ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নুরুল করিম নাসিম

আমাদের কবিতা তাহাদের কবিতা

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৩০ অক্টোবর ২০১৫

আমাদের কবিতা তাহাদের কবিতা

চেন্নাই আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনের প্রাণপুরুষ, ‘কাফেলা’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠক দেব ভরদ্বাজ অনুষ্ঠানের আগের দিন বিকালে আমার হোটেলে এসে হাজির। আমি তো অবাক। কয়েক ঘণ্টা আগেই তো দেখা হলো। সঙ্গে আসামের মেয়ে সঙ্গীতে পিএইচডি পারমিতা। কন্যাতুল্য এই মেয়েটি বাংলা জানেন, বেশ লাবণ্যময়ী ও প্রাণবন্ত, কিন্তু হিন্দী ও ইংরেজীতে কথা বলতে বেশি ভালবাসেন। বেশ চটপটে, পরদিন অনুষ্ঠানে সে হিন্দী ও ইংরেজীতে সমস্ত অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ও পরিচালনা করল। উপস্থাপনা যে একটি সৃজনশীল শিল্প তা পারমিতার পারফরমেন্সে মূর্ত হয়ে উঠল সবার কাছে। দেব ভরদ্বাজ দুপুরে আমাকে নেল্লোরে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গ্রহণ করলেন। আমি ঢাকা থেকে সরাসরি মালদ্বীপ বিমানে এসেছি। দুপুর ১টায় ঢাকা ত্যাগ করে বিকাল ৪টায় চেন্নাই বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। তারপর দু’ঘণ্টা ট্যাক্সিতে। দেবের সঙ্গে এর মাঝে বেশ কয়েকবার সেলফোনে কথা হয়েছে। যা হোক, নেল্লোর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রইলাম। মিনিট দশেকের মাঝে তিনি গাড়ি নিয়ে হাজির। দীর্ঘকায় পুরুষ, পাঞ্জাবের মানুষ, ইংরেজী এবং হিন্দীতে শুভেচ্ছা বিনিময় করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। দেশ, জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম- কোন কিছুই মানব সম্পর্ক স্থাপনে বাধা হয়ে দাঁড়াল না। আমরা অল্প সময়ে উভয়ে উভয়কে আপন করে নিলাম। কথা ছিল কোন এক বাসায় তিনি আমাকে রাখার ব্যবস্থা করবেন, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন, দুঃখ প্রকাশ করলেন আন্তরিকভাবে। ঢাকায় তার বন্ধু প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান আমাকে আগেই বলেছিলেন সামান্য একটি হ্যান্ডিক্র্যাফট ও তার প্রিয় পানীয় বিমানবন্দরের ডিউটি ফ্রি শপ থেকে কিনে নিতে। তার নির্দেশ মতো তা করেছিলাম।এর বিনিময়ে ভরদ্বাজের ভিতর যে আনন্দ ও উচ্ছলতা দেখলাম তা অবিস্মরণীয়, তা ভুলবার নয়। এর আগে আমি ভরদ্বাজকে কোন দিন দেখিনি। ২০১২ সালে প্রফেসর মুস্তাফিজের সঙ্গে চেন্নাই আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনে যাওয়ার কথা ছিল। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন তখন ছুটি পাওয়া কঠিন, আমি পাইনি। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়া, ভিসা পেয়ে যাওয়ার পরেও আমি যেতে পারিনি। ছুটি পাইনি। ভরদ্বাজ হোটেলের লাউঞ্জে বসে আমার সঙ্গে ভাববিনিময় করছিলেন। খবর পেয়ে মহারাষ্ট্রের কবি ও শিক্ষক ফিলিপ মেলেপোজ তিনতলা থেকে ছুটে এলেন। আরও একজন লেখিকা এলেন, তিনি সম্ভবত ভারতের মেঘালয়ের বাসিন্দা। তারও ইংরেজীতে ৩টি কবিতার বই আছে। আর ফিলিপ মেলেপোজের আছে দুটি চমৎকার বই ইংরেজীতে, ঞঐঊ জঅওঘ ওঝ ঈঙগওঘএ, মূল মালায়লাম ভাষায় ফিলিপ লিখেছে, পরে তার সহকর্মী ইংরেজীর এক শিক্ষিকা অনুবাদ করে দিয়েছেন। অনুবাদ খুব ভালো ও ত্রুটিমুক্ত না হলেও, মোটামুটি ভালো বলা চলে। উজবেকিস্তানের তরুণ সুদর্শন কবি ও একটি পত্রিকার সম্পাদকএলেন। বেশ জমে উঠল আড্ডা। ভরদ্বাজ চা দিতে বললেন। চেন্নাইয়ের নেল্লোর এই হোটেলের জানালার বাইরে দিয়ে অচেনা আকাশ দেখলাম। পৃথিবীর সব আকাশ একই রকম, ঠিক মানুষের রক্তের মতো। অপরিবর্তনীয় ও একই রকম। অনেক কথা হলো কবিতা-প্রাণ ভরদ্বাজের সাথে। একপর্যায়ে তিনি আসন্ন কবিতা উৎসব বাংলাদেশের ঢাকায় আয়োজন করার জন্য আমাদের অনুরোধ করলেন। সর্বসাকুল্যে মোট ৫০ জন কবি ও লেখক অংশগ্রহণ করবেন। তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ভ্রমণ খরচ যার যার নিজের। আমি বললাম, ঢাকায় গিয়ে আমায় কথা বলতে হবে, ভাবতে হবে। রাইটার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডঅই)-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৭ বছর ধরে অনেক কষ্টে এই প্রতিষ্ঠানটি আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশে আমাদেরটা ছাড়াও আরও ৫টি কিংবা এর বেশিও হতে পারে, সংগঠন আছে। আমাদের প্রধানতম প্রবণতা অনুবাদের দিকে, আমরা একটা ৪ পৃষ্ঠার নিউজ লেটার বের করি ইংরেজীতে। সেখানে কবিদের কবিতা ও ছবিসহ ছাপা হয় ভরদ্বাজের আমাদের আইডিয়াটা ভালো লাগলো। তিনি তিন/চারটি দেশের প্রতিনিধিত্বমূলক কবিদের একটি ইংরেজীতে সংকলন প্রকাশ করার আগ্রহ দেখালেন। এবারেও আমি ডিপ্লোম্যাটিক নীরবতা পালন করলাম। কেননা, লেখালেখিতে দীর্ঘ ৪ দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে দেখেছি, যে কোনো সংগঠন বাঁচিয়ে রাখতে হলে ফান্ড বা টাকার উৎস থাকা চাই। টাকা একটি সংগঠনের অন্যতম চালিকাশক্তি। তারপর ভালো ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী প্রয়োজন। ভালো লেখাতো থাকতেই হবে। পত্রিকা প্রকাশ করা, বিশেষত ইংরেজীতে প্রকাশ করা চাট্টিখানি কথা নয়। বলা এক জিনিস, বাস্তবে তা রূপ দেয়া অন্য বিষয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোথাকার পানি কোথায় গড়াল। ২০১৬ সালে চেন্নাই কবিতা উৎসব ড্যাফডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিতে অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। দুই তিন বছর লেগে গেল গ্রাউন্ডওয়ার্ক করতে। আমি ২০১৩ সালে চেন্নাই থেকে ঢাকায় ফিরে এসে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছিলাম, ইংরেজী বিভাগের তদানীন্তন চেয়ারম্যান ড. বিনয় বর্মণের সাথে। বিনয়ের অবতার কবি, অধ্যাপক ও অনুবাদক বিনয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শ্রেণীবন্ধু সবার মাথার ওপর মহীরুহের মতো দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান। রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা ড. মীজানুর রহমান শেলী, ষাট দশকের গল্পকার ও ঔপন্যাসিক এবং প্রাক্তন সচিব আমাদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। ২০১৬ সালের ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাব্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে ড্যাফডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজী বিভাগ। আমার মনে হয় লেখক কবি ও অ্যাকাডেমিকদের একটা চমৎকার গেট টুগেদার হতে যাচ্ছে। আবার একটু ফিরে যাই ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের তরুণ কবি ফিলিপজের প্রসঙ্গে। ২০১৩ সালে চেন্নাইয়ের অনুষ্ঠানে আমার ৪টি কবিতা মালায়লাম ভাষায় অনুবাদ করে অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করেছিলেন। জাতিতে খ্রীস্টান, নাগরিকতা ভারতীয়, কবিতা অন্তপ্রাণ ফিলিপজের সাাথে পরদিন সকালে প্রাতঃভ্রমণে আবারও দেখা। আমরা হাঁটতে হাঁটতে কবিতা নিয়ে নিরন্তর কথা বলতে লাগলাম। আলোচনার বিষয় : আমাদের কবিতা, তাহাদের কবিতা। হঠাৎ পথে পড়ল একটি ম্রিয়মাণ গির্জা, রাস্তার মোড়ে খুব অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ফিলিপজ বলল, নাসিম আসো, আমরা প্রার্থনা করি। মনে পড়লো ১৯৮৬ সালে মাল্টা দ্বীপে বেড়াতে গিয়েছিলাম এবং সেখানে জমজমাট একটি গির্জা সেন্ট ক্যাথেড্রালে ঢুকে প্রার্থনা করেছিলাম। সেদিনও এক খ্রীস্টান বন্ধুর প্ররোচনায় গিয়েছিলাম। এখানে একই ঘটনা ঘটলো। আসলে আমি মনে করি কবির কোন জাত নেই, কোন সংস্কৃতি নেই, কবিতাই তার একমাত্র আরাধ্য, কবিতাই তার ধর্ম। চার্চের ভেতর কেউ ছিল না। অসম্ভব ধুলো জমে ছিল আর সর্বত্র অবহেলার ছাপ। আসলে আমাদের এই সময়ে ধর্মের প্রতি এই প্রজন্মের আগ্রহ অনেকটা কমে গেছে। মানুষ যে কিসের পেছনে ছুটছে, সে নিজেও জানে না। গির্জা থেকে খুব দ্রুত ফিলিপজ তার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা শেষে বেরিয়ে এলেন। সকালের ব্রেকফাস্ট হয়নি। আমরা একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে খুব তাড়াতাড়ি মাদ্রাজী খাবার খেয়ে হোটেলের দিকে এগিয়ে গেলাম। খুব তাড়াতাড়ি গোসল সেরে যেতে হবে অনুষ্ঠানে। আগেই বই-পুস্তক, সেমিনার পেপার ইত্যাদি সব গোছানো ছিল। সে বছরে বিষয়বস্তু ছিল : চঙঊঞজণ অঘউ ডঙজখউ চঊঅঈঊ, কবিতা ও বিশ্বশান্তির উপর এক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ ঢাকা থেকে লিখে এনেছিলাম। খুব চমৎকারভাবে উপস্থাপনা করেছিলাম সেদিন অপরাহ্নে। ভরদ্বাজ বসেছিল সামনের সারিতে । তিনি উঠে এসে আমাকে তার বিশাল বুকে জড়িয়ে ধরে হিন্দীতে ধন্যবাদ জানালেন। পাশে বসা পারমিতা ইংরেজীতে বললেন, দওঞ’ঝ জঊঅখখণ অ ঋঊড ওগচঙজঞঅঘঞ চঙওঘঞঝ ণঙট ঐঅঠঊ জঅওঝঊউ ঈঙঘএজঅঞ’. কবিতা, তোমার জন্যই আমার এতকিছু আয়োজন, এত শ্রম ও ঘাম ব্যয় করেছি। আমি কোনদিনই সুকান্তর মতো উচ্চারণ করতে পারবো না, ‘কবিতা, তোমায় দিলাম আজকে ছুটি।’ কেননা, অনেক অর্থকষ্টের ভেতরও আমি কবিতাকে পরিত্যাগ করিনি, কবিতাও করেনি। কবিতার সঙ্গেই আমার সারাজীবনের বসবাস।
×