টিএটি খুব দুর্ভাগ্যজনক যে, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-কে কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার কাজ বলে জাতিকে এখনও বুঝানো হচ্ছে। কিন্তু জাসদের উত্থানপতন নামে এক গ্রন্থে মহিউদ্দিন আহম্মদ লিখেছেন- সে রাতে ৭০০ সৈনিক এবং ৩০টি ট্যাঙ্ক নিয়ে খুনীরা ঢাকা শহরে ঢাকঢোল পিটিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে হত্যা করেছে।
১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে জাতি প্রত্যক্ষ করল ২ নবেম্বর ’৭৫ রাতে ঢাকা জেলে জাতীয় ৪ নেতা হত্যাকাণ্ড। এটা নাকি বিপ্লব?
১৫ আগস্ট থেকে ৭ নবেম্বর ’৭৫ সময়কালে সংঘটিত ঘটনাকে বিএনপি যেভাবে দেখে তার চাইতে জাসদ ‘সিপাহী জনতার’ বিপ্লব বলে দাবি করলেও মৌলিক পার্থক্য সামান্যই। জিয়ার কৌশলে জাসদ ৭ নবেম্বরের ঘটনায় ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। তারা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য ক্যান্টনমেন্টে সিপাহীদের মধ্যে লিফলেট বিতরণ করেছিল এই বলে যে, খালেদ ভারতের দালাল। তাদের উত্তেজিত করার আরেকটি অস্ত্র ছিল সেনাবাহিনীতে অফিসারের কোন দরকার নেই ‘সিপাহী ভাই ভাই’ সেøাগান। এভাবেই ৩ নবেম্বর থেকে গৃহবন্দী বলে কথিত জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করার পক্ষে সাধারণ সৈনিকদের ব্যবহার করা সম্ভব হয় (এ সময় অসংখ্য অফিসারকে জিয়ার অনুগতরা হত্যা করে)। জাসদের ভাষ্য অনুসারে তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য জিয়াকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু জিয়া তাদের সঙ্গে সম্পাদিত ১২ দফা চুক্তির কথা অস্বীকার করে বেইমানি করেছে। জাসদ কথিত বিপ্লবের যে ব্যাখা ’৭৫ সালে দিয়েছে সেখানেই এখনও অবস্থান করছে।
জিয়ানুসারীরা তাকে দুধেধোয়া প্রমাণের চেষ্টায় বিগত বছরগুলোতে গোয়েবলসীয় প্রচারণায় ক্লান্ত হয়নি। আমার দেশ ও দিনকাল ছাড়াও আরও অনেকে কৌশলে তা সমানে চালাচ্ছে। এ কৌশলটা মন্দ নয়। কিন্তু এসব করেও তাকে দুধেধোয়া বানাবার হাজার চেষ্টার মাঝেও যেসব ঘটনা এড়ানো যাবে না তা হচ্ছে- ক. ১৩ আগস্ট ’৭৫ পূর্ব সপ্তাহে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে জিয়ার দু’বার সাক্ষাত। খ. ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে জিয়া খুনী ডালিমকে বলেছিলেন, ‘ণড়ঁ যধাব ফড়হব ধ ড়িহফবৎভঁষ লড়ন, শরংং সব, পড়সব ঃড় সু পধৎ.’ গ. ১৫ আগস্ট দুপুরে জিয়াকে বঙ্গভবনে দেখা গেছে মোশতাকের সঙ্গে পরামর্শ এবং মন্ত্রিসভার সদস্য তালিকা প্রণয়নে স্বঘোষিত খুনীদের সাহায্য করতে। ঘ. ২৪ আগস্ট ’৭৫ খুনী মোশতাক তাকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন। ঙ. ১৫ আগস্ট থেকে ২ নবেম্বর পর্যন্ত খুনী ফারুক-রশিদ গংয়ের নির্দেশে খুনী মোশতাক রাষ্ট্রপতির অভিনয় করেছেন আর ক্যান্টনমেন্টেও তাদের নির্দেশ মতো জিয়া চলেছেন। চ. জেলহত্যার জন্য জিয়া-ফারুক-রশিদকে নির্দেশ দেন এবং তারা মোশতাককে ঢাকা জেলে ফোন করতে বাধ্য করে। উল্লেখ্য, খুনী মোশতাকের সঙ্গে এই লেখকের ৯.১.৯০ তারিখে পুরান ঢাকার এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন ১৫ আগস্ট ঘটনা জিয়াই ঘটিয়ে তার সুবিধার জন্য গান পয়েন্ট হিসেবে তাকে ব্যবহার করেছে। জিয়া কখনও বন্দী ছিল না। তার বঙ্গভবন নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত ছিল (তবে দুর্ভাগ্য কেউ কখনও এ বিষয়ে তার কোন সাক্ষাতকার গ্রহণ করেনি বা সে কোন আত্মজীবনীও লিখেছে কিনা জানা যায়নি)। ছ. জেনারেল জিয়া ১৯৭৬ সালের ৮ জুন বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকারী ১২ জনকে কূটনৈতিক মিশনের চাকরিতে নিয়োগ করেন। জ. ব্যাঙ্ককে এক সাক্ষাতকারে এবং ১৯৭৬ সালের ২ আগস্ট লন্ডন টেলিভিশনে এ্যান্থনি মাসকারেনহাস কর্তৃক গৃহীত খুনী ফারুক-রশিদের সচিত্র সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়। এতে তারা বলেছেন, ‘১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করে তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার অভিপ্রায় জানালে জিয়া বলেন, তোমরা জুনিয়র অফিসাররা আগ্রহী হলে এগিয়ে যেতে পার।’ জিয়া সে সময় এবং পরবর্তী ৫ বছর বেঁচে ছিলেন; কিন্তু এর প্রতিবাদ করেননি।
এসব নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু একটা প্রশ্নের মীমাংসা বোধ হয় আজও হয়নি। সেটি হচ্ছে ২ থেকে ৭ নবেম্বর ’৭৫ পর্যন্ত জিয়া কি আদৌ বন্দী ছিলেন? ফারুক-রশিদ কিন্তু তখনও বঙ্গভবন তথা ক্যান্টনমেন্টের হর্তাকর্তা। তাদের পালাতে সুযোগ দেয়া হয় ৬ নবেম্বর ’৭৫। ১৫ আগস্ট ও ৭ নবেম্বর সম্পর্কে ’৮৩ সালে রশিদ-ফারুক স্যাটারডে পোস্ট পত্রিকায় যে সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন তাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়টির বিবরণ নিম্নরূপ :
‘প্রথম কথা হচ্ছে জিয়া তার সৃষ্ট স্টাইলে নিজের বাসভবনে আটক ছিলেন। দ্বিতীয়ত, তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ও পদাতিক বাহিনীর একটি কোম্পানির প্রহরাধীন ছিলেন। সেখানে তার ব্যক্তিগত স্টাফ অফিসাররাও ছিলেন। বিদ্রোহ দমনের জন্য তিনি কোন চেষ্টা করেননি। বরং প্রেসিডেন্ট কর্তৃক বিদ্রোহ (খালেদ মোশারফদের) দমনের নির্দেশ পালনে অস্বীকার করেন। তার বাসভবনের টেলিফোন বরাবরই সম্পূর্ণরূপে কাজ করছিল। তার স্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন যে, তিনি গ্রেফতার কিংবা আটকাবস্থায় নেই। তার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চাইলে তার স্ত্রী জানান যে, তিনি কতিপয় সামরিক অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন। চীফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে জিয়া সর্বদাই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জনগণ ও সৈনিকদের ধোঁকা দিয়েছেন।’ (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান- লে. ক. এম এ হামিদ)।
১৫ আগস্ট পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে সেনা অফিসাররা পত্রিকায় অসংখ্য প্রবন্ধ এবং একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এসব বক্তব্য যদিও একজনের বক্তব্যের সঙ্গে আরেকজনের বক্তব্যের কিঞ্চিত হেরফের এবং এরা সবাই নিজেদের ব্যর্থতার বিপরীতে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাবার চেষ্টা করলেও আসল ঘটনা জানা সম্ভব হয়নি। তবে ব্রিগেডিয়ার (অব) সাখাওয়াত হোসেন, পিএসসি, এনডিসি-(পরবর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশনার) এর ‘বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায় (৭৫-৮৯)’ গ্রন্থের ১৫৫ নম্বর পৃষ্ঠায় একটি ব্যতিক্রমী তথ্য রয়েছে। এটি হচ্ছে ’৭৫ থেকে ১৯৮১-এর প্রায় সব অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী অফিসারগণ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কোন না কোন পর্যায়ে পাকিস্তান হতে পালিয়ে যুদ্ধে যোগদান করেছেন। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াতের এ তথ্য মোটামুটি সঠিক। তবে যে ৩১ জন অফিসার পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তারা কি পালিয়ে এসেছিলেন? না তাদের পাক সরকার ছুটি দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধার লেবাস লাগাতে? সে প্রসঙ্গে বরং তাদের যে ছুটি দেয়া হয়েছিল সেটিই স্পষ্ট হয়। মেজর এএসএম সামসুল আরেফীনের ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান’ (ইউপিএল-১৯৯৫) গ্রন্থের ১৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে যে, ক্যাপ্টেন খোন্দকার আবদুর রশিদ পাকিস্তান থেকে অক্টোবর ’৭১ ছুটিতে এসে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন। ফারুক বাংলা লিখতে পড়তে এমনকি বলতে পারে না এবং যার লেখাপড়া সবকিছু পাকিস্তানে (বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ৮/১১/৯৮) তার কি ঠেকা পড়ল মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার? এরা যে পাকিস্তানী গুপ্তচর ছিল তার বড় প্রমাণ ১৫ আগস্টের খুনীর তালিকায় তাদের নাম। ৩-৭ নবেম্বর ঘটনায় জিয়ার পক্ষে পাকিস্তান থেকে ছুটি নিয়ে কথিত মুক্তিযোদ্ধা আর খালেদার পক্ষে প্রথম প্রহর থেকেই মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া প্রত্যাগত অফিসার ছিলেন যাদের মধ্যে কর্নেল মালেক অন্যতম। তবে ২ নবেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে যা ঘটেছিল তাতে অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহ কোনটাই বলা যায় না। বলা হয় খুনীদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিতে জিয়ার অস্বীকৃতি তাই জিয়ার বদলে নিজে সেনাপ্রধান হয়ে চেন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে খালেদ মোশারফ জিয়াকে আটক রাখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মেজর হাফিজকে। মেজর হাফিজ জিয়াকে যে আটক বা বন্দী করেননি তার বড় প্রমাণ জিয়ার অনুগত সৈনিকরাই তার বাড়িতে পাহারায় ছিল এবং জিয়া স্বয়ং কর্নেল তাহেরের সঙ্গে ফোনে কথা বলে সাহায্য চেয়েছিলেন। এটা যে সাজানো খেলা তা বুঝতে কষ্ট হয় না, কেননা সে সময় মেজর হাফিজ ছিলেন খালেদের (জিয়া কিন্তু এ জন্য তাকে কোন শাস্তি দেননি) আর এখন ‘শহীদ জিয়া’র লোক। এভাবে জিয়া ৩-৬ নবেম্বরের ঘটনাবলী থেকে নিজেকে দূরে রাখার নাটকে সফলতার পথে আর একধাপ এগিয়ে গেলেন এভাবে : ক. খুনী মোশতাককে সরাতে পারলেন। খ. খুনীদের দেশত্যাগ। গ. জেলে জাতীয় ৪ নেতা হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্বে সঙ্কট সৃষ্টি। উল্লেখ্য, ২ নবেম্বর শেষ রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৭, ২০, ২২ আগস্ট ’৭৫ থেকে আটক মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী জাতীয় ৪ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান এদের খুনী রশিদ-ফারুক কর্তৃক ঘাতক সৈনিক প্রেরণ করে হত্যা করা হয়। ওই সময় তোফায়েল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক এরা ময়মনসিংহ জেলে আটক থাকায় ঘাতকরা তাদের খুঁজে পায়নি; প্রাণে বেঁচে যান তারা।
বস্তুত ৩-৭ নবেম্বর ’৭৫ ছিল সৈনিকদের ক্ষমতার লড়াই। সে যুদ্ধে খালেদরা পরাজিত। জিয়া বিজয়ী। এতে জনতার নামটা ব্যবহার অপরাধ বৈকি। সে দিনের ধারণকৃত রাজপথের ছবিতে যাদের দেখা যায় তাদের চেহারাই বলে দেয় অধিকাংশই ছিল ’৭১-এর পরাজিত শত্রু। জাতীয় চার নেতা হত্যার পরে লালবাগ থানায় ৪ নবেম্বর ’৭৫ একটি মামলা দায়ের এবং ৬ নবেম্বর ’৭৫ বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি কে এম সোবহান ও বিচারপতি মোহম্মদ হোসেন সমন্বয়ে গঠিত ৩ সদস্যবিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেন জেনারেল জিয়া। জেলহত্যা বিচার ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার আমলে শুরু করলেও (নবেম্বর/১২) তা এখন বিচারের ফাঁদে আপীল বিভাগ অভিমুখে। (বিস্তারিত দেখুন জনকণ্ঠ ০১.১১.২০১২)। তাই চূড়ান্ত বিশ্লেষণে ৩-৭ নবেম্বর ’৭৫ জাতীয় ৪ নেতাকে জেলখানায় হত্যা, জেনারেল জিয়ার ক্ষমতারোহন, সৈনিকহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশ, একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতকদের পুনর্বাসন ও জাতীয় ঐক্য বিভাজনের কলঙ্কময় দিন হিসেবেই চিহ্নিত।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: