ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২ নভেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

কৈশোর থেকে উত্তরণ (১ নবেম্বরের পর) গণভোটের ফলাফল ১৪ জুলাই ঘোষিত হয়। তাতে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট পড়ে ৩ লাখ ১১ হাজার ৭০৭ এবং ভারতের পক্ষে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৮০৮টি। এর পরেই শুরু হয় কলকাতায় এবং লাহোরে দু’টি স্বতন্ত্র সীমানা কমিশনের বৈঠক। সীমানা কমিশনের বৈঠক ২৬ জুলাই থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় কমিশন সদস্য এবং ভারতীয় বিভিন্ন দলের কৌঁসুলিদের মধ্যে। এর পর কিছু উন্মুক্ত শুনানিও গ্রহণ করা হয়। সিলেটের জন্য শুনানি হয় ৪ থেকে ৬ আগস্ট। এই শুনানিতে বিভিন্ন দলের মনোনীত কৌঁসুলি ছাড়া আরও নানা সূত্রে কৌঁসুলিরা হাজির হন এবং পূর্ববাংলা ও আমাদের সিলেটের পক্ষে সেই ভূমিকা পালন করেন। আমার আব্বা একজন কৌঁসুলি হিসেবে এই কমিশনে সাক্ষ্য দেন এবং সওয়াল জওয়াবে অংশ নেন। তিনি সিলেটের জন্য প্রয়োজনীয় সমুদয় মানচিত্র, ভৌগোলিক তথ্য এবং ঐতিহাসিক দলিলপত্র আমাদের নির্বাচিত কৌঁসুলি সর্বজনাব মোহাম্মদ ওয়াসিম, ফজলুর রহমান ও হামিদুল হক চৌধুরীকে প্রদান করেন। পূর্ববাংলার সীমানা নির্ধারণের জন্য মুসলিম লীগ যে কৌঁসুলি দল নির্ধারণ করে দেয় তার নেতা ছিলেন মোঃ ওয়াসিম, বার-এট-ল’ এবং তার সহকারী ছিলেন ফজলুর রহমান ও হামিদুল হক চৌধুরী। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন অন্য কৌঁসুলিরা যারা স্থানীয় উদ্যোগে অথবা নিজের ইচ্ছায় এই ভূমিকা পালন করেন। বিখ্যাত আইনবিদ এ কে ফজলুল হক নিজের উদ্যোগেই কমিশনে হাজির হন এবং পাকিস্তানের পক্ষে লম্বা বক্তব্য রাখেন। সীমান্ত নির্ধারণ কমিশনের সভাপতি ছিলেন স্যার সিরিল রেডক্লিফ। তিনি একজন নামকরা আইনজীবী ছিলেন; কিন্তু ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তার কোন ধারণাই ছিল না। কলকাতা সীমানা কমিশনের অন্যান্য সদস্য হন মুসলিম লীগ অনুমোদিত হাইকোর্ট জজ বিচারপতি এ এস এম আকরাম এবং কংগ্রেস মনোনীত বিচারপতি চারু চন্দ্র বিশ্বাস। ভারতীয় সদস্যরা তাদের অভিমত স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করার অধিকার পান; কিন্তু মূল রায়টি কমিশনের সভাপতি নিজেই প্রদান করবেন বলে নিয়ম হয়। এজন্য সন্দেহ করা হয় যে, এই কমিশনের রায় লর্ড মাউন্টব্যাটেন বিশেষভাবে প্রভাবিত করেন। ১৮ আগস্ট রেডক্লিফ কমিশনের রায় বের হলো এবং তাতে দেখা গেল যে, সিলেট জেলার আড়াইটি থানা আসামের সঙ্গে যুক্ত হলো; কিন্তু সিলেট জেলার সঙ্গে নিকটস্থ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার কোনটাই যুক্ত হলো না। অথচ ঘোষণা করা হয় যে, কমিশন সিলেট এবং তার নিকটস্থ এলাকার কোথায় দু’দেশের সীমানা নির্ধারিত হবে সেটি ঠিক করে দেবে। জনশ্রুতিতে প্রকাশ পেল যে, ত্রিপুরা রাজ্য যাতে সরাসরি ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে সেজন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন বিশেষ আবেদন করেন। তখন জনশ্রুতি ছিল যে, ত্রিপুরার মহারাজা পাকিস্তানে যোগ দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন। কারণ ত্রিপুরা তখন পুরোপুরিভাবে পাকিস্তানের নিকটস্থ এলাকা যথাÑ ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী জেলার ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিল। কুমিল্লা শহরে ছিল ত্রিপুরার মহারাজার কাছারি যেটা এখনও কোর্টবাড়ি বলে প্রসিদ্ধ। রেডক্লিফ রোয়েদাদের এক বা দু’দিন আগে ছিল সারা ভারতবর্ষে ঈদের দিন। তাই বলা যায় যে, লর্ড মাউন্টব্যাটেন এবং স্যার সিরিল রেডক্লিফ এই ঈদটি যাতে মাটি না হয় সেজন্য রোয়েদাদ ঘোষণা কিছুটা বিলম্বিত করেন। ১৪ আগস্ট ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। ভারতের স্বাধীনতা দিবসের একদিন আগে এই দিনটি নির্ধারণ করা হয়। কারণ কংগ্রেসের মনোনীত স্বাধীন ভারতের প্রথম গবর্নর জেনারেল হন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তিনি একই সঙ্গে দিল্লী এবং করাচিতে উপস্থিত থাকতে পারবেন না বলে ১৪ তারিখ করাচিতে পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে শপথ গ্রহণ করান এবং পরের দিন তিনি দিল্লীতে স্বাধীন ভারতের গবর্নর জেনারেল হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের সূচনালগ্নে তিনজন বিখ্যাত সর্বভারতীয় বাঙালী মুসলিম নেতা অবহেলিত হলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিপত্তিশালী ও দেশপ্রেমিক নেতা ছিলেন তদানীন্তন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন প্রায় আশি বছর বয়সে ছুঁই ছুঁই নেতা এক সময়ে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক আর তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন আসামের মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ্্র ইন্ডিপেনডেন্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আবদুল মতিন চৌধুরী। সোহরাওয়ার্দীর নির্বাচনী পালে পার পাওয়া সাদাসিধে রাজনীতিবিদ খাজা নাজিমউদ্দিন জিন্নাহ্্র আশীর্বাদে হলেন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আর সোহরাওয়ার্দী কিছুদিন ব্যস্ত রইলেন গান্ধীর সঙ্গে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রশমন ও শান্তি মিশনে নিবেদিত মুসলিম নেতা হিসেবে। অতঃপর তিনি ১৯৪৮ সালের মধ্যভাগে যখন পূর্ব বাংলায় আসতে গেলেন তখন নাজিমউদ্দিন সরকার তাকে কয়েক ঘণ্টার নোটিসে পূর্ববাংলা থেকে বহিষ্কার করল। এই নাজিমউদ্দিনের কিন্তু ১৯৪৫ সালের নির্বাচনে পার পাওয়ার কোন উপায় ছিল না এবং সোহরাওয়ার্দী দুটি আসনে নির্বাচিত হয়ে তার একটি আসন ছেড়ে দিয়ে নাজিমউদ্দিনকে পার করে দেন। নাজিমউদ্দিনের প্রতিদান ছিল ভারি নোংরা এবং নীচুমনা। অবশেষে সোহরাওয়ার্দী অপরিচিত করাচিতে আশ্রয় নিয়ে তার রাজনৈতিক বলয় গড়ে তুলতে লাগলেন ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে। ওই বছর জুনের শুরুতে তিনি সুপ্রীমকার্টের ঢাকা অধিবেশনে একটি মামলায় ওকালতি করতে ঢাকায় এলে অসন্তুষ্ট ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। তিনি তাদের বিরোধী দল গঠনে উৎসাহিত করেন। তিনি নিজেও করাচিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অসন্তুষ্ট মুসলিম লীগ জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ‘জিন্নাহ্্ আওয়ামী লীগ’ গঠনে মনোনিবেশ করেন। পূর্ববাংলায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ একটি বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাতে জনাব সোহরাওয়ার্দী পরোক্ষ নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তাকে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দল বিতর্কিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করার চেষ্টা করে। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর কৌশলে সেই অপতৎপরতার অবসান হয়। ১৯৫৩ সালের শেষলগ্ন থেকে তিনি পূর্ববাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে অত্যন্ত দক্ষ সংগঠক ও নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সব ঝগড়াঝাটি মিটিয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট রেখে রাতদিন ওয়াইজঘাটের নির্বাচনী দফতরে অবস্থান নিয়ে তিনি অত্যন্ত সফলভাবে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন পরিচালনা করে বিজয় অর্জন করেন। চলবে...
×