ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাকারিয়া স্বপন

লেখালেখি বেনামে করতে হবে কেন?

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৯ নভেম্বর ২০১৫

লেখালেখি বেনামে করতে হবে কেন?

বাংলাদেশে একটা অদ্ভুত কালচার কিভাবে যেন ঢুকে গেছে, তা হলো বেনামে লেখালেখি করা। একজন দু’জন নয়, অসংখ্য মানুষ নিজের নাম গোপন রেখে লেখালেখি করেন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্লগ সাইটগুলো চলে বেনামে, কিংবা ভিন্ন নামে। পাশাপাশি ফেসবুকে বিশাল একটা গোষ্ঠী ভার্চুয়াল জীবনযাপন করেন ভুয়া আইডি দিয়ে। সেখানেও তারা বেনামেই লেখালেখি করে থাকেন। ছাত্রজীবন থেকে যখন টুকটাক লেখালেখি শুরু করি, তখন নিজের নামটি পত্রিকায় ছাপানো হরফে দেখতে পাব, এরচেয়ে সুখের কিংবা প্রাপ্তির আর কিছু ছিল বলে মনে পড়ে না। লেখা ছাপা হলে টাকা পাবো, সেটা তো মাথায় ছিলই না, বরং কোন্ পত্রিকা আমার লেখা ছাপিয়েছে তার জন্য কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ঠিক কোন্ পত্রিকায় আমার লেখা প্রথম ছাপা হয়েছিল সেটা এখন মনে নেই। তবে স্কুলে পড়া অবস্থাতেই আমার লেখা জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছিল, সেটা মনে আছে। এখনও মনে পড়ে, লেখাটি পত্রিকার ঠিকানায় পাঠিয়ে প্রতিদিন পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে সেই পত্রিকার প্রতিটি পাতা তন্নতন্ন করে দেখতাম, নিজের লেখা সেখানে দেখা যায় কিনা। একদিন সেই ঘটনাটি ঘটলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। দৌড়ে গেলাম রেলস্টেশনেÑ সংবাদপত্র বিক্রি হয় ওখানে। দুই কপি কিনে বাসায় নিয়ে আসি। কাউকে দেখাই না। বিছানায় শুয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের লেখা নিজেই পড়ি হাজারবার। সারারাত ঘুম নেই উত্তেজনায়। প্রথম প্রেমে পড়ার চেয়েও বেশি উত্তেজনা। সেই পত্রিকা স্কুলে নিয়ে যাই না, যদি বন্ধুরা ছিঁড়ে ফেলে। বাসায় এমন জায়গায় রেখে দেই, যেন মা পুরনো পত্রিকা ভেবে বিক্রি করে দেয়। তারপর যখন নিয়মিত লিখতে শুরু“করি, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখতে পাই, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করেও সেই অক্ষরগুলোর প্রতি প্রেম কমেনি এতটুকু। আমি এখনও অনেক সময় নিজের নাম ছাপানো দেখতে লজ্জা পাই। এক ধরনের প্রেম এখনও রয়ে গেছে। আমি অনেকবার নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি, কেন এমন হয়! এর একটা উত্তর আমার কাছে আছে। আমি লিখি প্রচ- এক ভালবাসা থেকে। এর প্রতিটি বর্ণের সঙ্গে আমার প্রেম আছে, ভালবাসা আছে। একজন ভাস্কর শিল্পী একটু একটু খোদাই করে যেভাবে একটি কাজ শেষ করেন, আমার লেখার কষ্ট তার থেকে কম নয়। যা লিখতে চেয়েছি, সেটা সঠিক না হলে কতবার কাটাকাটি করি- সেটা তো আর পাঠক বুঝতে পারেন না। আমি বিশ্বাস করি, এই পৃথিবীর একটি অন্যতম কঠিন কাজ হলো লেখালেখি করা। যে কারণে এটাকে আমি প্রফেশন হিসেবে নেইনি। একজন মা যেমন অনেক কষ্টের পর একটি শিশুকে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন, একজন লেখকের মর্মবেদনা তার থেকে কম বলে আমি মনে করি না। সেই কষ্টের ফল যখন ছাপার অক্ষরে দেখা যায়, তখন সেই লেখার সঙ্গে এক ধরনের প্রেম তৈরি হয়। নিজের লেখা টেবিলে রেখে কফি খেতে ভাল লাগে, কাজের ফাইলের ভেতরে নিজের লেখা রেখে দিতে ভাল লাগে, ওই পত্রিকার ঘ্রাণ নিতে ভাল লাগে। এই প্রচ- ভাল লাগার জন্যই হয়ত লজ্জা এসে ভর করে। কাউকে অনেক ভাল লাগলে তার ছবি দেখতে যেমন লজ্জা লাগে, গভীর প্রেমে পড়লে তার উপস্থিতি যেমন লজ্জায় ফেলে দেয়, বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলে মেয়েটি যেমন লজ্জায় বন্ধুদের কাছে হেসে ওঠে, কিংবা নিজের মতো খোলা ছাদে তার কথা ভেবে একা একাই লজ্জায় পড়ে যায়- আমার লেখার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তেমনি। আই জাস্ট লাভ মাই রাইটিং। বর্তমান সময়ের লেখকদের হয়ত সেই অনুভূতি হয় না। কারণ তাদের বড় একটা অংশ লেখেন অনলাইনে। সেখানে কতজন লাইক দিল, কতজন শেয়ার দিল- সেটাই হয়ত মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমি এখনও কিছুটা সেকেলে। ছাপার অক্ষর আমাকে এখনও টানে। পত্রিকার মেকআপ দেখতে ভাল লাগে। আমার প্রিয় সেই লেখার সঙ্গে, আমার নাম যাবে না- সেটা আমি ভাবতেই পারি না। আমি তো টাকার জন্য লিখি না; আমি ওই এক মুহূর্তের লজ্জাটুকুর জন্য লিখি। আমি আমার ভাল লাগার জন্য লিখি। আমি মাঝে মাঝে নিজেকেই নিজে ধন্যবাদ দেই যে, আমার ভেতর এমন একটা ভাল লাগা কাজ করে। যতদিন বেঁচে আছি, যতদিন লিখতে থাকব- নিজের সেই ভাল লাগা থেকেই; নিজের সেই আনন্দের জন্যই নিজের নামেই। দুই. এই পৃথিবীতে অনেক বিখ্যাত লেখক ছদ্মনামে লিখেছেন। কেউ কেউ দ্বিতীয় আরেকটি ব্র্যান্ডই তৈরি করে ফেলেছেন। ইংরেজীতে এটাকে বলে ‘পেন নেম।’ অনেক কবি, সাহিত্যিক, লেখক, কলামিস্ট ছদ্মনামে এত বিখ্যাত হয়েছেন যে, তাঁদের আসল নামে কেউ চিনেও না। যেমন বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় ছদ্মনাম ‘বনফুল’ নামেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। ঠিক তেমনি ‘যাযাবর’-কে বিনয় মুখোপাধ্যায় বললে অনেকেই চিনবে না। অন্যদিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘নীল লোহিত’ নামে লিখলেও এ নামে তিনি ততটা প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি। ইন্টারনেটে ঘাটতে গিয়ে দেখলাম জনৈক এইচ এম পারভেজ বাংলাভাষার বেশ কিছু লেখকের ছদ্মনামের তালিকা তৈরি করে রেখেছেন। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সেই তালিকাটা এখানে প্রকাশ করছি এবং তাকে কোট করছি। ব্রাকেটের ভেতর ছদ্মনামটি দেয়া হলো- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভানুসিংহ), প্যারিচাঁদ মিত্র (টেকচাঁদ ঠাকুর), কাজেম আল কোরায়শী (কায়কোবাদ), শওকত ওসমান (শেখ আজিজুর রহমান), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (নীল লোহিত), সমরেশ বসু (কালকূট), প্রমথ চৌধুরী (বীরবল), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (অনিলা দেবী), কালীপ্রসন্ন সিংহ (হুতুম পেঁচা), বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল), বিমল ঘোষ (মৌমাছি), ড. মনিরুজ্জামান (হায়াত মাহমুদ), রাজশেখর বসু (পরশুরাম), অনন্ত বড়ু (বড়ু চ-ীদাস), নীহারঞ্জন গুপ্ত (বানভট্ট), মীর মশাররফ হোসেন (গাজী মিয়া)। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নয়টি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন : ভানুসিংহ ঠাকুর; অকপটচন্দ্র ভাস্কর; আন্নাকালী পাকড়াশী; দিকশূন্য ভট্টাচার্য; নবীন কিশোর শর্মণ; ষষ্ঠীচরণ দেবশর্মা; বানীবিনোদ বিদ্যাবিনোদ; শ্রীমতী কনিষ্ঠা; শ্রীমতী মধ্যমা। বিখ্যাত লেখকরা কেন ছদ্মনামে লিখতেন, তার নানান রকমের দর্শন রয়েছে। তবে সাহিত্য ক্ষেত্রে এর প্রচলন বেশি। এর একটি বড় কারণ হতে পারে যে, তিনি একেক নামে একেক ধরনের লেখাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তার সব কাজ একই নামে ব্র্যান্ডিং করতে চাননি। তার কঠিন লেখাগুলো একটি নামে, চটুল লেখাগুলো আরেক নামে, স্যাটায়ারগুলো ভিন্ন নামে লিখলে পাঠকদের কাছে চিনতে এবং বুঝতে হয়ত সুবিধা হয়- সেটা একটা কারণ হতে পারে। আবার অনেক সময় লেখক যে নিজে নাম বদলান তা কিন্তু নয়। অনেক বড় ক্ষমতাশালী প্রকাশক অনেক লেখকের নাম পাল্টে দিয়েছেন, যেমনটি করেছেন অনেক সিনেমার পরিচালক নায়ক-নায়িকাদের বেলায়। অনেকে আবার পুরো পরিচয় গোপন রাখতেই ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন। আবার কখনও একই নামে আরেকজন খ্যাতিমান ব্যক্তি থাকার কারণেও অনেকেই নাম পরিবর্তন করেছেন। বাংলা দৈনিক পত্রিকাতে অনেক বিখ্যাত লেখক ছদ্মনামে কলাম লিখেছেন। এখন যদিও তার প্রবণতা কমে গেছে। অনেক কঠিন গুরুগম্ভীর লেখা আমি পড়েছি, যেগুলো ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছিল। যারাই ছদ্মনামে লিখেছেন, তাদের একধরনের এক্সপেরিমেন্ট ছিল। কেউ কেউ সফল হয়েছেন, কেউ হননি। তবে, তারা লেখক হিসেবে যথেষ্ট ক্ষমতাশালী ছিলেন। বিষয়টি এমন নয় যে, তিনি মোটেও ভাল লেখক ছিলেন না। আমার তো মনে হয়, একজন খুব শক্তিশালী লেখকই কেবলমাত্র ছদ্মনামে লেখার মতো সাহস করতে পারেন। কারণ, ছদ্মনামে একটি লেখা প্রতিষ্ঠা করা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। লেখার মান যথেষ্ট ভাল না হলে, পাঠক তা গ্রহণ করবে না। সেই সাহস দেখাতে পেরেছেন খুব কম লেখক। তবে অবাক বিষয় হলেও সত্যি এটা যে, বাংলা ভাষায় যারা ব্লগ লিখেন, তাদের সিংহভাগই ছদ্মনামে লিখেন। বাংলা ভাষায় ছদ্মনামে লিখতে লিখতে তাদের সাহসের অভাব হয়নি। জীবনের শুরুতেই হয়ত তারা নিজেদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেছেন, কেউ নিজেকে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, কেউ নিজেকে নীহারঞ্জন গুপ্ত নয়ত ড. মনিরুজ্জামান মনে করছেন। নইলে তারা এই কাজটি কেন করতে যাবেন? আমি খুব খুশি হতাম যদি ওপরের তালিকার ছিটেফোঁটাও বর্তমানে কারও লেখায় দেখতে পেতাম। বাংলা সাহিত্য (এবং সার্বিক লেখালেখি) যে বিশাল এক সঙ্কটপূর্ণ সময় পার করছে, তা বোধকরি কাউকে বলে দিতে হবে না। তিন. বাংলা ভাষায় যারা ছদ্মনামে লেখালেখি করেন এবং এমন ধরনের ব্লগসাইট পরিচালনা করেন, এমন কিছু মানুষকে বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম- আপনারা সবসময় বেনামে লিখেন কেন? নিজের নামে লিখলে সমস্যাটা কি? তাদের বেশিরভাগেরই উত্তর, জীবনের নিরাপত্তা দেবে কে? আমি তাদের পাল্টা প্রশ্ন করি, আপনারা কী এমন লেখেন যে কেউ আপনাদের মেরে ফেলতে চাইবে? পত্রিকায় তো কত মানুষ লিখছে, তাদের তো কেউ মারছে না! আমি সত্যিকার অর্থেই জানার জন্য তাদের প্রশ্নটা করি। একেকজন একেক রকমের উত্তর দেন। তার সারমর্ম হলো, কেউ রাজনৈতিক লেখা লেখেন। তার জন্য রাজনীতিবিদরা ক্ষেপতে পারেন। কেউ কেউ বলেন, তারা সরকারবিরোধী লেখা লেখেন। সরকার তাদের পিছু নিতে পারে। ধর্ম নিয়ে কেউ লেখেন, এমন কারও সঙ্গে কথা হয়নি। তাই তাদের উত্তরটি শোনা হয়নি। তবে, এখন তো ফল কিছুটা হলেও দেখতে পাচ্ছি। লেখালেখির জন্য মানুষ যে জীবন হারাতে পারে, তা আর অনুমান নয়। সত্যি সত্যিই বিষয়গুলো ঘটছে। যারা সরকারবিরোধী কিংবা রাজনৈতিক লেখা লেখেন, তাদের আরও কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। যেমন, সরকারবিরোধী এমন কী লেখেন যার জন্য সরকার ক্ষেপে যেতে পারে? তাদের উত্তর, সরকারের দুর্নীতির বিষয়গুলো আমরা লিখি, বড় ডিলগুলো থেকে সরকার কিভাবে টাকা বানায় সেগুলো নিয়ে লিখি, বিদেশে কিভাবে টাকা পাচার হয়- এমন কত বিষয় আছে। আমার পরের প্রশ্ন- এগুলো আপনারা জানেন কিভাবে? আপনারা তো কেউ প্রফেশনাল সাংবাদিক নন। এ তথ্যগুলো পান কিভাবে? এগুলো সংগ্রহ করতে সময়ই বা পান কিভাবে? এগুলোর সমর্থিত তথ্য-উপাত্ত কই? অনেকেই তখন বেশ মজা পান। সেই মজাভরা মুখেই বলতে থাকেন, আরে ভাই বাংলাদেশের সাংবাদিকরা কোন সাংবাদিক নাকি? সব তো চামচা। তারা চামচামি করবে, নাকি সাংবাদিকতা করবে? ওরা লিখলে তো আর আমাদের লিখতে হতো না। আমি আবার জিজ্ঞেস করি, তাহলে আপনারা সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশায় যাচ্ছেন না কেন? এখানে একটু থেমে যান অনেকেই। উত্তরটা সঠিক মিলিয়ে দিতে পারেন না। তবুও তর্কের খাতিরে যারা তর্ক করেন, তারা বলেন- নেটে (ইন্টারনেটে) কত তথ্য পাওয়া যায়। আর আমরা তো এনালাইসিস করি। আমাদের এনালাইটিক পাওয়ার খুব ভাল। আমি আবারও প্রশ্ন করি- ইন্টারনেটে কিছু পাওয়া গেলেই সেটা কি সত্য হবে? কেউ তো ভুয়া তথ্যও দিতে পারে? সেটা ভেরিফাই না করেই লিখছেন কিভাবে? একজনকে যখন দোষী বলছেন, তার জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত লাগবে তো, নয় কি? তারা পাল্টা জবাব দেন, মূল মিডিয়া সক্রিয় নয় বলেই তো আমাদের এই প্ল্যাটফর্মগুলো অল্টারনেট মিডিয়া হিসেবে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আমি মুচকি হেসে বলি, আপনাদের বীরত্বের প্রশংসা করতে পারছি না। দুঃখিত। এই পৃথিবীতে মুখোশ পরে কেউ বীর হননি। জঙ্গীরা সবসময় মুখোশ পরে থাকে, সাহসী মানুষরা নয়। সাহস থাকে তো নিজের নামে লিখুন, তখন সেই সত্য ভাষণের জন্য আমি মাথা নুয়ে শ্রদ্ধা জানাব। এরপর আলোচনা বেশি দূর এগোয় না। তর্কের আগামাথা থাকে না। থাকার কথাও না। যুক্তিহীন কথার কোন আগামাথা থাকে না। গায়ের জোর থাকে, গলায় ডায়াফ্রামের শক্তি খরচ হয়, এই তো! চার. আমি সারাজীবনে বেনামে কারও বিরুদ্ধে একটি শব্দও লিখিনি। নিজের নামেই লেখার সময় পাই না, তারপর আবার বেনামে- তাও আবার অন্য মানুষ সম্পর্কে যার সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সঠিক নয়। এটা অন্যায়, ভীষণ অন্যায়। আমি বিশ্বাস করি, একজন লেখকের যদি ওইটুকু সৎ সাহস না থাকে, তিনি কোন পরিমাপেই লেখক নন। শব্দের পর শব্দ দাঁড় করাতে পারলেই মানুষ একজন লেখক হয়ে ওঠেন না। যুক্তির ফ্রেমওয়ার্ক খুব শক্তিশালী হলেই তিনি ভাল লেখক নন। আমি যদি কোন কিছু নিজের নামে লিখতে না পারি, তাহলে সেটা আমি লিখতে যাব কেন? যেই বিষয়ের ওপর আমার নিজেরই বিশ্বাস নেই, সেটা আমি সমাজে প্রচার করছি কিভাবে? এটা কি স্রেফ প্রপাগান্ডা নয়? যে লেখা আমি নিজের নামে প্রকাশ করতে পারি না, সেই লেখা আমি অন্যকে পড়তে বলি কিভাবে? আর সেই লেখা সমাজ পরিবর্তন করবে, সেটা আমি আশা করছি কিভাবে? সেই লেখা পড়ে মানুষ নিজেকে আলোকিত করবে, সেটা কি খুব বেশি আশা করা নয়? এবং সেটা হয়নি। বরং উল্টো সমাজে অস্থিরতা বাড়িয়েছে। যারা মুখোশ পরে লেখালেখি করেন, তাদের হাতেগোনা কিছু লেখা ছাড়া বেশিরভাগই অন্যের বিরুদ্ধে গালিগালাজ। সমাজের বিভিন্ন মানুষকে ভাঁড়ের মতো সাজিয়ে তারা এক ধরনের অদ্ভুত মজা পান। এটা এক ধরনের হাইড-এ্যান্ড-সিক গেম। অনেকটা চোর পুলিশ খেলা। বেনামে একটা লেখা ছেড়ে দিয়ে, দূরে বসে মজা নেন। (কিন্তু তারা হয়ত জানেন না, সকল ছদ্মনামেরই পরিচয় বের করা সম্ভব।) আর আমাদের সমাজটাও এতোই অসুস্থ যে, সেই লেখা নিয়ে টেবিল থেকে টেবিলে কুৎসিত আলোচনা বিস্তৃত করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না। একটি মানুষ চিৎকার করে বলতে পারে না, এই তথ্য তুমি জানলে কিভাবে, এটা তো সঠিক নাও হতে পারে? এই প্রশ্ন কেউ করে না। কেউ না। বরং মুখে লাল পানের পিক নিয়ে বলতে থাকে, শুনছেন ফেসবুকে কী লিখছে? ওই ব্যাটার নাকি দুইটা ...। আমি ভর্ৎসনা করি তাদের, যারা এই মাটিতে একটি কুৎসিত কালচার তৈরি করেছে, যারা লেখালেখিকে ইঁদুর-বিড়ালের লুকোচুরির বিষয় করে তুলেছে, আমি ধিক্কার দেই তাদের যারা মুখোশ পরে দিনরাত অন্যের নামে কুৎসা রটায়, আমি ধিক্কার দেই সেসব নামহীন কলম-জঙ্গীদের যাদের অপকর্মের জন্য সমাজে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, যাদের দায়িত্বহীনতার জন্য সমাজে আঁধার নেমে এসেছে, যাদের অপরিণামদর্শিতার জন্য মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করেছে, আমি ভর্ৎসনা করি তাদের, যারা কনডমের মতো কলমকে ব্যবহার করেছে, আর দায়িত্ব না নিয়েই জারজ লেখাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে ডাস্টবিনে, নয়ত খোলা রাস্তায়। আর আমি ভর্ৎসনা দেই সেই কুৎসিত পাঠকদের, যারা দায়িত্বহীন সেই লেখা ছড়িয়ে দিয়েছে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে, চায়ের আড্ডায়, নয়ত সামাজিক মাধ্যমে। যেদিন নিজের নামে লেখার সাহস হবে, এবং সেই লেখার জন্য যদি মৃত্যুও হয়, সেই মৃত্যুমিছিলে যেন আমারও স্থান হয়। তার আগ পর্যন্ত শুধুই করুণা। ৭ নবেম্বর ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়.কম ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×