ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৭ নভেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

কৈশোর থেকে উত্তরণ (৬ নবেম্বরের পর) রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এই নিষেধাজ্ঞা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নিতে বিরত থাকলেন। কিন্তু সেখানে ছাত্রদের প্রতিনিধিরা জানালেন, তারা এই সিদ্ধান্ত মানবেন না। তখন ঠিক হলো যে, ২১ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সমাবেশ হবে সেখানেই এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ তারিখে ১১টায় আমতলায় সভা শুরু হলো। সভায় সর্বদলীয় কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক জানালেন যে, তারা ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা ভাংতে চান না। তবে বিষয়টি নিয়ে ছাত্রসভা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নিতে পারে। এই ছাত্রসভায় সিদ্ধান্ত হলো যে, ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা মানা হবে না এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ জন করে বিভিন্ন দল রাস্তায় নামবে। দুপুরের দিকে ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা ভাঙ্গা শুরু হলো। পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের শোভাযাত্রা বিক্ষোভ ইত্যাদি রুখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে তাদের ক্যাম্প বানাল এবং সেখান থেকে রাস্তায় এসে ছাত্রদের প্রতিরোধ করতে থাকল। এক পর্যায়ে অপরাহ্ণে সেখানে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে এবং কতিপয় ব্যক্তি তাতে নিহত হন। এতে যে আন্দোলন শুরু হলো তা ৫ মার্চ পর্যন্ত চলে। ১৯৪৮ সালের ছাত্র অথবা সরকারবিরোধী সব আন্দোলনেই সিলেট একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৭ এবং ১৯৪৮ সালে স্কুলের ছাত্র হিসেবে ভাষা আন্দোলনে আমি সক্রিয় ভূমিকা পালন করি। শোভাযাত্রায় যোগ দেয়া ছাড়াও জনসভায় বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দেই। আমার একটি বিশেষ সুবিধা ছিল যে, আমার আব্বা এবং আম্মা মুসলিম লীগ নেতা হলেও তারা দু’জনেই ছিলেন সিলেটে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বের আসনে। বদরুদ্দিন ওমরের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্বন্ধে বিখ্যাত গ্রন্থাবলীতে আমার আব্বা-আম্মার ভূমিকা বিশেষভাবে বিবৃত আছে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির সামান্য আগে আমরা দুই ভাইয়ের জলবসন্ত হয় এবং সেজন্য কিছু সময় আমরা আন্দোলন উৎসব থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হই। আমরা অবশ্য খুব সত্বর আরোগ্য লাভ করি এবং সেটা ছিল পূর্ব বর্ণিত ইয়েমেনি সাহেবের চিকিৎসার কারণে। স্বাধীনতা দিবস পালনের জন্য আমরা দু’দিন আগ থেকে ঘটা করে প্রস্তুতি শুরু করি। নিজেদের বাড়ির সামনে অতি সুদৃশ্য একটি তোরণ নির্মাণ করি। আমার ভাই মুহসি রঙিন কাগজ ব্যবহার করে অনেক ফানুস, চেইন ইত্যাদি নির্মাণ করেন। তিনি এসব ব্যাপারে সব সময়ই ওস্তাদ ছিলেন। স্বাধীনতা প্রাপ্তি উপলক্ষে জনসাধারণও বিভিন্ন জায়গায় বড় রাস্তার ওপর সুসজ্জিত তোরণ নির্মাণ করে। কিন্তু ১৪ আগস্টে তেমন কোন বড় উৎসব ছিল না। কারণ সরকারী কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল সামান্য কয়েকটি বিষয়। যথা- সকালে কুচকাওয়াজ এবং দুপুরে খাদ্য বিতরণ। আমরা দেখলাম যে, আমাদের উৎসবটা একান্তই আমাদের পারিবারিক এবং বাড়ির ব্যাপার হয়ে গেল। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর পূর্ববাংলায় নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হলো খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে। অবিভক্ত বাংলার সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভারতেই থেকে গেলেন এবং মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে মিলে দেশব্যাপী শান্তি আন্দোলনে ব্যস্ত থাকলেন। পূর্ববাংলার এই নতুন মন্ত্রিসভায় ৪ সেপ্টেম্বরে আমাদের জনপ্রতিনিধি আবদুল হামিদ হলেন একজন মন্ত্রী (আবদুল হামিদ ছিলেন আমার আব্বার বড় মামা)। আগেই বলেছি যে, ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ আমি ‘মুকুলমেলা’ সংগঠনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম এবং ‘মুকুলমেলা’র জন্য আমাকে যথেষ্ট সময় দিতে হতো। এই বয়সে আর একটি আকর্ষণীয় বিষয় হয়- সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আসর। কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ এবং সাহিত্য পরিষদ নানা ধরনের সাহিত্য সভার আয়োজন করত। আমরা ‘মুকুলমেলা’ থেকেও সময় সময় সাহিত্য সভা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম। আমি ১৯৪৪ সালে ‘মোদের রসূল’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে সব উচ্চ বিদ্যালয় মিলে সিলেটে যে মিলাদ অনুষ্ঠান করে তাত পুরস্কারপ্রাপ্ত হই। এর পরই সাহিত্য সভা ইত্যাদিতে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে যাই। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত বিভিন্ন সাহিত্য সভায় আমি প্রবন্ধ রচনা করে তা পাঠ করতাম। এর মধ্যে ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকটা ছিল প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত সময়। সিলেটের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘যুগভেরী’তে ১৯৪৮ সালে একটি পৃষ্ঠায় ‘মুকুল মজলিশ’ নামে প্রায় এক পৃষ্ঠা ছাপতে থাকে। এই ‘মুকুল মজলিশ’-এর সম্পাদনা করতেন আবদুল হক বলে একজন কলেজের ছাত্র। ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি সময় তিনি অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে এই দায়িত্বটি আমি গ্রহণ করি। তখন ‘যুগভেরী’র সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ নামের এক উকিল। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় আমি এই দায়িত্ব পালন করি। এই অবৈতনিক দায়িত্ব ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আমি চালিয়ে যাই এবং ‘মশাল ভাই’ নামে প্রতি সপ্তাহে আমি কিছু না কিছু লিখতে থাকি। এসব লেখার বিষয়বস্তু ছিল বিভিন্ন খ্যাতনামা ব্যক্তির জীবনকাহিনী, ভৌগোলিক নানা বিষয়এবং মাঝে মাঝে গল্প ফাঁদার প্রচেষ্টা। সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে আমার এই আকর্ষণ আমাকে ১৯৪৮ সালে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়। আমার বন্ধু নাসির চৌধুরী আগের বছরেই এই দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং ১৯৪৮ সালে আবার যৌথভাবে আমার সঙ্গে এই দায়িত্ব পান। চলবে...
×