ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

চেকপোস্টে পুলিশ হত্যার ঘটনায় নানামুখী তদন্ত চলছে

রাইফেলে গুলি থাকা সত্ত্বেও সহকর্মীদের পালিয়ে যাওয়া রহস্যজনক

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১০ নভেম্বর ২০১৫

রাইফেলে গুলি থাকা সত্ত্বেও সহকর্মীদের পালিয়ে যাওয়া রহস্যজনক

গাফফার খান চৌধুরী/সৌমিত্র মানব ॥ সাভারের আশুলিয়া ও ঢাকার গাবতলীর আমিনবাজারে চেকপোস্টে পুলিশ হত্যা এবং হোসেনী দালানে বোমা মেরে দুইজনকে হত্যাসহ শতাধিক লোককে আহত করা একসূত্রে গাঁথা। ঘটনার সঙ্গে ছাত্র শিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডার ও জেএমবি জড়িত বলে সন্দেহ তদন্তকারী সংস্থাগুলোর। সন্দেহের বাইরে নেই হতাহত ৬ পুলিশও। ইতোমধ্যেই ৪ পুলিশকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। হতাহতদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত পরিচিতি এবং চাকরিকালীন কর্মকা-ের বিষয়ে বিস্তর তদন্ত চলছে। কয়েক দফায় জেরা করা হয়েছে বরখাস্ত হওয়া ৪ পুলিশকে। গাবতলীতে চেকপোস্টে ছুরিকাঘাতে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার পর সারাদেশে পুলিশকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশের পর সাভারে চেকপোস্টে আবারও পুলিশ হত্যার ঘটনা রীতিমতো রহস্যের জন্ম দিয়েছে। সাভারের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলা, ভীরুতার পরিচয় দেয়া, সহকর্মীদের রক্ষা করার ন্যূনতম চেষ্টা না করা, সার্বিকভাবে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণœ করা, দেশ-বিদেশে পুলিশকে একটি দুর্বল বাহিনী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টার কারণে এবং ভবিষ্যতে এমন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে অভিযুক্ত ৫ পুলিশকে চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। চলতি বছরের ৪ নবেম্বর সকালে সাভারের আশুলিয়ার নন্দনপার্কের সামনে পুলিশ চেকপোস্টে ফিল্মিস্টাইলে হামলার ঘটনাটি ঘটে। হামলাকারীদের এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে আহত শিল্প পুলিশের কনস্টেবল মকবুল হোসেন ওই দিনই সাভার এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। গুরুতর আহত অপর কনস্টেবল নুরে আলম সিদ্দিকী এখনও চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা গুরুতর। ঘটনাটি সিআইডির তরফ থেকেও তদন্ত হচ্ছে। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় ২৫ জনের লিখিত সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। কয়েক দফায় জেরা করা হয়েছে ক্লোজ হওয়া এসআই হাবিব ও সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ৩ কনস্টেবলকে। আহত কনস্টেবল নূরে আলমের জবানবন্দীও নেয়া হয়েছে। জবানবন্দী ও ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামত পর্যালোচনা করা হচ্ছে। অন্তত ১০ দিন আগে চেকপোস্টটিকে টার্গেট করা হয়। শুভেচ্ছাসহ আশপাশের হোটেলে বেশকিছু দিন ধরেই সন্দেহভাজন লোকজনের যাতায়াত ও অকারণ অবস্থান ছিল। হামলাটি একেবারেই পরিকল্পিত। মূল হামলাকারী ২ জন হলেও পুরো হামলা প্রক্রিয়ার সঙ্গে অন্তত ৬ জন ছিল। এছাড়া আশপাশের এলাকার ওপর নজরদারি করতে অনেকেই ছিল। ঘটনার সময় নিহত ও চিকিৎসাধীন কনস্টেবল চেকপোস্টে ছিল। বাকি ৩ পুলিশ রাস্তার অপরপ্রান্তে ছিল। সেখানে একটি চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। দুই কনস্টেবলকে যেখানে হামলা করা হয়েছে, সেখান থেকে অপর ৩ কনস্টেবলের দূরত্ব ছিল ৫ থেকে ৬ গজ। যখন হামলাকারীরা দুইজনকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে, তখন অপর ৩ কনস্টেবল অনায়াসে সেখানে দাঁড়িয়েই রাইফেল তাক করে গুলি চালাতে পারতেন। তাদের রাইফেলে গুলি ছিল। রাইফেলের ম্যাগাজিনে গুলি না থাকার যে তথ্য ইতোমধ্যেই প্রচারিত হয়েছে, তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ৩ কনস্টেবল সেখানে দাঁড়িয়ে গুলি করতে পারতেন। কিন্তু তারা সেটি করেননি। কেন করেননি, সে বিষয়ে বিস্তর অনুসন্ধান চলছে। তারা সহকর্মীদের রক্ষা করার ন্যূন্যতম চেষ্টা পর্যন্ত করেননি। শুধু তাই নয়, তারা রাইফেল ফেলে পাশের হোটেল লাগোয়া শালবনে গিয়ে আশ্রয় নেন। যেটি খুবই রহস্যজনক। ছুরিকাঘাতে আহত হওয়ার পর দুই কনস্টেবল দৌড়ে অপর ৩ কনস্টেবলের কাছে গিয়ে পড়ে যান। তারপরও তারা সহকর্মীদের রক্ষা করেননি। তারা পালিয়ে যান। এমনকি হামলাকারীরা যখন পালিয়ে যায়, তখনও পেছন থেকে কনস্টেবলরা গুলি চালাতে পারতেন। সে কাজটিও কেন করেননি তা সত্যিই রীতিমতো রহস্যের জন্ম দিয়েছে অথচ পুলিশের আইনে নিজের এবং সরকারী জানমাল রক্ষায় গুলি চালানোর বিধান আছে। ঘটনার সময় পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবের উপস্থিত না থাকার বিষয়টিও রহস্যের জন্ম দিয়েছে। এজন্য চেকপোস্টে দায়িত্বে থাকা ৬ পুলিশ সম্পর্কেই বিস্তর তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। নিহত পুলিশ কনস্টেবল ছাড়াও অপর ৫ জনের পারিবারিক, ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক আদর্শসহ নানা বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হামলার সঙ্গে কোন পুলিশ সদস্যের যোগসাজশ আছে কিনা, সেটিও তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে। ভীরুতা, দায়িত্বে অবহেলা, দেশ-বিদেশে বাংলাদেশ পুলিশের সুনাম ক্ষুণœ করার দায়ে ৫ পুলিশকে চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়া হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডির এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, গত ২২ অক্টোবর রাজধানীর গাবতলীর আমিনবাজারে চেকপোস্টে ছাত্র শিবিরের ছুরিকাঘাতে দারুসসালাম থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক ইব্রাহিম মোল্লা হত্যার পর পুলিশ সদর দফতর ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তরফ থেকে পুলিশকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করার নির্দেশ দেয়া হয়। এমন নির্দেশের পর চেকপোস্টে হামলা করে এক পুলিশকে হত্যার ঘটনা রীতিমতো রহস্যের জন্ম দিয়েছে। এই কর্মকর্তা বলছেন, গাবতলী ও আশুলিয়ায় চেকপোস্টে পুলিশ হত্যা এবং হোসেনী দালানে বোমা হামলা একসূত্রে গাঁথা। গাবতলীতে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার পর ছাত্র শিবিরের বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলা ছাত্র শিবিরের সাথী মাসুদ রানা গ্রেফতার হয়। তার তথ্যমতে, ওই রাতেই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে ৫টি হ্যান্ডগ্রেনেডসহ এক জামায়াত নেতা তার দুই ছেলে ছাত্রশিবির কর্মী গ্রেফতার হয়। উদ্ধারকৃত হ্যান্ডগ্রেনেড এবং গত ২৩ অক্টোবর রাতে পুরান ঢাকার হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলে হামলায় ব্যবহৃত হ্যান্ডগ্রেনেড হুবহু এক ও অভিন্ন। ঘটনাস্থল থেকে ২টি হ্যান্ডগ্রেনেড উদ্ধার হয়। বোমা হামলায় দুইজনের মৃত্যু ও শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। জিজ্ঞাসাবাদে মাসুদ রানা পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যাকারী একই উপজেলা ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি কামাল বলে নিশ্চিত করে। কামাল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যও দেয়। তাকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে দিতে এবং দেশব্যাপী চলমান সাঁড়াশি অভিযানে ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্র শিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডাররা এমন চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে। এ বিষয়ে ন্যূনতম কোন সন্দেহ নেই। হামলাকারীদের গ্রেফতারে আশপাশের এলাকার সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা চলছে। বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। এদিকে বুধবার সাময়িক বরখাস্ত পুলিশের তিন কনস্টেবলকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত ৭ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। এ সংক্রান্ত অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক আজহারুল ইসলামের দায়ের করা মামলাটির তদন্ত করছেন আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দীপক কুমার সাহা। পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সিআইডি ঘটনাটি তদন্ত করছে। ঘটনাস্থল থেকে প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে সিআইডি। এ ব্যাপারে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনাটির সার্বিক দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
×