ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উদ্দেশ্য- সাকা মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হলে নাশকতা চালানো

চার পাকিস্তানী জঙ্গী প্রশিক্ষককে এনেছে জামায়াত-শিবির

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১০ নভেম্বর ২০১৫

চার পাকিস্তানী জঙ্গী প্রশিক্ষককে এনেছে জামায়াত-শিবির

শংকর কুমার দে ॥ কুখ্যাত দুই যুদ্ধাপরাধী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী) ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদ-াদেশ রায় কার্যকর করা হলে নাশকতা চালানোর জন্য জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে পাকিস্তানী চার জঙ্গী প্রশিক্ষককে। পাকিস্তানের এই চার নাগরিককে বাংলাদেশে এনেছে জামায়াত-শিবির। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএস ওই চার পাকিস্তানী জঙ্গী প্রশিক্ষককে বাংলাদেশ আসতে সাহায্য করেছে। রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেফতারকৃত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জেএমবির প্রশিক্ষক পাকিস্তানের নাগরিক ইদ্রিস আলী (৫৭), মোঃ শাকিল (৩৯), খলিলুর রহমান (৪৯) ও মোঃ ইকবালকে (৩৭) রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে এ ধরনের ভয়াবহ নাশকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পাকিস্তানের চার নাগরিককে জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া তথ্যমতে, বিগত তিন বছরে পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইশ-ই- মোহাম্মদের অর্ধশতাধিক সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াই নিয়মিত যোগাযোগ ও কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। তাদের অনেকেই উন্নত প্রযুক্তির অত্যাধুনিক অস্ত্র পরিচালনা, গ্রেনেড-বোমা তৈরি ও হামলায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও পারদর্শী। দেশী-বিদেশী জঙ্গীগোষ্ঠীকে সংগঠিত করার জন্য পাকিস্তানের নাগরিক জঙ্গী প্রশিক্ষকদের আনার তথ্য পেয়ে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জইশ-ই-মোহাম্মদের সদস্য পাকিস্তানের নাগরিক রেজোয়ানকে কিছু দিন আগে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার কাছ থেকে নানা ধরনের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য মাওলানা ওবায়দুল্লাহ্কে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। এছাড়া ডিবি পুলিশও কিছু দিন আগে লস্কর-ই-তৈয়বার সন্দেহে ৭ সদস্যকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এর আগে পাকিস্তানের নাগরিক লস্কর-ই-তৈয়বার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডো আবদুল মোতালিবকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের জঙ্গী সদস্য ও জঙ্গী গ্রুপের প্রশিক্ষকদের বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এনেছে জামায়াত-শিবির। যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে গত প্রায় তিন বছর ধরে দেশের ভেতরে যেসব নাশকতা, নৈরাজ্য, খুন, জখম, বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করা হয়েছে, তার পেছনে পাকিস্তান থেকে আনা জঙ্গী প্রশিক্ষকদের একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানীর উত্তরার এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে গত শনিবার জঙ্গী প্রশিক্ষক পাকিস্তানের চার নাগরিককে গ্রেফতার করে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এর আগেও রাজধানীর টঙ্গী ও উত্তরা থেকে লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য পাকিস্তানের তিন নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়। রাজধানীর উত্তরা ও টঙ্গী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় তিন পাকিস্তানী নাগরিক লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য সৈয়দ আবদুল কাইউম আজহারী ওরফে সুফিয়ান, মোহাম্মদ আশরাফ ওরফে জাহিদ ও মোহাম্মদ মনোয়ার আলীকে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পাকিস্তানী নাগরিক লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য মোবাশ্বেরকে ১০ হাজার টাকার জাল নোটসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব। তাদের ছাড়াও প্রায় তিন বছরের মধ্যে অর্ধ ডজনের বেশি পাকিস্তানী নাগরিক, যারা লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন গোয়েন্দারা। এর মধ্যে লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য মাওলানা মনছুর, মাওলানা ওবায়দুল্লাহকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের অর্ধ শতাধিক সদস্য বাংলাদেশে অবস্থান করার তথ্য পাওয়া যায় তখন। এর মধ্যে সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্যও আছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের নাগরিক জঙ্গী প্রশিক্ষক ও জঙ্গী সদস্যরা বাংলাদেশে আসতে শুরু করলেও তখন তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কিন্তু দুই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ- রায় কার্যকর করার আগে দেশের ভেতরে দুই বিদেশী খুন, দুই পুলিশ খুন, হোসেনী দালানের তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলায় হতাহতের ঘটনা, প্রকাশক, লেখক ও ব্লগার খুনের ঘটনায় চোখ খুলে দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, বাংলাদেশকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যাতায়াতের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গী সব সংগঠন ও যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠীগুলো মদদ ও ছত্রছায়া দিয়ে ডেকে আনছে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলোকে। পাকিস্তান ও ভারতে যে একের পর এক জঙ্গী হামলা হচ্ছে তার রেশ যে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশও জঙ্গী হামলার টার্গেট হতে পারে, তা প্রায় তিন বছর আগেই সতর্ক করে দিয়েছে মার্কিন সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর দ্য স্টাডি অব টেররিজম এ্যান্ড রেসপন্সেস টু টেররিজম (এসটিএআরটি) দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদ নিয়ে সাউথ এশিয়ায় টেররিজম পোর্টাল সংস্থার ওয়েবসাইটে জামায়াত-শিবির সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অধিদফতরের সঙ্গে এসটিএআরটি কর্মরত থাকার কারণে এ সংস্থার তালিকায় জামায়াত-শিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তুলে ধরার অনেক গুরুত্ব ও ভয়াবহ ইঙ্গিত দিচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে দেশের জঙ্গী সংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততার সুবাদে পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বার সহায়তায় আল কায়েদা বাংলাদেশে এসে ঘাঁটি গড়ার সুযোগ পেয়েছে। তদন্তের তদারকির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বার নেতা ভারতীয় জঙ্গী মাওলানা মনসুর আলীকে সম্প্রতি গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বার আরেক নেতা মুফতি ওবায়দুল্লাহ্কে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, বাংলাদেশে তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর জন্য পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র অর্থ ও অস্ত্র তাদের যোগান দিচ্ছে। বাংলাদেশের হুজি ও জেএমবির জঙ্গীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে তাদের নেপথ্যে থেকে জামায়াত-শিবিরই মদদ দিয়ে যাচ্ছে। আল কায়েদা পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ও বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠন জেএমবি ও হুজির সহায়তায় বাংলাদেশে ঘাঁটি গড়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের পর আত্মগোপনে থাকা অন্তত অর্ধশত লস্কর-ই-তৈয়বা জঙ্গীর খোঁজে মাঠে নেমেছেন গোয়েন্দারা। প্রসঙ্গত, গত শনিবার রাজধানীর উত্তরা থেকে জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে উত্তরা থেকে ৪ পাকিস্তানী নাগরিক ইদ্রিস আলী (৫৭), মোঃ শাকিল (৩৯), খলিলুর রহমান (৪৯) ও ইকবাল (৩৭) এবং তিন বাংলাদেশী পাকিস্তানীদের সহযোগী জেএমবি সদস্য মোঃ ফরমান (৩৫), মোঃ বাবুল খান (৪৫) ও শহীদ (৪০) গ্রেফতার হয়। তারা দেশের ভেতরে নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছিল। উদ্দেশ্য সরকারের পতন ঘটানো। সরকারের পতন ঘটাতে নানা ধরনের নাশকতা চালানোর উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। মারাত্মক নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করতেই তারা বৈঠক করছিল। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ব্যাপক বিস্তার ঘটাতে, জঙ্গী সংগঠনগুলোতে নতুন সদস্য সংগ্রহ করতে, জনমনে ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টির পরিকল্পনা করছিল বলে জানিয়েছেন ডিএমপির এই কর্মকর্তা।
×