ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুচির বিপুল বিজয়

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১০ নভেম্বর ২০১৫

সুচির বিপুল বিজয়

নাজিম মাহমুদ ॥ মিয়ানমারের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জয়ের পথে আউং সান সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি বা এনএলডি। দীর্ঘ ২৫ বছর পর গত রবিবার অনুষ্ঠিত এই সাধারণ নির্বাচনে কার্যত ধরাশায়ী হয়েছে শাসক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা ইউএসডিপি। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে দীর্ঘদিন পর গণতন্ত্রের সূর্য উদিত হতে যাচ্ছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। পার্লামেন্টের উচ্চ ও নিম্নকক্ষের মোট ৬৬৪ আসনের মধ্যে সরকার গঠনের জন্য এনএলডিকে ৬৭ শতাংশ আসন পেতে হবে। কিন্তু মনে করা হচ্ছে অন্তত ৭০ শতাংশ আসন পেয়ে পার্লামেন্টে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছে সুচির দল। নির্বাচন কমিশন এখনও পূর্ণ ফলাফল প্রকাশ করতে পারেনি। আনুষ্ঠানিক ফল পেতে অন্তত ১০ দিন অপেক্ষা করতে হবে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে পরাজয় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে জান্তা সমর্থিত দল ইউএসডিপি। খবর বিবিসি, এএফপি, আলজাজিরা ও টাইমস অব ইন্ডিয়া অনলাইনের। ফলাফল প্রকাশ শুরুর পর সোমবার সকালে ইয়াঙ্গুনে এনএলডির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আগত নেতা এবং কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে ৭০ বছর বয়সী সুচি বলেন, নির্বাচনের ভোটযুদ্ধ শেষ হয়েছে। এতে জনগণ যেভাবে জেগে উঠে, তাতে গণতন্ত্রের জাগরণ ঘটেছে বলে আমার মনে হয়। আমরা মিয়ানমারবাসীকে অভিনন্দন জানাই। তিনি আরও বলেন জনগণ সরকারীভাবে ফল ঘোষণার জন্য অধীর অপেক্ষায় রয়েছে। সোমবার সকালে দলীয় কার্যালয়ে পৌঁছালে করতালি আর সেøাগানে প্রিয় নেত্রীকে স্বাগত জানান নেতাকর্মীরা। এ সময় উচ্ছ্বসিত নেতাকর্মীদের বুকে বুক মিলিয়ে আনন্দ উদযাপন করতে দেখা যায়। কার্যালয়ে ঢুকে প্রথমে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের অভিনন্দন জানান নোবেল বিজয়ী এই নেত্রী। সুচি বলেন শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে। এটা যেমন সুখবর। তেমনি দ্রুত সরকারী ফলাফল ঘোষণা হবে, এটাও জনগণের দাবি। তিনি বলেন এখনও নির্বাচনের সরকারী ফলাফল ঘোষণা হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে কি ঘটতে যাচ্ছে তা এখন জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। সোমবার প্রথমে ইয়াঙ্গুনের ১৬টি আসনের ফল ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে ১৬টিতেই বিপুল ব্যবধানে জয় পায় এনএলডি। এরপর পরাজয় স্বীকার করে ইউএসডিপি মুখপাত্র উইন হাতায়ে বলেন, ভাবিনি আমরা এভাবে হেরে যাব। আমরা মিয়ানমারের জনগণের জন্য অনেক কাজ করেছি। তবে জনগণের রায় মেনে নিচ্ছি আমরা। পরাজয়ের কারণ খতিয়ে দেখা হবে। তবে পরিপূর্ণ ফলাফল আসলে কী হবে তা আমরা নিশ্চিত নই। তবে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন কথা বলেননি দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট থিয়েন সেইন। তবে নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন ফলাফল যা-ই হোক তা সরকার ও সেনাবাহিনী মেনে নেবে। এদিকে ইয়াঙ্গুনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে সামরিক জান্তা সমর্থিত ইউএসডিপির বাঘাবাঘা সব নেতারা বিপুল ব্যবধানে এনএলডির অপেক্ষাকৃত জুনিয়র নেতাদের কাছে হেরে গেছেন। এই তালিকায় পার্লামেন্ট স্পীকার শোয়ে মানও রয়েছেন। তিনিও পরাজয় মেনে নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। এদিকে নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জিততে চললেও সুচির দল সরকার গঠন করতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে দেশটির গণতন্ত্রকামী জনতা। কারণ দেশটির পার্লামেন্টের মোট আসনের মধ্যে ২৫ শতাংশ সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ। আবার এই নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কড়া সমালোচনা রয়েছে। কারণ দেশটির রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ কয়েকটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়েছে। এনএলডি অথবা ইউএসডিপি থেকে কোন মুসলিমকে প্রার্থী করা হয়নি। আবার সুচিকে প্রেসিডেন্ট পদের বাইরে রাখা হয়েছে। সামরিক জান্তা প্রবর্তিত বর্তমান সংবিধানে বলা হয়েছে কোন বিদেশী নাগরিককে বিয়ে করলে অথবা কোন প্রার্থীর গর্ভে বিদেশী সন্তান জন্ম হলে তিনি প্রেসিডেন্ট অথবা ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে পারবে না। তবে সুচি প্রেসিডেন্ট হতে না পারলে আর তার দল সরকার গঠনের সুযোগ পেলে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও এনএলডির প্রবীণ নেতা উ থিনকেই প্রেসিডেন্ট করতে পারেন সুচি। এদিকে মিয়ানমারের নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। তিনি বলেছেন এই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে একধাপ এগোল মিয়ানমার। সোমবার সকালে ইয়াঙ্গুনে এনএলডির কর্মী সবজি বিক্রেতা ইয়ে ইয়ে বলেন, নির্বাচনের ফল কী হবে আমরা আঁচ করতে পারছি। আমার মনে হয় সবকিছুতেই পরিবর্তন আসছে। আমরা পরিবর্তন চাই। মিয়ানমারের নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, রবিবারের নির্বাচনে ভোটার ছিল প্রায় তিন কোটি। অন্তত ৯০টি দলের কমপক্ষে ছয় হাজার প্রার্থী নির্বাচনে লড়েন। প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে। মিয়ানমারে এই নির্বাচন একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে ভূমিকা রাখবে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে। গণতন্ত্রের জাগরণ- সুচি ॥ মিয়ানমারের নির্বাচনে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) বিপুল বিজয়ের পথে দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন আউং সান সুচি; এ সাফল্যকে তিনি বলেছেন ‘গণতন্ত্রের জাগরণ’। দীর্ঘকাল সেনাশাসনে থাকা মিয়ানমারে ২৫ বছর পর রবিবার প্রথমবারের মতো সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ ভোট হয়। নির্বাচন কমিশন এখনও ফল ঘোষণা না করলেও প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যে বড় জয় আশা করছে গণতন্ত্রপন্থী এনএলডি। আর সেনা সমর্থনে ক্ষমতায় থাকা ইউনিয়ন সলিডারিটি এ্যান্ড ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (ইউএসডিপি) ইতোমধ্যে হার স্বীকার করে নিয়েছে। সোমবার এনএলডির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সমবেত নেতাকর্মী-সমর্থকদের সামনে সুচি বলেন, নির্বাচনের ভোটযুদ্ধ শেষ হয়েছে। এতে জনগণ যেভাবে জেগে উঠে, তাতে গণতন্ত্রের জাগরণ ঘটেছে। দেশবাসী সরকারীভাবে ফল ঘোষণার জন্য ‘অধীর অপেক্ষায়’ রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। সুচি দলীয় কার্যালয়ে পৌঁছালে করতালি আর সেøাগানে তাকে স্বাগত জানান নেতাকর্মীরা। উচ্ছ্বসিত নেতাকর্মীদের বুকে বুক মিলিয়ে আনন্দ উদযাপন করতে দেখা যায় এ সময়। কার্যালয়ে ঢুকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের অভিনন্দন জানান নোবেলবিজয়ী সুচি, যাকে গণতন্ত্রের লড়াইয়ের গৃহবন্দী থাকতে হয়েছে দীর্ঘদিন। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে। এটা যেমন সুখবর। তেমনি দ্রুত সরকারী ফলাফল ঘোষণা হবে, এটাও প্রত্যাশা করছে দেশবাসী। এখনও নির্বাচনের সরকারী ফলাফল ঘোষণা হয়নি। তারপরও কী ঘটতে যাচ্ছে- তা জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। কেবল নেতাকর্মীরা নন, ইয়াঙ্গুনের সাধারণ ভোটাররাও নির্বাচনে এনএলডির জয় দেখছেন। স্থানীয় স্কুলের শিক্ষিকা সুই চি মুন বলেন, ভোটে আমি অভিভূত। গণতন্ত্রের বিজয়কে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। আমি ভীষণ এক্সাইটেড। এনএলডিই এবার ক্ষমতায় যাবে বলে আশাবাদী উ মুন, যিনি আগের দিন নির্বাচনে একটি ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেছেন। সোমবার দুপুরে তিনি বলেন, আমার কেন্দ্রে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত গণনা শেষে দেখা গেল এনএলডির প্রার্থী পেয়েছেন ১ হাজার ১২ ভোট, আর ইউএসডিপির প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ৪০ ভোট। এ থেকে বোঝা যায়, মানুষের সমর্থন কোথায় যাচ্ছে। দেশী-বিদেশী নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রবিবারের ভোটগ্রহণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। এনএলডির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন টাউনশিপে ৭০ শতাংশ প্রার্থীর জয়ের আশা করছেন তারা। আর সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে এনএলডিপিকে ৬৭ শতাংশ আসনে জয়ী হতে হবে। অবশ্য দল জয় পেলেও বিদেশীকে বিয়ে করায় বর্তমান আইন অনুযায়ী মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না সুচি। দেশটির ৪৪০ আসনের সংসদ ‘পিথু হালতাউয়ের’ ১১০টি আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত থাকায় সংবিধান সংশোধন করাও হবে কঠিন কাজ। সোমবার তিনি দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে প্রবীণ নেতা ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান উ থিন ওকে ধন্যবাদ জানান। ধারণা করা হচ্ছে, সরকার গঠনের যোগ পেলে ৮৮ বছর বয়সী সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী উ থিনকেই প্রেসিডেন্ট করতে পারেন সুচি। পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন এনএলডি নেত্রী। এদিকে ক্ষমতাসীন ইউএসডিপির নেতারাও যার যার নির্বাচনী এলাকা থেকে ইয়াঙ্গুনে ফিরতে শুরু করেছেন। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ভিড় করছেন নেতাকর্মীরা। ইউএসডিপির পরবর্তী নেতা হতে পারেন পার্লামেন্টের স্পিকার উ সুই মান, যিনি পিউ বোগো আসনে নির্বাচন করেছেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৯১ সালে সু চি শান্তিতে নোবেল পেলে এনএলডি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসে। ২০১২ সালের উপ-নির্বাচনে ৪৫টি আসনের মধ্যে ৪৩টিতে জয়ী হয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হয় তার দল। এর আগে ২০১০ সালের ৭ নবেম্বর পার্লামেন্ট নির্বাচন হলেও তাতে অংশ নেয়নি এনএলডি। ইউএসডিপি তখন থেকেই ক্ষমতায় রয়েছে। বর্তমান পার্লামেন্টের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ৩০ জানুয়ারি। নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে।
×