ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আলিশার আলিশান অভিষেক...

প্রকাশিত: ০৪:২২, ৫ নভেম্বর ২০১৫

আলিশার আলিশান অভিষেক...

‘আমি দিয়াশলাই, ছুঁলে আগুন হয়ে যাই’, ‘অন্তরঙ্গ’ চলচ্চিত্রের আইটেম গানের মাধ্যমে এতটুকু অন্তত জানা হলো আলিশা সম্পর্কে। সত্যিই কি তিনি দিয়াশলাই? ছুঁলে আগুন হয়ে যান? ‘যা সাড়া পাচ্ছি, পর্দার ক্ষেত্রে বিষয়টি আসলেই সত্যি।’ হাসতে হাসতে বললেন আলিশা। বাস্তবে কেমন? ‘বাস্তবে আমি আরও বেশি হট, একদমই ছোঁয়া যায় না বলতে গেলে, সবদিক থেকেই। আমি প্রতিবাদী, অনেক বেশি যৌক্তিক। আমার সামনে কেউ ভুল বললে ব্যাপারটা সহ্য হয়না। যেটা একজন মানুষের জন্য ক্ষতিকর।’ আগুন ঝরছিল আলিশার কথায়। শীতকাল চলে এসেছে। সন্ধ্যের পরের এই সময়টাতেও ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। কথার আগুন শীতে ছুড়ে দিলাম। শীতকাল কেমন লাগে? ‘অনেক বেশি উপভোগ করি। ফ্যাশনের ক্ষেত্রে তো অনেক বেশি মজা লাগে।’ উচ্ছ্বসিত হয়ে জানালেন আলিশা। জীবনের অনেকটা সময়ই আমাদের অভিনয় করে যেতে হয়, বেঁচে থাকার অভিনয়। তবুও সেই অভিনয়টাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিলেন এই চটপটে মেয়েটি! কেন? ‘বাস্তব জীবনে আমি অভিনয় করি না, খুব সোজাসুজি মানুষ। সেজন্যই হয়তো সিনেমার নায়িকা হতে আমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে।’ তার মানে কোথাও না কোথাও অভিনয় করতে হবে বলেই কি চলচ্চিত্রে আসা! ‘হয়তোবা.. হতেই তো পারে, তাই না?’ চাষী স্যার চলে গেলেন এ বছরের প্রথমেই। তাঁর সাথে আলিশার সম্পর্ক খুব দীর্ঘদিনের না হলেও তীব্র ছিল। ‘স্যারের সাথে আমার সম্পর্কটা একদমই অন্য মাত্রার। সিনেমা করার জন্য আমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেখানে আমার মনে হয়েছিল যে আমাকে কেউ বুঝতে পারছে, কিন্তু আমি সেটা বুঝতে পারছি না। যখন আমি সব মিলিয়ে হতাশ, সেই শেষ মুহূর্তে চাষী স্যার ফোন করে বললেন- আমি চাষী। আপনি কি আমার সিনেমায় অভিনয় করবেন? এত সরলভাবে উনি আমাকে কাজের প্রস্তাবটি দেন। সেই প্রথম দেখা শেষে আমি তাঁর প্রেমে পড়ে যাই। অন্তরঙ্গ ছবির নায়ক আমার জন্য চাষী স্যার। কেউ যদি বলে আমি একজনকে খুন করলে চাষী স্যার ফিরে আসবে, আমি দশজনকেও খুন করতে দ্বিতীয়বার ভাববো না। আমি ওনাকে এতটাই ভালবাসি।’ চলতে থাকা ট্রেনের মতো করে একনাগাড়ে বলে চলছিলেন আলিশা। ‘উনি খুব সাহসী, প্রতিবাদী, সোজাসুজি চলা মানুষ। তাঁর চুল থেকে হাত-পা সবকিছুই কথা বলতো। উনি চ্যাম্পিয়ন। ওনার মতো একটা মানুষ লাখ মানুষকে একত্রিত করতে পারতেন।’ আমরা আমাদের কালজয়ী মানুষগুলোকে সম্মান দিতে শিখিনি। এটা খুবই লজ্জাজনক। চাষী নজরুল ইসলাম কি জীবিত থাকাকালীন সময়ে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু পেয়েছেন? ‘না। উনি নিজেকে যেই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, বাংলাদেশের উচিশ ছিল ওনাকে সম্মান দিয়ে সেই স্থানে রাখা। পসটা হয়নি। আজকে বাংলাদেশের ইতিহাস কিন্তু তাঁর সিনেমার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই। উনি এমনই একজন, যিনি বঙ্গবন্ধুকেও অভিনয় করিয়েছেন। সে কী না করেছেন সংস্কৃতির জন্য! সাহিত্য নিয়ে পর্যন্ত তিনি ছবি করেছেন ছয়-সাতটি, যেই সাহিত্য নিয়ে সাধারণত কেউ ছবি করার চিন্তাও করে না ভয়ে। যেই মুহূর্তে সিনেমার খুব খারাপ সময় ছিল, সেই সময়ও তিনি লাইনে সবার আগে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতেন। বলতেন- আমি তো আছি! ওনাকে দেখে মানুষ সিনেমায় আসতে চাইবে। অথচ কিছু কিছু পরিচালক-প্রযোজককে দেখলে ভয় লাগে, ঘৃণা হয়।’ এত নির্বিঘেœ সত্য কথা বলার জন্য সাহস লাগে। আলিশার আছে সেটা। এই সাহসী মেয়েটি বড় পর্দায় আসছেন ‘অন্তরঙ্গ’ ছবির মাধ্যমে। কেমন সে ছবি? ‘মনে পড়ে, চাষী স্যার বলতেন- আলিশা আমি তো যুদ্ধের উপর অনেক ছবি করলাম, সাহিত্যের উপর করলাম, বাণিজ্যিকও করলাম। কিন্তু, একদম নাচে-গানে ভরপুর সিনেমা তো আমিও করতে পারি! এভাবেই অন্তরঙ্গের জন্ম। স্ক্রীপ্টটা অনেক বেশি শক্তিশালী। এর থেকে বেশি বাণিজ্যিক সিনেমা আর হয় না। ঠিক যেন ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’। ‘পুরনো মদ’ আমি বলতে চাই চাষী স্যারকে, ‘নতুন বোতল’ আমি বলতে চাই আমাকে।’ একটু হাসলেন আলিশা। তারপর বললেন, ‘আমার যে চরিত্র, সেটা গতানুগতিক বাংলা সিনেমায় নায়িকাদের যেমন দেখি, তার থেকে ব্যতিক্রম। এখানে একজন আমি খুব প্রতিবাদী, স্বাধীন, সাহসী।’ বক্তৃতার মতো করে কথা বলতে পারে তাই তো? নিজের বাচনভঙ্গী সম্পর্কে এমন কথা শুনে উচ্চহাসিতে কাঁপিয়ে তুললেন রাত ডেকে আনা অন্ধকারকেও। অত:পর শুরু করলেন, ‘সে এতটাই প্রতিবাদী যে, মেয়েদেরকে রক্ষা করে বিভিন্ন জায়গা থেকে। রাত বারোটার সময়ও সে পাবলিক বাসে করে চড়ে বেড়ায়। একটা ছেলেকে যদি সে পছন্দ করে, তাকে সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব দেয়। ছেলেটি যখন সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়, রাত তিনটার সময় তার বাসায় গিয়ে মাকে বলে আসে- আপনার ছেলেকে কিন্তু উঠিয়ে নিয়ে যাবো।’ তার মানে ‘সন্ত্রাসী ভালবাসা’! বিস্ময় আমার। ‘হা হা হা... আপনি আগে কোথায় ছিলেন! এই নামটা কেন আগে দিলেন না! জানি না, আজকে চাষী স্যার থাকলে যে এই নামটি নিয়ে কী মজা করতেন! আপনাকে বলতেন- মাহবুব সাহেব, আপনি যে নামটি দিয়েছেন সেটার জন্য সারাজীবন রয়্যালিটি পাবেন। যাই হোক, ছবিটির শুরু যেখানে, শেষটা ঠিক তাঁর বিপরীতে। পুরো ছবিটি একদম শেষ পর্যন্ত না দেখে কেউ বলে দিতে পারবে না গল্পটি।’ সাধারণত আমাদের অধিকাংশ সিনেমায়ই ব্যবহৃত গানগুলোর সাথে সিনেমার গল্পের কোন মিল থাকে না। বিষয়টা ঠিক এমন, ছয়-সাতটা গান রাখতেই হবে। গল্পের সাথে যাক আর না যাক। অন্তরঙ্গতেও কি তাই হয়েছে? ‘আমাদের ছবিতে গান ছিল মোট ছয়টি। গল্পের কারণে সিনেমার নায়িকাকে আইটেম গানটি করতে হয়েছে। বাকি আরও পাঁচটি গান ছিল। চাষী স্যার যখন গল্পটি নিয়ে বসলেন, তখন তিনি মোট চারটার বেশি গান রাখতে পারলেন না। দুটি গান ফেলেই দিলেন গল্পের খাতিরে।’ আলিশার কথা শুনতে শুনতেই ভিন্ন একটা প্রসঙ্গের পথে হাঁটলাম। আমাদের আচরণ, কথা বলা, পোশাক, দর্শন- সবকিছুতেই দিনদিন পাশ্চাত্যের ছোঁয়াটা বেড়েই চলেছে। সিনেমাতেও এর প্রভাব পড়ছে। বিষয়টা কেমন? ‘গত ক’বছরে পোস্টারে কিংবা ফটোশ্যূটে যেসব আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমরা কিন্তু তাতে অভ্যস্ত না। খুব হঠাৎ করেই একটা প্রচলন শুরু হলো কাট-কপি- পেস্টের। কিছু দৃশ্য পুরোপুরিই নকল। কিছু গানও তেমন। সাজ-সজ্জায়ও যতটা ছোট জামা-কাপড় পরা যায়। আমরা শুধু পাশ্চাত্যের ছোঁয়া না, পাশ্চাত্যের মা-বাবাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছি। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এতটা আগানো না। আমি দুঃখিত। যখন আমি সিনেমার জন্য গান করছি, আমাকে একটা ছবি দেখিয়ে বলা হচ্ছে- আপনি এই মিনি পোশাকটা কেন পড়ছেন না! আমি বলি যে ভাই, আমাদের তো একটু বাংলাদেশকে ভাবতে হবে! তখন তারা বলছে- না না, বলিউড-হলিউডে এটা চলে। এটা কিন্তু করতে হবে! কারিনা কাপুররা তো এত নখরামি করে না! দেখুন, ওদের ওখানে যা যা হয়, সবই ওদের সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে কমপক্ষে ৭০বছর আগে থেকে। আমরা তো তেমন নই! অথচ চৌদ্দ বছরের একটা বাচ্চাকে নায়িকা বানাতে আমরা দু’বার ভাবি না। চল্লিশ বছরের সেও নায়িকা! দুজনেরই একই রকম চরিত্র, একই জামা কাপড়, একই মেকআপ! এই মেকআপ নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কে কত কেজি আমরা মেকআপ নিতে পারি, কে কত বেশি কাপড় খুলতে পারি। এটা কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব। এখানে কারা পরিচালক হতে পারছে অধিকাংশ সময়ই? কারা? এখানে তেলামির বিষয় আছে, কিছু রাজনীতি আছে। কোন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ কিন্তু এত ভণিতার মধ্য দিয়ে যাবে না! আমাকে যদি আমার পরিচালক বলে, আলিশা আপনাকে চরিত্রের কারণে বিকিনি পরতে হবে। আমি অবশ্যই না করে দেবো। কারণ আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবো না।’ বলছিলেন আলিশা। তাঁর ছোড়া শব্দগুলো যদি সংশ্লিষ্ট কেউ কানে দেয়, আমাদেরই উপকার। কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকছেন আজকাল তিনি। গত সাতদিন টানা ঘুমাননি। কাজ ছাড়া জীবনটা কেমন? প্রশ্নটা শুনেই নস্টালজিক হয়ে পড়লেন আলিশা। আবেগঘন কন্ঠে বললেন, ‘আমার জীবনটা অনেক সুন্দর ছিল, চাকচিক্যময়। আমি একটা রাজকন্যা ছিলাম। সবসময় নিয়মের মধ্যেই কাটতো। পনেরো বছর হতেই বাবার কোম্পানিতে আমি চাকরি করি। আমার একটা কর্পোরেট সার্কেল ছিল। কিন্তু, গত দুই বছরে আমি সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছি। কোথায় যেন একটা কিছু হারিয়ে গেছে..’ কোন মাত্রায় চলচ্চিত্রকে ভালবাসলে নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে এভাবে বিসর্জন দেয়া যায়! ভাবনায় বিষয়... আলিশা তাঁর বিসর্জনের মূল্য যেন দর্শকের ভালবাসায় পান, ‘অন্তরঙ্গ’ অন্তত সেই জায়গাটুকু করে দেবে, এটাই প্রত্যাশা...
×