ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সিরাজুল এহসান

কুয়াশার চাদর সরিয়ে ক্ষরণচিত্র দেখি

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৬ নভেম্বর ২০১৫

কুয়াশার চাদর সরিয়ে ক্ষরণচিত্র দেখি

‘রানী ও কেরানি’ উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে ইমতিয়াজকে। ইমতিয়াজ একজন কেরানি। তার ছাত্রজীবনের ইতিহাস বলে দেয় কেরানি হওয়ার কথা ছিল না। মেধা, প্রজ্ঞা, ধী স্পষ্ট করে দেয় গন্তব্য ছিল অন্য পথে। কিন্তু বিধিবাম নয়- সামাজিক ও রাষ্ট্রীক বাস্তবতাই তাকে ঠেলে দেয় কেরানির দিকে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ইমতিয়াজকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় পারিপার্শ্বিকতা। আর এই পার্শ্বিকতা নিকট অতীত, আলোড়িত-আলোচিত ঘটনা। চলমান সময়ের টুকরো টুকরো চিত্র ফ্রেমবন্দী হয়ে একটি বিশাল ক্যানভাস সৃষ্টি হয়। সেই ক্যানভাসই হলো বাংলাদেশ, চলমান সামাজিক ও ভূরাজনীতি। উপন্যাসটি উপহার দিয়েছেন কবি মারুফ রায়হান। মারুফ রায়হানের মূল পরিচিতি কবি হলেও তিনি যে গদ্যেও সাবলীল ও দক্ষ সে প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আলোচনার খাতিরে ও সুবিধার্থে আমরা এখানে ‘ঔপন্যাসিক’ শব্দটির দ্বারস্থ হতে চাই। পাঠক যখন ইমতিয়াজকে পরিভ্রমণ করেন তখন তিনি আর দশটা সাধারণ কেরানির মতো থাকেন না। এই দেশ সমাজের পোড় খাওয়া, দগ্ধ একজন সৎ ও সাধারণ নাগরিকের প্রতীক হয়ে মনোজগতে স্থান করে নেন। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি ঘটনা তাকে আন্দোলিত করে। নিজের ভেতরে ক্ষরণ ঘটে। মানুষের কপটতা, অসততা তাকে করে আহত। অফিসে তিনি সবসময় নিজেকে ভাবেন ‘সংখ্যালঘু’ এটা তার দায়িত্ব ও সততার জন্য মনে হয়। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কিছু রাজনীতিক ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বিশেষ একটি বাহিনীর কর্মকা-ে তার অসহায়ত্ব পাঠককেও ভাবিয়ে তোলে বৈকি! ইমতিয়াজের এক অদ্ভুত স্বভাব আমরা দেখতে পাই। তিনি মত প্রকাশের জন্য তীব্র হয়ে ওঠেন। কিন্তু পারেন না। তার ক্ষোভ, মনোবেদনা বা বিচিন্তার প্রকাশ ঘটান দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার কাছে চিঠি লিখে। তবে তা বাস্তবে নয়, স্বপ্ন ও কল্পনার মধ্যে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি আজব হলেও শেষে পাঠক মানতে বাধ্য হন ইমতিয়াজের জন্য এটাই স্বাভাবিক। সাধারণ পাঠকও ইমতিয়াজের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে অনুরূপ ভাবতে বাধ্য হতে পারেন চলমান বাস্তবতার নিরিখে। ইমতিয়াজের লিখিত চিঠির কিয়দংশ তুলে ধরা যায়। এ চিঠিটি লিখেছেন সাধুরীতিতে। ‘হে মহারানী, আপনি আমার শ্রদ্ধাপূর্ণ সালাম জানিবেন। নগণ্য কেরানি হইয়া দেশের মহারানীকে পত্র লিখিবার ধৃষ্টতা অমার্জনীয় তাহা আমি অস্বীকার করিব না।... বিদায় ২০০৫ সাল।... বিদায়ী এই বর্ষটি ছিল বহুমাত্রিক ঘটনাপ্রবাহ দিয়া পরিপূর্ণ। বলা যায়, বছর জুড়িয়াই দেশের মানুষ চরম আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়া অতিবাহিত করিয়াছে। জামা’আতুল মুজাহিদীন বা জেএমবি নামক উগ্র মৌলবাদী সংগঠনের বোমা হামলায় বারংবার রক্তাক্ত ও প্রকাম্পত হইয়া উঠিয়াছে দেশের পবিত্র মৃত্তিকা।’... অন্যদিকে আরেক রাজনীতিকের কাছে চিঠি লেখেন এভাবে- ‘হে রাজকন্যা, না আপনাকে এভাবে সম্বোধন করতে আমার সঙ্কোচ হচ্ছে। হে রানী, নাহ্্ খুবই কৃত্রিম শোনাচ্ছে। বরং কোন সম্বোধন ছাড়াই আপনাকে কিছু বলতে চাই। আনুষ্ঠানিকতার কী প্রয়োজন।... আপনি হলেন একজন বিশাল হৃদয়ের মানুষের সন্তান। আমার/আমাদের মতোই টানাটানির না হোক, অনেক সময়ই অনেক অসচ্ছলভাবে আপনাদের জীবন কেটেছে। দেশের জন্য আপনার পিতা যখন জেলে অন্তরীণ থাকতেন তখন আপনাদের গোটা পরিবারের ওপর দিয়ে কী কী বয়ে যেত সেটা এখন আর কেউই ভেবে দেখে না। আপনি দেশের লাখ লাখ হতদরিদ্র মানুষের কষ্টের কথা না বুঝলে কে বুঝবে আর, বলেন?’... এই যে আস্থাহীনতা আর আস্থার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে দুই নেতাকে ঘিরে তা থেকে কি সময় ও সাধারণ মানুষ পেরেছে বেরিয়ে আসতে? ঔপন্যাসিক এখানে বাস্তবতার চিত্র ফুটিয়ে তুলতে যে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তা অভিনব ও নান্দনিক। ইমতিয়াজকে ঘিরে যেসব চরিত্রের সম্মিলন আমরা দেখতে পাই তাদের পরিচিতি ও ভূমিকা পাঠক পান স্বল্প পরিসরে। এটা ঔপন্যাসিকের পরিমিতিবোধের স্বাক্ষর। মারুফ রায়হানের মূলভিত্তি কবিত্ব হলেও তিনি সচেতনভাবেই বোধকরি এড়িয়ে গেছেন উপন্যাসে কাব্যিক আবহ সৃষ্টির প্রয়াস। এটা নিঃসন্দেহে কঠিন ও ধন্যবাদার্হের কাজ। কেননা নিজের ভিত্তি ও বলয় ভেঙে বেরিয়ে মোহমুক্ত হয়ে নতুন সৃষ্টি উপহার দেয়া স্বসৃষ্টি ও শিল্পের প্রতি নির্মোহ দায়বদ্ধতার প্রকাশ। এই প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন। ‘রানী ও কেরানি’ উপন্যাসে যে বিষয়টি পাঠকের স্মৃতিকোষে আবদ্ধ হয়ে থাকবে তাহলো- দেশের রাজনীতিতে ওয়ান ইলেভেনের আঘাত। দেশকে রাজনীতিহীন করে দুই নেতাকে মাইনাসের যে হীন প্রচেষ্টা করেছিল একটি স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী; তাদের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল তার একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন ঔপন্যাসিক বিমূর্ত অবয়বে। ‘মাইনাস মাইনাস’ খেলার পরিণতি কেমন ও কী হতে পারত? কেন্দ্রীয় চরিত্র ইমতিয়াজ ভাবতে পারেন না। তিনি কেন কোন প্রেক্ষাপটে চিৎকার করে বলেন, ‘এখানে এখন শয়তানই শুধু আশাবাদী’ তা জানতে হলে উপন্যাসটি পাঠ করা আবশ্যক। উপন্যাসটি ২০১৪ সালের জনকণ্ঠ ঈদ-উল-ফিতর বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশের পর চলতি বছর বইমেলায় প্রকাশ করেছে চিত্রা প্রকাশনী। শিল্পীত ও নান্দনিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। উপন্যাসটি বহুল পঠিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
×