ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

৭ নবেম্বরে যা দেখেছিলাম

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৭ নভেম্বর ২০১৫

৭ নবেম্বরে যা দেখেছিলাম

৩ নবেম্বর জেলহত্যার খবরটা আমি প্রথমে শুনি খবর পাঠক সরকার কবিরউদ্দীনের কাছে। ৪ তারিখ বাংলাদেশ বেতারে সকালের শিফটে আমার ডিউটি ছিল। আমি তখন দৈনিক বাংলায় সাব-এডিটর হিসেবে কর্মরত। পাশাপাশি রেডিওর বার্তা বিভাগে ক্যাজুয়েল কন্ট্রাক্ট বেসিসে সংবাদ অনুবাদের কাজ করি। সে সময় এ ধরনের কাজে আরও নিয়োজিত ছিলেন জাতীয় সংসদের বিতর্ক সচিব নেয়ামাল বাসির, বাংলা একাডেমির দুই উপ-পরিচালক হাবিবুল আলম ও সুব্রত বড়ুয়া, ইত্তেফাকের আফতাব হোসেন, এমএ আজিজ, শাহজাহান সাহেব ও আরও কয়েকজন। ৪ নবেম্বর ভোর থেকে রেডিওতে গিয়ে কাজ করছি। কবির ভাই এলেন সম্ভবত সাড়ে ছটার দিকে। আমাদের অনূদিত আইটেমগুলোর প্রতিটি পৃষ্ঠা আলাদা আলাদা ক্লিপবোর্ডে গাঁথা থাকত। খবর পাঠের আগে সরকার কবির সেগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে রিহার্স করে নিচ্ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কবির ভাই! কোন খবর আছে?’ উনি চোখের ইশারায় সামনের বারান্দা দেখিয়ে সেখানে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘শুধু আপনার কনজামশনের জন্য বলছি। গত রাতে জেলখানায় কিলিং হয়েছেÑ তাজউদ্দীনসহ কয়েকজনকে মেরে ফেলেছে।’ তাঁর কাছে আরও শুনলাম ১৫ আগস্টের কিলাররা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে বিশেষ ফ্লাইটে ব্যাঙ্ককে। বুকের ভেতরটা কেমন ভারবোধ করতে লাগল। আবার কিলিং! কি হতে যাচ্ছে দেশটায়? রেডিও থেকে দৈনিক বাংলায় গেলাম। আরও বিশদ কিছু শুনলাম। পরের দুটো দিন নানান নাটকীয়তা ও টেনশনের মধ্যে কাটল। খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নিয়েছেন। শুনলাম এবার আর্মিতে চেন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা হবে। ৬ নবেম্বর দৈনিক বাংলায় আমার রাতের শিফট্ ছিল। একটা অনিশ্চয়তাপূর্ণ থমথমে অবস্থা এবং একই সঙ্গে প্রবল উত্তেজনাকর। অফিসের ভেতরেও তার প্রতিফলন ছিল। রাত ১২টার দিকে বার্তা সম্পাদক তারা ভাই (প্রয়াত ফওজুল করিম) আমাকে কয়েকটা ছবির ক্যাপশন লিখতে দিলেন। তার মধ্যে একটা ছবি ছিল মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফকে ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছেন একপাশে এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াব। অন্যপাশে নৌবাহিনী প্রধান। তিনজনই সোফায় বসা এবং মুখে হাসি। সেদিন খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান করা হয়েছে। ক্যাপশনগুলো লিখে ছবির সঙ্গে গেঁথে জমা দেয়ার পর তারা ভাই বললেন : ‘তোমরা যারা মোহাম্মদপুর লাইনে থাক চলে যাও। গাড়ির ক্রাইসিস হবে।’ আমরা তিনজন- সাদেকীন, রমিজউদ্দীন আহম্মদ ও আমি সময় নষ্ট না করে নেমে গেলাম। তখন দৈনিক বাংলার লাল রঙের একটা পিক আপ ছিল। আমরা তিনজন চাপাচাপি করে সামনের সিটে বসলাম। সাদেকীন ভাই আগে নামবেন রাজাবাজারে। উনি দরজার দিকে বসলেন। মাঝখানে আমি। নামব আসাদ গেটের পরে। সবশেষে রমিজ ভাই নূরজাহান রোডে নামবেন। ড্রাইভার দীন মোহাম্মদ গাড়ি ছেড়ে দিলেন। নবেম্বরের রাত। এমনিতেই গুমোট থমথমে পরিবেশ। তার ওপর কার্ফু। রাস্তা একেবারেই নির্জন। একটা দোকান খোলা নেই। একটা রিক্সাও নেই। এমনকি বেওয়ারিস কুকুর পর্যন্ত চোখে পড়ল না। দীন মোহাম্মদ নির্জন রাস্তা পেয়ে স্পিড বাড়িয়ে দিল। শাহবাগের গোলচত্বরে এসে ডানদিকে বাঁক নিল গাড়ি। আমাদের বাঁদিকে পিজি হাসপাতাল। ডানদিকে বারডেম ও বাংলাদেশ বেতার ভবন। এখানে এসে একটা দৃশ্য দেখে তিনজনই প্রমাদ গুনলাম। রাস্তার বাঁ ধারে কয়েক গজ ব্যবধানে সৈনিকরা পর পর দাঁড়ানো। হাতে রাইফেল। স্ট্যাচুর মতো স্থির। ভাবলাম এই বুঝি গাড়ি থামাবে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে। কার্ফু পাস দেখতে চাইবে। কিন্তু কেউ যেন ভ্রƒক্ষেপও করল না। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল (এখনকার রূপসী বাংলা) পার হয়ে নজরে পড়ল মাঝে মধ্যে মর্টারের মতো কি যেন রাস্তার পাশে বসানো। সঙ্গে দুজন কি তিনজন করে সৈন্য। তাদের এই লাইনটি আরও উত্তর দিকে চলে গেছে। ফার্মগেটে এসে গাড়ি বাঁয়ের রাস্তায় টার্ন নিয়ে কিছু দূর গিয়ে বাঁ পাশের একটি গলিতে ঢুকে পড়ল সাদেকীন ভাইকে নামানোর জন্য। তাঁকে নামিয়ে গাড়ি ব্যাক করে আবার মেইন রোডে উঠতে না উঠতে হঠাৎ ব্যুম! বোমা বা এ জাতীয় কিছু বিস্ফোরণের প্রচ- আওয়াজ। মনে হলো এয়ারপোর্ট (তখন তেজগাঁও বিমানবন্দর) ছাড়িয়ে আরও দূর থেকে আসছে। কয়েক সেকেন্ড পর আবার এবং পুনর্বার। সেই সঙ্গে থ্রি নট থ্রির মুহুর্মুহু আওয়াজ। আমরা এবার আতঙ্ক বোধ করলাম। রমিজ ভাই বললেন, ‘দীন মোহাম্মদ, জোরসে চালাও।’ দীন মোহাম্মদ স্পিডে ছুটিয়ে দিল গাড়ি। ইসলামিয়া হাসপাতালের পেছন দিক ছাড়িয়ে গাড়ি গোল চত্বরে টার্ন নিয়ে ছুটল মানিক মিয়া এ্যাভিনিউর দিকে। তখন মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ এখনকার মতো ছিল না। কয়েকটা ডিভাইডার ছিল এবং সেগুলোর ওপর বড় বড় গাছ ছিল। টিএ্যান্ডটি ভবনের কাছে একটা দৃশ্য দেখলাম। জলপাই রংয়ের একটা মিলিটারি জীপ উল্টে আছে। একটা দিক ডিভাইডারের গায়ে থাকায় খানিকটা কাত হয়ে আছে। কয়েক পলকের দৃশ্য। তথাপি কোন মানুষজন ছিল বলে মনে হয়নি। গাড়ির নিচের রাস্তার কিছুটা জায়গা ভেজা লাগছিল। সেটা তেল না রক্ত বুঝার উপায় ছিল না। এদিকে বুম্্ বুম্্ ও থ্রি নট থ্রির আওয়াজ থেকে থেকে চলতে থাকল। সেই সঙ্গে অনেক দূর থেকে কোলাহলের মতো আওয়াজও কানে ভেসে এলো। গাড়ি আসাদ গেট পার হয়ে আমাকে বাসায় নামিয়ে রমিজ ভাইকে পৌঁছাতে গেল। গেট খুলতে গিয়ে দেখি উৎকণ্ঠিত চেহারায় ফ্যামিলি মেম্বাররা দাঁড়ানো। বাসায় ঢুকেই প্রথমে অফিসে ফোন করলাম পরিস্থিতি জানার জন্য। পেলাম না, এনগেজড। আবার চেষ্টা, আবার এনগেজড। বার বার এ রকম হতে হাল ছেড়ে দিয়ে রাতের খাবার কোনভাবে খেয়ে নিলাম। ভোরে রেডিওর ডিউটি আছে। ৭টার বুলেটিনের জন্য গাড়ি এসে নিয়ে যায়। যে পরিস্থিতি তাতে যাওয়া হবে কিনা জানি না। তথাপি পোশাক না ছেড়ে শুয়ে পড়লাম যাতে গাড়ি এলে সময় নষ্ট না হয়। বাইরের ঘটনা জানার জন্য রেডিও অন করা ছিল। এক সময় পটপরিবর্তনের ঘোষণা শুনতে পেলাম। ক্ষমতার আবার হাত বদল হয়েছে। বেতারে মাঝে মধ্যে ঘোষণা হচ্ছে : ‘রেডিও টেলিভিশনের কর্মীদের নিজ নিজ পরিচয়পত্রসহ অবিলম্বে কর্মস্থলে চলে আসার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।’ ঠিক করলাম গাড়ি এলে যাব নইলে নয়। তাছাড়া আমার পক্ষে অতদূর যাওয়া সম্ভবও না। তা গাড়ি এলো পাঁচটার দিকে। অবাক হলাম মিলিটারি জীপ দেখে। চালকের পাশের সিটে রেডিও নিউজের ডিরেক্টর আনিস চৌধুরী বসা। এ সময় তাঁর রেডিওতে যাওয়ারও কথা নয়। বুঝলাম ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন এবং আর্মির জীপটাও নিশ্চয়ই সে কারণেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি জীপের পেছনের সিটে উঠে বসলাম। আরও দুজন বসা। পরিস্থিতির কারণে এবং আমার শারীরিক সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে উৎকণ্ঠিত আমার বাবা (প্রয়াত একরামুল হক। উনি তখন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মেম্বার) গেট ছাড়িয়ে এগিয়ে এসে আনিস চৌধুরীকে অনুরোধ করলেন ‘আমার ছেলেটা দুর্বল। একটু দেখবেন।’ গাড়ি ছুটল। আনিস চৌধুরী আমাকে বললেন : ‘মনসুরকে নিতে হবে। এই পিয়নটা আবার, ওর বাড়ি চিনি না। ডু ইউ নো মনসুরস্্ হাউস?’ বললাম, বাবর রোডে। গাড়ি মিরপুর রোডে উঠে ছুট লাগাল বাবর রোডের দিকে। মনসুর গেটেই দাঁড়িয়ে ছিল। জীপ আসতে দেখে ওটা রেডিওর ধারণা করে দৌড়ে ছুটে এসে উঠে পড়ল আমার পাশে। গাড়ি এবার দ্রুত ছুটতে লাগল শাহবাগে রেডিও অফিসের দিকে। মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে এসে আরেক দৃশ্য। ট্যাঙ্ক চলছে। দু’একটা আর্মি লরিও। জওয়ানরা মাঝে মধ্যে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করছে। দু’তিনটা ট্যাঙ্ক অতিক্রম করে জীপটা এবার এয়ারপোর্ট রোডে উঠল। সেখানেও আরেক দৃশ্য। ট্যাঙ্কের পর ট্যাঙ্ক সগর্জনে চলেছে। আর্মির লরিও। ওগুলো থেকে অনবরত থ্রি নট থ্রির ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার। কানে তালা লাগার যোগাড়। টেনশনে আমাদের কারোর মুখে কোন কথা আসছিল না। রেডিও অফিসের গেটে এসে যখন জীপ থামল তখন বেশ কিছু ট্যাঙ্ক ও মিলিটারি লরির সমাবেশ ঘটেছে ওখানে। তখন তো আর ভাবনা-চিন্তা করার মতো অবস্থা ছিল না, তবে পরে মনে পড়ছে পিটার, টুল ও ওমর শরীফ অভিনীত নাইট অব জি জেনারেলস ছায়াছবির একটি দৃশ্যের কথা। রেডিওর গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে দেখি চিরাচরিত প্রথার বাইরে আইডি চেকিং হচ্ছে। আর্মি জওয়ানরা দুদিকে লম্বা লাইন করে দাঁড়িয়েছে। তাদের মাঝখান দিয়ে কার্ড দেখিয়ে যেতে হচ্ছে। সবার মধ্যে প্রচ- তাড়াহুড়ো। আনিস চৌধুরী, মনসুর ও অন্যরা চলে গেল। সবার পেছনে আমি। বুক পকেটে হাত দিয়ে গেটপাসটা বের করতে গিয়ে মাথাটা ঘুরে গেল। ওটা আনা হয়নি। তার বদলে আছে দৈনিক বাংলার আইডি। সামনে এগোনো ছাড়া পেছনে ফেরার উপায় নেই। আমি মরিয়া হয়ে ‘ডু অর ডাই’ ভাব নিয়ে বাড়িয়ে দিলাম সেই আইডিটাই। দারুণ ব্যস্ততার মধ্যে এক জওয়ান ওটা হাতে নিয়ে কি দেখল বা কি বুঝল জানি না আমার হাতে ফেরত দিয়ে ছেড়ে দিল। আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন। চেকিং লাইনটা পার হয়ে বিরাট হাঁফছেড়ে বাঁচলাম। তাড়াতাড়ি চলে গেলাম দোতলায় নিউজ রুমের বাংলা ইউনিটে। নেয়ামাল বাসির ও আরও একজন ইতোমধ্যে এসে গেছেন। তাদের সঙ্গে আমিও কাজে লেগে গেলাম। টের পেলাম নিউজ পরিবেশন নিয়ে জিএনআর-এ (জেনারেল নিউজ রুম) এক দারুণ টেনশন অবস্থা চলছে। আসার সময় দু’তিনটি অপরিচিত মুখ চোখে পড়ছিল সেখানে। একসময় নিউজ ও হেডলাইন করা শেষ হলো। বাইরের সেই থ্রি নট থ্রির ব্ল্যাঙ্ক ফায়ারের কানফাটানো শব্দ তখনও ভেসে আসছিল। সরকার কবিরউদ্দীন খবর পড়তে এসেছেন। আইটেমগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে স্টুডিওতে চলে গেলেন ৭টার খবর পড়তে। নার্ভের ওপর এতক্ষণ প্রচ- ঝড় বয়ে গেছে। চাঙ্গা হওয়ার জন্য আমরা চার পাঁচজন নিচে আবুল মিয়ার ক্যান্টিনে গেলাম চা খেতে। খবর পড়া শেষ করে কবির ভাইও আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন ওখানে। আবুল মিয়াও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমাদের কাছে বসলেন। মুখটা কালো ও শুকনো। জানালেন, ভোরে রাইফেলের কুদোয় ক্যান্টিনের ক্যাশবাক্স ভেঙ্গে টাকা পয়সা লুট করে নিয়েছে। শুনলাম, খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল হায়দারকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। পরিস্থিতি অত্যন্ত ভোলাটাইল। একটা টাগ অব ওয়্যার ভেতরে ভেতরে চলছে। আউটকাম কি দাঁড়ায় এখনও অনিশ্চিত। আরও জানলাম কর্নেল তাহেরই মূলত এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। তিনি এখনও এসার্ট করে চলেছেন। চা পান শেষ করে আমরা উঠলাম ইউনিটে ফিরে যাবার জন্য। হাঁটতে হাঁটতে সবার পেছনে পড়ে গেছি। এবার বেতার ভবনের পোর্টিকোয় ফ্ল্যাগ লাগানো প্রেসিডেন্সিয়াল কার দেখতে পেলাম। আগে ওখানে ছিল না। সাদা ইউনিফর্মধারী শফারের ব্যস্ততাও চোখে পড়ল। আমি সিঁড়ি দিয়ে করিডরে উঠতে গিয়ে কয়েকজন সেনা অফিসার ও সিভিলিয়ানের ব্যস্তসমস্ত ছোটাছুটি দেখতে পেলাম। করিডর দিয়ে এগোতে গিয়ে হঠাৎ কি মনে হলো সামনে স্টুডিওতে ঢোকার চওড়া দুই পাল্লার সুইং ডোরের দিকে অগ্রসর হলাম। দরজার সামনে একজন জওয়ান দাঁড়ানো। আমি ঢুকতে উদ্যত হতে গিয়ে কোন বাধা না পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। তারপর যে কক্ষটায় নিউজ রিডাররা সংবাদ পাঠ করেন সেটি পেরিয়ে স্রেফ কৌতূহলবশত পাশের কক্ষের দরজা ঠেলে ফাঁক করে মাথাটা বাড়িয়ে দিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতস্পৃষ্টের মতো ঝাঁকুনি খেলাম একটা দৃশ্য দেখে। আমার মনে হলো এ মুহূর্তে এখানে আমার উপস্থিতি অনাকাক্সিক্ষত বলে গণ্য হতে পারে এবং তার জন্য ঝামেলায় পড়তে পারি। আমি দেখলাম একটা টেবিলের ওপাশে খন্দকার মোশতাক আহমদ দাঁড়ানো। তার দুই দিকে কয়েকজন মিলিটারি অফিসার। মোশতাকের পরনে হাল্কা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা। মাথায় তার ব্র্যান্ডের কালো টুপি। এক হাতের তালুর ওপর অপর হাতের তালুর উল্টোপিঠে দিয়ে মৃদু বাড়ি দিতে দিতে কথা বলছেন। ভঙ্গিতে মনে হলো কিছু কনভিন্স করানোর চেষ্টা করছেন। আমি সোজা স্টুডিও থেকে বেরিয়ে বাংলা ইউনিটে গেলাম। সহকর্মীদের বললাম কথাটা। কে যেন বলল, মোশতাক তো সেই রাত তিনটা থেকে আছে এখানে। রেডিও টিভিতে ভাষণ দিতে চাইছে। দিতে দেয়া হয়নি। আবার এমনও শুনলাম রেডিও এখন কর্নেল তাহেরের নিয়ন্ত্রণে। সিচ্যুয়েশন এখনও যথেষ্ট কমপ্লেক্স ও আনপ্রেডিক্টেবল। এমন সময় জিএনআর থেকে নির্দেশ এলো সকাল ৭টার বুলেটিনে যা গেছে হুবহু একই জিনিস ৯টার বুলেটিনেও যাবে। একটা শব্দ এদিক ওদিক হবে না। কাজ নেই দেখে সহকর্মীদের বলে বেরিয়ে পড়লাম। দৈনিক বাংলায় যেতে হবে। সকালের শিফটে ফখরুদ্দীন ইকবাল আমার সঙ্গে ডিউটি বদল করেছেন। বের হতে গিয়ে দেখি আরেক দৃশ্য। বেশ কিছু মানুষের জটলা বিল্ডিংয়ে ওঠার সিঁড়ির মুখে। দেখলাম এমএজি ওসমানী দাঁড়িয়ে আছেন। ভিড় অতিক্রম করে নেমে গিয়ে একটু দাঁড়ালাম। দেখতে পেলাম সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছেন নৌবাহিনীর ইউনিফর্ম পরা এমএইচ খান এবং আরও কয়েকজন যাদের চিনলাম না। বুঝলাম ড্রামা শেষ হয়নি। যবনিকা কখন নামবে কে জানে। ভিড় ঠেলে আমি গেট পেরিয়ে এলাম। সামনের রাস্তার বেশ কিছু অংশ জুড়ে ট্যাঙ্কের ভিড়। কোন কোন ট্যাঙ্কের ওপর, লরির ওপর সাধারণ মানুষও উঠে পড়েছে। তারা হর্ষধ্বনি করছে। সেøাগান দিচ্ছে : ‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই।’ তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছে সৈনিকরাও। সেই গগনবিদারী চিৎকার আর ব্ল্যাঙ্ক ফায়ারের আওয়াজের আমি কোন কূল কিনারা পেলাম না। আমি দৈনিক বাংলার উদ্দেশে পা বাড়ালাম।
×