ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লন্ডনে বসে খালেদার বক্তব্যে সব মহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া

সংলাপ ও নির্বাচনের জন্যই কি এমন গুপ্তহত্যা!

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৭ নভেম্বর ২০১৫

সংলাপ ও নির্বাচনের জন্যই কি এমন গুপ্তহত্যা!

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ধারাবাহিক টার্গেট কিলিং মিশনের সিঁড়ি বেয়ে সংলাপ ও নতুন নির্বাচনের দাবি; অসুস্থ রাজনৈতিক চর্চার ঘেরাটোপে বাংলাদেশ। দেশী-বিদেশী নাগরিক, একের পর এক মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষকে পরিকল্পিত হত্যাকা-ের পর সর্বশেষ পুলিশ হত্যার ঘটনায় আতঙ্কিত করে তুলেছে দেশের মানুষকে। একটি চিহ্নিত রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়ায় দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ধর্মান্ধ-বিকৃত মানসিকতাগ্রস্ত একই গোষ্ঠী যে এসব হত্যাকা- চালাচ্ছে তা সবশ্রেণী মানুষের কাছে আজ স্পষ্ট। এসব অশুভ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলায় যখন অধিকাংশ রাজনৈতিক দল থেকে ঐক্যের ডাক দিচ্ছে, ঠিক তখন লন্ডন থেকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার দ্রুত জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে নতুন নির্বাচনের দাবি সব মহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে- সংলাপ ও নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেই কী চালানো হচ্ছে এমন গুপ্তহত্যা? ব্লগার, প্রকাশক, লেখক, বিদেশী নাগরিক থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য; চলছে ধারাবাহিক টার্গেট কিলিং। হঠাৎ করেই বেড়ে যাওয়া এসব গুপ্তহত্যা ও নির্মম হত্যাকা-ের মূল শিকড় এখনও চিহ্নিত না হলেও একাত্তরের মানবতাবিরোধী সংগঠন জামায়াত-শিবির এবং বিএনপির একটি সন্ত্রাসী গ্রুপই যে দায়ী, তা প্রাথমিক তদন্তেও বেরিয়ে এসেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতারাও এসব ঘটনার জন্য খালেদা জিয়াসহ বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছেন। এসব ঘটনার নেপথ্যে কারা আছে, রাজনৈতিক বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেই এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে কিনা, তদন্তকারীসহ সরকারী প্রশাসন যখন কঠোর অবস্থানে, ঠিক তখনই লন্ডন থেকে দেশের সঙ্কটকে ভয়াবহ উল্লেখ করে জাতীয় সংলাপ ডেকে খালেদা জিয়ার নতুন নির্বাচনের দাবি- সরকারসহ দেশবাসীর সেই সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। শুধু মুক্তবুদ্ধির চর্চা করার জন্য যখন ধর্মান্ধরা একে একে প্রগতিশীল মানুষকে গুপ্তহত্যা করছে, ঠিক তখন এসব পরিকল্পিত হত্যাকা-কে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ উল্লেখ করে সরকারের কিছু মন্ত্রী-নেতার অযাচিত মন্তব্যে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে দেশের মানুষকে। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নেতৃবৃন্দ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলছেন, এসব পরিকল্পিত হত্যাকা-কে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা বললে ঘাতকরা আরও উৎসাহিত হয়ে নতুন করে খুনের নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠবে। দায়িত্বশীল পদে থেকে এ ধরনের উক্তি শুধু অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল শক্তিকেই আতঙ্কিত করে তোলে না, সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকেও বলীয়ান করে তোলে। একইসঙ্গে তারা দুই সন্ত্রাসীর হামলার সময় পাঁচ পুলিশের অসহায়ত্ব ও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনারও সমালোচনা করেছেন। টার্গেট কিলিং মিশন নিয়ে দেশে সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার লন্ডন থেকে পাঠানো বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার একটি বিবৃতি নিয়ে নানা মহলেই প্রশ্ন উঠেছে। খালেদা জিয়ার বক্তব্য নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বর্তমান সময়কে ‘ক্রান্তিকাল’ আখ্যা দিয়ে খালেদা জিয়া বিবৃতিতে বর্তমান সঙ্কটকে রাজনৈতিক আখ্যা দিয়ে বলেছেন, সরকার নিজেই এই সঙ্কট সৃষ্টি করেছে, যা ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। সঙ্কট উত্তরণে সরকার কর্তৃত্ববাদী মনোভাব থেকে সরে এসে একটি জাতীয় সংলাপের আয়োজন করবে এবং একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনতিবিলম্বে একটি নির্বাচনের আয়োজন এখন জরুরী। খালেদা জিয়ার জাতীয় সংলাপ ও নতুন নির্বাচনের দাবি নাকচ করে দিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম জনকণ্ঠকে বলেন, খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যেই প্রমাণ হয় যে, দেশে পরিকল্পিতভাবে একটি সঙ্কট সৃষ্টির জন্যই লন্ডনে বসে উনি দেশে এসব হত্যাকা- ঘটাচ্ছেন। তবে এমন গুপ্তহত্যা চালিয়ে খালেদা জিয়ার সংলাপ ও নির্বাচনের প্রত্যাশা কখনও পূরণ হবে না। আর দেশে কোন সঙ্কট নেই। দেশে যেসব সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটানো হচ্ছে, এর সঙ্গে জড়িত ও নেপথ্যের কুশীলবকে সরকার খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর। ইতোমধ্যে জড়িত বেশ ক’জন ধৃত ও চিহ্নিত হয়েছে। এদের রাজনৈতিক পরিচয়ও জানা গেছে। খালেদা জিয়ার নির্বাচন ইস্যুতে জাতীয় সংলাপের আহ্বান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে কীসের সংলাপ? কী কারণে সংলাপ? যারা পরিকল্পিতভাবে এসব হত্যাকা- ঘটাচ্ছে, যারা খুনী-সন্ত্রাসী-জঙ্গীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদ দেয়, যে নেত্রী (খালেদা জিয়া) এখনও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাস চালায়; তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোন ধরনের সংলাপের প্রশ্নই ওঠে না। নির্বাচনের আগে সংলাপ হবে দেশের জনগণের সঙ্গে, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে, কোন সন্ত্রাসী-জঙ্গী বা খুনীর দলের সঙ্গে নয়। সন্ত্রাসী-খুনীরা যেই হোক, খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। নেপথ্যের কুশীলবরাও রেহাই পাবে না। এ প্রসঙ্গে শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের আরেক সভাপতিম-লীর সদস্য ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের খালেদা জিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, এখন টেমস নদীর তীর থেকে ঢিল ছোড়া হচ্ছে। বিদেশের মাটিতে বসে নিক্ষিপ্ত ঢিলে কী সরকার পতন সম্ভব হবে? জাতীয় সংলাপ এভাবে হবে না। সংলাপ করতে হলে পরিবেশ রাখতে হবে। কারা লেখক, পুলিশ, বিদেশীকে হত্যা করছে? এভাবে কী সংলাপের পরিবেশ হয়? সংলাপের জন্য শক্তি, সাহস ও যোগ্যতা লাগে। সেটা কী তারা (বিএনপি) দেখাতে পেরেছে? সহিংস সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত চক্র দিনে দিনে কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠছে তার আবারও প্রমাণ মিলে গত বুধবার আশুলিয়ায় পুলিশের এক সদস্যকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায়। এর ১৩ দিন আগে একই কায়দায় মিরপুরে খুন হয়েছে আরেক পুলিশ সদস্য। মাঝে ঘটেছে একের পর এক মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষকে পরিকল্পিত হত্যা। এসব ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র আছে কি নেই বা একই গোষ্ঠী এসব ঘটাচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে তদন্ত চললেও একের পর এক এসব ঘটনা পরিস্থিতির ভয়াবহতাকেই তুলে ধরছে। প্রথমে রাজিব, তারপর অভিজিত, ওয়াসিকুর, অনন্ত, নিলয় হয়ে সর্বশেষ দীপন; সবাই একেবারে একই পদ্ধতিতে খুনীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হয়েছেন। তাদের সবার বিরুদ্ধে হয় নাস্তিকতার অভিযোগ, না হয় নাস্তিক মানুষের বই প্রকাশের অভিযোগ। মাঝে দুই বিদেশীকে হত্যা করে পুরো বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী-জঙ্গী রাষ্ট্র বাননোর অপচেষ্টাও হয়েছে। শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা করে দু’জনকে হত্যার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতাও প্রমাণের চেষ্টা হয়েছে। এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়েই যে ঘটনো হচ্ছে- তা জোরের সঙ্গেই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এসব ঘটনা ঘটিয়ে কার লাভ, আর কার লোকসান, তাও মিলিয়ে দেখছেন তারা। তবে ধারাবাহিক এসব ঘটনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক মন্ত্রী ও এক নেতার প্রশ্নবিদ্ধ মন্তব্যে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তাদের অভিযোগ, ধর্মান্ধ, বিকৃত মানসিকতাগ্রস্ত খুনীরা চাপাতি হাতে পুলিশসহ মুক্তবুদ্ধির মানুষকে হত্যা করছে, অন্যদিকে একনাগাড়ে কিছু রাজনীতিক ব্লেম গেমের সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠেছে। এটা কখনই শুভ হতে পারে না। মুক্তবুদ্ধির মানুষকে একের পর এক টার্গেট করে হত্যার পরও ‘এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ উল্লেখ করে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন দেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিরা। তাদের সবার প্রশ্ন- হামলার ঘটনা যদি বিচ্ছিন্নই হয়, তাহলে তা সুপরিকল্পিত হবে কীভাবে? আর যদি ‘সুপরিকল্পিত’ই হয় তাহলে তা ‘বিচ্ছিন্ন’ হলো কী করে? জঙ্গী, সন্ত্রাসী ও সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের ধরতে চেকপোস্ট বসানো হয়। কিন্তু সশস্ত্র পুলিশই যদি চাপাতি দেখে ভয়ে পালিয়ে যায়, তাহলে কী বার্তা পাবে সাধারণ মানুষ? দুজন সন্ত্রাসীর হামলায় কেন সশস্ত্র পাঁচ পুলিশ সদস্য এভাবে পর্যুদস্ত হবেন? কতখানি উল্লসিত হবে ঘাতকরা? পুলিশই সন্ত্রাসের শিকার হলে জনগণের নিরাপত্তাহীনতার ভীতি কাটাবে কে? তাদের মতে, এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর মাধ্যমে ও পরিকল্পিতভাবে একটি চিহ্নিত রাজনৈতিক গোষ্ঠী এসব হতাকা- ঘটাচ্ছে। তাই এসব পরিকল্পিত হত্যাকা-কে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা বললে ঘাতকরা কী নতুন খুনের নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে না? দায়িত্বশীল পদে থেকে এ ধরনের উক্তি শুধু অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল শক্তিকেই আতঙ্কিত করে তোলে না, সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকেও বলীয়ান করে । এ প্রসঙ্গে দেশের খ্যাতনামা লেখক, শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার ‘প্রিয় দর্পণ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে লিখেছেন, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব যার ওপর দেয়া হয়েছে তিনি যদি এখনও এই নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের মূল বিষয়টি ধরতে না পারেন যে এগুলো মোটেই বিচ্ছিন্ন নয়, সব একসূত্রে গাঁথা; তাহলে কার দিকে মুখ তুলে চাইব? বিচ্ছিন্ন ঘটনা মানেই গুরুত্বহীন করে দেয়া হলে আমরা কী হতবুদ্ধি হয়ে যাই না? যদি এসব হত্যাকা- ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চিতভাবেই হয় আমি বিচ্ছিন্ন শব্দটির অর্থ জানি না, না হয় আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘বিচ্ছিন্ন’ শব্দটির অর্থ জানেন না।
×