ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জ্বলছে প্রতিবাদ প্রতিরোধের অগ্নিমশাল

ইতিহাস বলে জানি আমরা, আমরা পরাজিত হইনি...

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৭ নভেম্বর ২০১৫

ইতিহাস বলে জানি আমরা, আমরা পরাজিত হইনি...

মোরসালিন মিজান ইতিহাস বলে জানি আমরা/আমরা পরাজিত হইনি/সূর্য পাতাল হতে আমরা/জীবন জয়ের পথে কভু থামিনি...। সত্যি থামেনি বাঙালী। বিগত দিনে যেমন লড়াই করে বেঁচেছে, আজও অকুতোভয়। ধর্মান্ধ চাপাতির কোপ পড়েছে মাথায়। তবু, মাথা নত হয়নি। বরং হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে হচ্ছে জীবনের গান। জেগে ওঠার আহ্বান। বলা হচ্ছিল টুটুলের কথা। আহমেদুর রশীদ টুটুল। মৌলবাদী জঙ্গীদের বর্বর আক্রমণের শিকার তরুণ প্রকাশক এখন ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন। বই প্রকাশের ‘অপরাধে’ শরীরজুড়ে তাঁর ভয়াবহ ক্ষত! ঘন সেলাই। ব্যান্ডেজে মুখ ঢাকা। সে মুখেই কথা বলছেন। আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, মুক্তচিন্তার পক্ষে লড়াই জারি থাকবে। তারপর শুক্রবারের সকালটি। এদিন জীবনের পথে আরও এক পা যেন এগোলেন টুটুল। নিজের মনের কথাটি ফেসবুকে লিখে প্রকাশ করতে সক্ষম হলেন। সে লেখায় ভয় নেই। ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়। ছোট্ট লেখার সুন্দর একটা শুরু। সকলকে সকালের শুভেচ্ছা জানিয়ে টুটুল লেখেনÑ ‘শুভ সকাল বাংলাদেশ। শুভ সকাল মহাপৃথিবী। আবারো আঙ্গুল ছোঁয়া পেলো কী-বোর্ডের। এ যেন ঠিক বন্ধুদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার আনন্দ। চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে নিজের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে তিনি লেখেনÑ ‘বুদ্ধির মুক্তির লড়াইয়ে, মুক্ত বুদ্ধির লড়াইয়ে আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো।’ এ লড়াইয়ে গোটা দেশের মানুষকে পাশে চান তিনি। সেই আহ্বান জানিয়ে লেখেন, ‘সঙ্গে থেকো বাংলাদেশ।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রিয় স্বদেশ টুটুলের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। লেখার আগেই তাঁর লেখাটি পড়ে ফেলেছিল বাঙালী। এমনকি যে নির্দোষ নির্বিবাদী সরল সুন্দর তাজা প্রাণটি ঝরে গেল, সেই দীপনের শেষ কথাটিও যেন কান পাতলেই শোনা যায়। উপলব্ধি করা যায়, ধর্মের নামে এই বর্বরতা কোন ব্যক্তির সঙ্গে নয়। ব্লগ বা বইয়ের সঙ্গে নয় শুধু। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আজ আক্রান্ত। নানা মতের পথের বিশ্বাসের বাংলাদেশ আজ রক্তাক্ত। আর তাই দীপন বা টুটুলের পাশে নয় শুধু, বাংলাদেশের পক্ষে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। চলছে প্রতিবাদ। রাজধানীতে প্রতিদিনই অনুষ্ঠিত হচ্ছে সভা সমাবেশ বিক্ষোভ মানববন্ধন। শুক্রবারের কথাই যদি বলা যায়, এদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উত্তাল ছিল ঢাকা। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন সর্বস্তরের জনগণ। দিনের শুরুতে আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে যান সংস্কৃতিকর্মীরা। কবি সাহিত্যিক শিল্পীসহ সাধারণ মানুষ এতে অংশ নেন। রাস্তার পাশে হাতে হাত ধরে দাঁড়াতে থাকেন তারা। যতদূর চোখ যায়, প্রতিবাদী মুখ। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত মানববন্ধনে জোটের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি খ্যাতিমান প্রকাশক মফিদুল হক, জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, নাট্যজন ঝুনা চৌধুরী, মান্নান হীরা, মিজানুর রহমান, আবৃত্তি শিল্পী মীর বরকত, রফিকুল ইসলাম, মানজার চৌধুরীসহ বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। এখান থেকে মুক্ত চিন্তার ওপর আক্রামণকারীদের যত দ্রুত সম্ভব গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়। বিকেলে শাহবাগে সংহতি সমাবেশ করে ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বাধীন গণজাগরণ মঞ্চ। এখানে এসেছিলেন নিহত অভিজিতের পিতা শিক্ষাবিদ অজয় রায়। পুত্র হারানোর শোকে কাতর বাবা দেশটির জন্যও কান্না করলেন। বাংলাদেশকে আপন ঠিকানায় পৌঁছে দিতে তরুণদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান বীরাঙ্গনা মা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। সংহতি সমাবেশ থেকে সরকারকে জঙ্গী দমনে আরও আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। প্রায় একই সময় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে প্রতিরোধের ডাক দেয় জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ মোর্চা। এখানে মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মীরা সমবেত হয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ও সংস্কৃতিকর্মী নাসির উদ্দীন ইউসুফ, সাংবাদিক আবেদ খান, কবি মোহাম্মদ সামাদ, তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি মোহাম্মদ এ আরাফাতসহ অনেকেই এখানে বক্তৃতা করেন। ছিলেন শাহবাগ আন্দোলনের সংগঠকরাও। এখানে বর্তমান পরিস্থিতি বাস্তবতার আলোকে তুলে ধরতে প্রয়াসী হন বক্তারা। তাঁরা বলেন, ব্লগার লেখক ও প্রকাশকদের ওপর আক্রমণকারীরা বাংলাদেশের শত্রু। পুরনো এই শকুনেরা জাতির পতাকা ফের খামচে ধরার চেষ্টা করছে। এদের ভয় না পেয়ে প্রতিহত করার আহ্বান জানানো হয় সমাবেশ থেকে। প্রেসক্লাব এলাকাতেও ছিল প্রতিবাদী সমাবেশ। দুটি বাম দলের সমাবেশ থেকে আক্রমণকারী জঙ্গীদের দ্রুত গ্রেফতার করে রাষ্ট্রের সক্ষমতার প্রমাণ রাখতে বলা হয়। আজ শনিবারও রাজধানীজুড়ে থাকবে সভা সমাবেশ। প্রতিবাদ। নিহত প্রকাশক দীপনের অফিস যেখানে, সেই আজিজ মার্কেটের সামনে বিকেল ৪ টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রতিবাদ কর্মসূচীর ডাক দেয়া হয়েছে। এভাবে প্রতিদিনই রাজপথে নেমে আসছে মানুষ। প্রতিবাদ করছে। প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সব দেখে আশাবাদী হয়ে ওঠে মন। আশ্বস্ত হয়Ñ বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। গীতি কবির ভাষায়Ñ এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল/কোনদিন আমরা যে ভাঙবোই/মুক্ত প্রাণের সাড়া আনবোই/আমাদের শপথের প্রদীপ্ত স্বাক্ষরে/নতুন সূর্যশিখা জ্বলবেই/জ্বলবেই জ্বলবেই জ্বলবেই।
×