ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শততম মঞ্চায়নে দেবী

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৫ নভেম্বর ২০১৫

শততম মঞ্চায়নে দেবী

মানুষের মনের ক্ষত সহজে শুকাবার নয়। সেই রক্তাক্ত অতীতের ক্ষত কখন কিভাবে যে মানুষটির বর্তমানকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সে কথাতো বলতে পারেন মনোবিজ্ঞানী। বাসের সিটে এলিয়ে পড়া রূপালী চুল দেখে রমণীকে আক্রমণ করে বসা এক যুবকের কার্যকারণ আবিষ্কার করেছিলেন মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড। যুবকের শৈশবে সর্বক্ষণিক মায়ের কাছে থাকা এবং কর্মসূত্রে বিদেশে থাকা অপরিচিত বাবার হঠাৎ উপস্থিতি তাকে শুধু আক্রোশী বানায়নি বরং বাবা মায়ের একান্ত মুহূর্তে শিশুটির উপস্থিতির কারণে অপরিচিত বাবা রূপি মানুষটি যখন তাকে ছুড়ে ফেলে গোয়াল ঘরে তখন সান্ত¡না না দিয়ে বরং পুরুষ লোকটির বাহুবন্ধনে আবদ্ধ মায়ের উল্লাস ও ভেতর ঘরে চলে যাবার ক্ষণে দৃশ্যমান ছিল পিঠে সেই এলিয়ে পড়া রূপালী চুল। যুবকটির বর্তমানে আক্রমণের পেছনে ঐ সেই অতীতের তাড়না। আবিষ্কারক ফ্রয়েড বাস্তব চরিত্র। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলী কাল্পনিক চরিত্র। দেবী উপন্যাসেই তার শুভ জন্মক্ষণ। ষোল-সতের বছর বয়সী বানুর দাম্পত্য জীবনের একান্ত মুহূর্তে হঠাৎ অশরীরি দেবীর উপস্থিতির কার্যকারণ আবিষ্কারে মিসির আলীর ভূমিকা ও ব্যাখ্যা নিয়ে নাট্যদল বহুবচন প্রয়োজিত, হুমায়ূন আহমদ রচিত, মোঃ ইকবাল হোসেন নাট্যরূপদানকৃত এবং নির্দেশক আরহাম আলো নির্দেশিত নাটক ‘দেবী’র শততম মঞ্চায়ন মঞ্চস্থ হল গত ৩০ অক্টোবর শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল হলে। হলে বসে না বরং বাহাত্তর সালে মতিঝিল নিপুনা পেট্রোল পাম্পে বসে একদল সদ্য রণাঙ্গন ফেরত যুবকদের দেশ গড়ার দীপ্ত প্রত্যয়ের ফসল নাট্যদল বহুবচন। তেতাল্লিশ বছরের দীর্ঘ পথচলায় গত ২১ বছর ধরে দেবী নাটকের মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে ‘দেবী’র শততম মঞ্চায়ন। দেবী নাটকটি যেমন দীর্ঘ সময় ধরে মঞ্চায়ন হচ্ছে ঠিক তেমনি দেবী নাটকের কেন্দ্রিক চরিত্র আনিসের স্ত্রী রানু দীর্ঘদিন ধরে দেবী সত্তার অশীরিী উপস্থিতি টের পেয়ে ক্রমান্ধয়ে মানুষিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কার্যকারণের ব্যাখ্যায় মিসির আলী আবিষ্কার করে, একদিক পোড়া মন্দিরের প্রান্তে এক লোভাতুর জালালুদ্দীনের হাতে রানুর অপদস্ত হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত কাকতালীয়ভাবে সুরক্ষা পাবার পেছনে যে শক্তি তাকেই দেবী ভাবে রানু। ফলে আজ স্বামীর একান্ত উপস্থিতি যুগপৎ তার কাছে মানুষ সৃষ্ট আতংক এবং দেবীর সুরক্ষা। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতাইতো মানুষকে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা করে তোলে। ফলে রানুর বাড়ির মালিকের বড় কন্যা নীলু আজ যখন একইভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হবার ফাঁদে পড়ে তখন রানু তার দৈব শক্তি দিয়ে নীলুকে সুরক্ষা দেয়। মনোবিদ মিসির আলী অতীতের ব্যাখা যৌতিকভাবে দাঁড় করাতে পারলেও নীলুকে সুরক্ষার ব্যাখা দাঁড় করাতে পারে না। দেবী হয়তো নেই কিন্তু দৈবিক শক্তিকে মেনে নেব নাকি নেব না এই মিসির আলীর মানসিক টানাপোড়েন শুরুর মধ্য দিয়ে শেষ হয় নাটক দেবী। দেবী নাটক এবং নন্দিত নরকে নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়েই সমকালেই হুমায়ূন আহমদকে সম্মান জানানোর সফল গৌরবের দাবিদার বহুবচন। প্রয়ানের পর মায়াকান্না আর সমকালে ধিক্কার জানানোর দৈন্যতার বাইরে থাকায় বহুবচন প্রশংসা পেতেই পারে। নিদের্শক আবহাম আলো তেতাল্লিশ বছর ধরে দল করছে আবার দলীয় কর্মীদের যাওয়া আসার চক্করে পড়ে বিভ্রান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত নাটকটা করছেন। যে কারণে একই মঞ্চে একই সেটে অসংখ্য জোন তৈরি করে সলতে প্রদীপের আলোয় বসে নাটকটা হচ্ছে। হয়তো সেট-লাইট কস্টিউমের গিমিক নেই কিন্তু আছে শক্ত নাটক আর নাটকীয় অভিনয়। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে এক সময় যেমন গায়কী কথা সরে যেয়ে তরঙ্গ দর্শকদের হৃদয়কে নিভৃতে পৌঁছে দেয় ঠিক তেমনি আরহাম আলোর নির্দেশনায় শেষ পর্যন্ত কিছু অভিনেতা অভিনেত্রীর প্রাণান্তকর চেষ্টা দর্শকদের ভালবাসা কেড়ে নেয়। প্রচার-প্রচারণা কাড়াকাড়ির ভিড়ে রানুর পাগলামোকে সামাল দিতে স্বামী আনিস রূপী অভিনেতা মোহাম্মদ উল্লাহ মাহমুদের বুদ্ধিদীপ্ত ভোলাভোলা চরিত্রাভিনয় নান্দনিক। হিংস্র মুখে লুকিয়ে মায়াবী এবং মন পটানো মুখোশধারী আহম্মেদ বাসেরের চরিত্রে আরহাম আলোর অভিনয় দেখলে বোঝা যায় দীর্ঘ যাত্রাপথে তিনি ম্যারথন রেসের যাত্রী। নীলু রূপী ম্যাগডিলিন গমেজ রীনা এবং আহম্মেদ বাসের রূপী আরহাম আলোর রোমান্টিক রসায়ন উৎফুল্লের। বীলু রুপী স্বর্ণার উপস্থিতি নাটকের গতিকে গতিশীল করে। রানু রূপী রচনার অভিনয় পরিশ্রমী কিন্তু প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্রের জন্যে বাহ্যত আভিজাত্য আরও দরকার ছিল। কোনটা দরকারী কোনটা অপ্রয়োজনীয়, কোনটা কথা কোনটা বাচালতা, কোনটা বিবেচ্য কোনটা পরিত্যাজ্য, কোনটা গবেষণা কোনটা অনীহা, কোনটা মীমাংসা কোনটা অমীমাংসা তথা বাহ্যত বিশৃঙ্খল কিন্তু অন্তরাত্মায় শৃঙ্খলরুপী মিসির আলী চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় অভিনেতা তৌফিকুর রহমানের। অভিনয় জীবন এবং ব্যক্তিজীবন শেষ পর্যন্ত যে মঞ্চ মিলে যায় সাহিত্যের সত্য আশ্রয়ে, শিল্প সত্য আশ্রয়ে তা তাকে না দেখলে বোঝা দায়। বোঝা দায় জীবন থেকে ঝড় থামে নাকি জীবন এগিয়ে চলে ঝড়কে সামলিয়ে। সামলে থাকবার এবং সামলিয়ে চলবার প্রেরণা যোগায় বহুবচনের নাটক ‘দেবী’।
×