ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বহুমুখী উন্নয়নের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে জোরেশোরে

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৫ নভেম্বর ২০১৫

বহুমুখী উন্নয়নের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে জোরেশোরে

রহিম শেখ, পঞ্চগড় থেকে ফিরে ॥ সত্যিই ভাগ্যবান নতুন বাংলাদেশীরা। গেল ৪৬ বছরে যে অতৃপ্তি ছিল, সেই প্রত্যাশা পূরণের পথেই অধুনালুপ্ত ১১১টি ছিটের বাসিন্দারা। বাংলাদেশের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রায় ১৭ হাজার ১৬০ একর আয়তনের ছিটমহলে দেরিতে হলেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। নির্মাণ হচ্ছে রাস্তা-ঘাট-ব্রিজ। শুরু হয়েছে স্কুল ও ক্লিনিক নির্মাণের কাজ। বিনামূল্যে বিদ্যুত সংযোগ পৌঁছে যাচ্ছে ছিটের নাগরিকদের ঘরে ঘরে। বিলি করা হয়েছে সৌর বিদ্যুত প্যানেল। এগিয়ে যাচ্ছে আইডি কার্ড ও ভোটার তালিকার্ভুক্তির ব্যবস্থা। নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনার লক্ষ্যে স্থাপন করা হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। মূলধারার অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে ছিটের ৩৭ হাজার নাগরিককে। সাবেক এ ছিটমহলে অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবার আওতায় বাড়ানো হয়েছে ব্যাংকিং সেবার পরিধি। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলেও ভবিষ্যতে ছিটমহলগুলোতে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। জানা যায়, বাংলাদেশের ভূখ-ে ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি ও নীলফামারীতে চারটি অবস্থিত। এর মধ্যে পঞ্চগড় জেলার সদর থানায় ৭টি, বোদা থানায় ১৯টি, দেবীগঞ্জে ১৪টি, বোদা ও দেবীগঞ্জের মধ্যবর্তী ২টি, দেবীগঞ্জ ও ডোমারের মধ্যবর্তী ৩টি। নীলফামারী জেলার ডিমলায় ৪টি, লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে ৫৪টি, হাতীবান্ধায় ৪টি (এর মধ্যে ২টির অবস্থান প্রাপ্ততথ্য সূত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই), লালমনিরহাট সদর ও ফুলবাড়ীর মধ্যবর্তী দুটি, ফুলবাড়ী ও নাগেশ্বরীর মধ্যবর্তী ১টি, কুড়িগ্রাম সদরে একটি এবং কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারীতে ১২টি অবস্থিত। গত ৬৪ বছর ধরে নিজ দেশের মূল ভূখ-ের সঙ্গে এসব ছিটমহলের সরাসরি কোন যোগাযোগ না থাকায় রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ছিল না। এ কারণে সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে অবরুদ্ধ জীবনযাপন করে আসছিলেন ছিটমহলবাসী। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পরস্পরের ছিটমহলগুলো আয়তন, অবস্থান ও জনসংখ্যার দিক থেকে খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ। ছিটমহলগুলো বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মাত্র কয়েক মিটার দূরত্ব থেকে শুরু করে কয়েক কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সবচেয়ে ছোট ছিটমহলের আয়তন শূন্য দশমিক ২৭ একর, যেখানে কোন জনবসতি নেই। অন্যদিকে সর্ববৃহত ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার আয়তন ৩৮৭৭ দশমিক ০৫ একর এবং এখানকার জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার। কোন কোন ক্ষেত্রে একাধিক ছিটমহল একই সঙ্গে অবস্থিত। যেমন- পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জের চারটি ছিটমহল শালবাড়ী, নাটকটোকা, বেওলাডাঙ্গা ও কাজলদিঘি একই সঙ্গে অবস্থিত। এসব ক্ষেত্রে একাধিক ছিটমহল একটি মৌজায় অন্তর্ভুক্ত। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে একটি বড় ছিটমহল একাধিক মৌজায় বিস্তৃত। ছিটমহলগুলোর প্রায় অনির্ধারণযোগ্য জটিল আকার ও আয়তন সত্যি বিস্ময়কর। বাংলাদেশের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রায় ১৭ হাজার ১৬০ একর আয়তনের ছিটমহলে দেরিতে হলেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে দেয়া বিদ্যুত সংযোগ। দাসিয়ারছড়াসহ পঞ্চগড়ের সাবেক ছিট দহলা খাগড়াবাড়ী, কোটভাজনী, কাজলদিঘি, শালবাড়ী ও পুটিমারী এবং লালমনিরহাট জেলার সাবেক ছিট খারিজা শিয়ালদহ ১ ও ২ এবং নগরজিগাবাড়ী এলাকার ২ হাজার ৫৬১টি পরিবারে বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়েছে। বিদ্যুতের লাইন নিতে গ্রাহককে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ জমা দিতে হয়, কিনতে হয় মিটার। কিন্তু এসব এলাকায় গ্রাহকদের কিছুই প্রয়োজন হয়নি। যারা আবেদন করেছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাদের বাড়িতে বিনামূল্যে বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়েছে। নির্মাণ হচ্ছে রাস্তা-ঘাট-ব্রিজ। সরেজমিন পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি ছিট ঘুরে দেখা যায়, কিছু জায়গায় ইট ফেলে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। কোথাও দেখা গেল মাটি ভরাট করে রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে। গ্রামের রাস্তা-ঘাট ভাল না খাকায় আগে যেখানে যানবাহনের প্রবেশই ছিল না, সেখানে এখন সাই সাই করে যানবাহন ঢুকছে। কথা হয় দহলা খাগড়াবাড়ী এলাকার বাসিন্দা রশিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এক সময় শহরের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগই ছিল না। এখন রাস্তা-ঘাট ভাল হওয়ায় আমরা এখন নিয়মিতই শহরে যেতে পারি। বর্তমানে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে কাঁচা রাস্তাই একমাত্র ভরসা, তাই আগামী বর্ষায় চলাচল খুব কষ্টকর হবে, এজন্য পাকা রাস্তা করার দাবি জানান এলাকাবাসী। পঞ্চগড়ের কয়েকটি ছিটমহল ঘুরে দেখা যায়, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) অধীনে ২৭৪ কিলোমিটার সড়ক নেটওয়ার্ক সার্ভে করা হয়েছে। স্থানীয় প্রকৌশলীরা জানালেন, এর মধ্যে মূল ভূখ-ের সঙ্গে বিলুপ্ত ছিটমহলের ১১৪ কিলোমিটার সড়ক সংযুক্ত করা হবে। সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি ১৯৪ মিটার ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। সড়ক ও ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণে ৭৫ কোটি ৯ লাখ টাকার বরাদ্দপত্র জরুরীভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন জানান, অধুনালুপ্ত ছিটমহলগুলোর ১০টি স্থানে হাটবাজার, ২টিতে ইউনিয়ন পরিষদ, ৮টি স্থানে প্রাইমারী স্কুল এবং বিশুদ্ধ জলের জন্য ১৭৫টি টিউবওয়েল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের ৪ হাজার ৮৬২ জন শিক্ষার্থীকে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বিলুপ্ত ছিটমহলে ৮০৯ জন বয়স্কভাতা, ৫২১ জন বিধবা ভাতা, ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রতিবন্ধীকে ভাতা দেয়া শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে ডিজিটাল সাব সেন্টার, ৩টি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প, ৩টি অস্থায়ী কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রাম জেলার ছিটমহলগুলোর উন্নয়নে সেখানে একটি বিশেষ শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা বলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে মূলধারার অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে প্রায় ১৭ হাজার ১৬০ একর আয়তনের ১১১টি ছিটমহলের ৩৭ হাজার নাগরিককে। সাবেক এ ছিটমহলে অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবার আওতায় বাড়ানো হয়েছে ব্যাংকিং সেবার পরিধি। ইতোমধ্যে ছিটমহলে বসবাসকারী মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অধিকার সুনিশ্চিত করা এবং এসব অঞ্চলে কৃষি কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কৃষি ঋণ বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের মানচিত্রে সদ্য অন্তর্ভুক্ত ছিটমহলগুলোর কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের গ্রুপভিত্তিক এসএমই ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ছিটবাসীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার নির্দেশও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের রংপুর অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক খুরশীদ আলম জনকণ্ঠকে বলেন, এসব এলাকার মানুষের ঋণ গ্রহণে জাতীয় পরিচয়পত্র ও জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলেও বিশেষ কর্মসূচীর আওতায় তফসিলভুক্ত বিভিন্ন ব্যাংক থেকে দ্রুত ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। ঋণ বিতরণের প্রাথমিক পর্যায়ে ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের গুরুত্ব দেয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আলাদা ঋণ কার্যক্রম প্রস্তাব পাঠানো হবে। তিনি আরও বলেন, পেশা অনুযায়ী ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। সম্প্রতি তাদের জীবনমান উন্নয়নে মানবিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অর্থ সহায়তা ও পণ্য সামগ্রী দেয়া হয়েছে। জমির মালিকানা না থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ দেয়া হয়েছে দেবীগঞ্জ উপজেলার গাড়াতি গ্রামের বাসিন্দা মোশাররফ হোসেনকে। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, কখনও কোন সরকারী লোক, কিংবা এনজিও আমাদের গ্রামে আসেনি। পাশের গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ দিলেও, ছিটের বাসিন্দা বলে আমরা ঋণ পাইনি। সারাজীবন অন্যের জমিতে চাষ-বাস করেছি। অর্থাভাবে ছেলে-মেয়েদের ঠিকভাবে পড়াশোনাও করাতে পারিনি। আজ আমাদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে সরকার। তিনি বলেন, কখনও ভাবতে পারিনি জমি না থাকলেও ব্যাংক থেকে ঋণ পাব। এই ঋণের টাকা দিয়ে মসলা উৎপাদন করবেন বলে জানান মোশাররফ। ছিটের নাগরিকদের জন্য আইডি কার্ড ও ভোটার তালিকার্ভুক্তির ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। নতুন ভোটার তালিকা হালনাগাদ কাজের তথ্য সংগ্রহ শেষ হওয়ায় শীঘ্র বিলুপ্ত ছিটমহলে ভোটার নিবন্ধনের কাজ শুরু করার জন্য বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণ করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটার করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সম্প্রতি লালমনিরহাটের চার বিলুপ্ত ছিটমহলের ভোটার এলাকা পুনর্বিন্যাসের নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। পর্যায়ক্রমে বাকি ১০৭টি বিলুপ্ত ছিটমহলের বিষয়ে একই ধরনের নির্দেশনা দেয়া হবে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, লালমনিরহাট জেলার সদর উপজেলার বিলুপ্ত ১৫১ বাঁশপাই ও ১৫২ বাঁশপাই ভিতরকুটি ছিটমহল কুলাঘাট ইউনিয়নের এক নম্বর ও পাঁচ নম্বর সাধারণ ওয়ার্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। হাতিবান্ধা উপজেলার বিলুপ্ত ১৩৫ গোতামারী ও ১৩৬ গোতামারী ছিটমহল গোতামারী ইউনিয়নের এক নম্বর সাধারণ ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
×