্জন অক্ষুণœ রাখতে হবে। বাংলাদেশে এখন মুঠোফোন ব্যবহার করেন প্রায় এক কোটি লোক। নিকট অতীতে কত তদবির করতে হতো একটা ফোনের জন্য। শুধু তাই নয়, চাকরি সৃষ্টি হয়েছে কত এ মুঠোফোনের কারণে। দ্রুত যোগাযোগ সব ধরনের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাহায্য করছে। বিদেশে এখন বাংলাদেশের প্রায় ৮০ লাখ মানুষ কাজ করে। এরা প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠান। এতে তাদের পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে দেশবাসী উপকৃত হচ্ছে। এদের প্রতি সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণের দিকে সরকারের দৃষ্টি রাখতে হবে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে এখন বাংলাদেশের ৯ হাজার মানুষ কাজ করেন। এতে বিদেশী মুদ্রা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি বাড়ছে। শিক্ষিতের হার বাড়ছে। স্কুলে যাওয়ার মতো যাদের বয়স তাদের প্রায় সবাই এখন স্কুলে যায়। ২০০৮ সালে শিক্ষিতের হার ছিল শতকরা ৪৯ জন, আজ সেখানে শিক্ষিতের হার শতকরা ৬০ জন। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভাল হচ্ছে। ২০০৬ সালে গড় আয় ছিল ৪২৭ আর ২০১৩ সালে হয়েছে ৯১৪ ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ২০০৭ সালে ছিল সাড়ে সাত মিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি এখন ৬ দশমিক ৭, যেখানে ২০০৬ সালে ছিল ৫ দশমিক ৬। পরিসংখ্যান একটা উপভোগ করবার মতো বিষয় নয়, যার প্রধান কারণ হচ্ছে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন হয়। আমরা যদি শুধু একটি জিনিসের প্রতি লক্ষ্য করি তবেই বুঝব যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। ২০০৯ সালে ৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত আর এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে ৩ দশমিক ৮ লাখ মানুষ। তবে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে- জাতির গড় আয় ব্যক্তির আর্থিক অবস্থার প্রতিফলন নয় সব সময়। অমর্ত্য সেন আর জিন ড্রিজ তাদের ‘এন আনসারটেইন গ্লোরি‘ বইতে এ কথা ব্যাখ্যা করেছেন। ৪০৫১টি ইউনিয়নে তথ্যকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। বিশেষ ব্যবস্থায় ক্ষমতায় থেকে যুদ্ধাপরাধীরা প্রভূত অর্থ আর ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। সেসব নিয়ে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধার সৃষ্টি করেছিল বারবার। বর্তমান সরকারের দৃঢ়তার জন্য তারা সফল হয়নি। প্রত্যাশা থাকবে সরকারের কল্যাণমূলক কাজ চলতে থাকুক। ইতিবাচক কাজ হোক রাজনীতির আদর্শ। নিন্দাবাজি আমরা অনেক দেখেছি- আর নয়। লেখক : রয়াল কলেজ অফ সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো।
×