ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নারগিস পারভীন সোমা

নারীর মন জুড়ে শিল্পের বাস

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৩০ অক্টোবর ২০১৫

নারীর মন জুড়ে শিল্পের বাস

নারী ও শিল্প দুটি শব্দ যেন একে অপরের পরিপূরক। নিবিড়ভাবে জড়িত এ সম্পর্ক। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটি কল্পনা করা যায় না। প্রতিটি নারী নিজেই একটি সুন্দর শিল্প। নারীর শৈল্পিক ছোঁয়ায় হয়ে ওঠে প্রতিটি জিনিস একেকটি অনবদ্য শিল্পকর্ম। নানা কাজ করতে হয় নারীকে। সংসার সামলানো, সন্তান লালন-পালন থেকে শুরু করে সব কিছুতেই মনের অগোচরে শৈল্পিক ছোঁয়া দিয়ে যায় এক একজন নারী। দেশের গ্রাম অঞ্চলে অধিকাংশ নারীই কম লেখাপড়া জানা। যদিও হালে গ্রামের নারীরাও এগিয়ে এসেছে শিক্ষা-দিক্ষা থেকে সব কাজে। সব পরিম-লেও প্রতিভার ছাপ রাখছে নারীরা। প্রতিটি নারী ঘরে বসে যা কিছু তৈরি করে তা যেন হয়ে উঠে একেকটি শিল্পকর্ম। যে শিল্পকর্ম প্রস্ফূটিত হয় তা তার অজান্তেই। ঘরে বসে যা কিছু তৈরি করা হয়, তাকে আমরা বলি হস্তশিল্প। এগুলো একজন নারী নিজের ইচ্ছেতেই ঘরে বসে করে থাকে। মানের অজান্তেই নানা রকম নকশা, আলপনা এঁকে থাকেন অনেকে। নানাভাবে ঘরের দরজা জানালা থেকে শুরু করে ঘরের সবকিছুতেই একটা ছাপ দেয়ার চেষ্টা করেন। কখনও কখনও তা হয়ে ওঠে নিপুণ শিল্পকর্ম। কখনও ঘরের এ কোনা থেকে ও কোনা পরিপাটি করে রাখাও শিল্পের মধ্যেই পড়ে। এটা সাধারণত নারীরাই করে থাকে। অনেকে আবার হাতে তুলে নেয় সুই সুতা। নিজের অজান্তে ঘরের প্রয়োজনে সেলাই করা হয় নকশি কাঁথা। হাতপাখায় নকশা কিংবা মাদুরের কোন কারুকাজ। এতে নানা রঙের সুতার ব্যবহারে রঙিন হয়ে ওঠে। যখন কোন গৃহিণী শখের বসে এসব করে ঘরে বসে, তখন কিছু মনে না হলেও কাজ শেষে হয়ে উঠে একেকটি রঙিন শিল্পকর্ম। যেন প্রতিটি সুতার ফোঁড়ে তৈরি হয় তাদের জীবনগাঁথা। কাথার ওপর যখন সুই সুতার ফোড়নে বাহারি সুতার কাজ হয় তখন বলে থাকি নকশি কাঁথা। নকশি কাঁথার প্রতিটি সুতার ফোড়ে ভেসে ওঠে এক একটি নারীর জীবন গাঁথা। কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে কল্পনার রং। মনের অজান্তে একের পর এক স্বপ্ন বুনে চলেন ঘরের কোনে বসে। এসব নারী যদি একটু হাতে কলমে শিক্ষা পায় তাহলে হয়ত পাল্টে যেতে পারে জীবনের পথচলা। প্রতিটি নকশি কাঁথার ফোঁড়নে রূপরেখা ফুটে ওঠে প্রতিটি নারীর ভেতরেই লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভা। শুধু প্রয়োজন তা বিকাশের কোন মাধ্যম। আমরা অনেকেই পারি এ প্রতিভার মাধ্যম হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়াতে। জীবন সংগ্রামে প্রতিটি নারীই প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে একটু ভাল থাকার আশায়। তাদের শিল্পকর্মগুলো বয়ে বেড়ায় সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে। দেশের প্রতিটি নারী সত্তায় তাদের সংসার থেকে শুরু করে কর্মস্থল পর্যন্ত শৈল্পিক ছোঁয়া এঁকে যায়। সংসার জীবনে যখন রান্না ঘরের সব কাজ করে, যেমন- বিভিন্ন রকম রান্না তৈরি, তখন রান্নাটাও শিল্পের মধ্যে পড়ে। আমরা অনেকেই জানি না রন্ধনশিল্প অন্য শিল্পের মতোই। যে রাঁধুনী রান্না করে শৈল্পিক ছোঁয়া দিয়ে, তা আমরা আস্বাদন করি। রঙ তুলি কিংবা সুই সুতার মধ্যেই শিল্পীর মনের ভাব যেমন প্রকাশ পায়, তেমননি মনের মাধুরী জড়ানো প্রতিটি কাজেও থাকে শৈল্পিক ভাব। অনেকেরই ধারণা রং তুলি যাদের হাতে, যারা রং তুলির আঁচড়ে সাদা ক্যানভাসকে করে তোলে মনের পটভূমি। শুধু তারা শিল্পী নন। আমরা যখন নিজের ভেতরের শিল্পবোধের সঙ্গে পরিচিত হবো তখন হয়ত- এই শিল্প নিয়ে আমাদের ধ্যান-ধারণা পাল্টে দিতে পারব। তখন প্রতিটি নারীই হয়ে উঠবে এক একজন শিল্পী। ঘরে ঘরে অনেক শিল্পী আছে, যাদের খোঁজ আমরা রাখি না। যেমন ধরুন- তালপাতার পাখাতে কাপড় দিয়ে ডিজাইন করে তার ওপর নানা বাহারি সুতা দিয়ে আঁকা আলপনাটিও তো একটি শিল্পকর্ম। নানা কথামালাও লেখা হয় এসব হাতপাখায়। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভুল না আমায়, চিরদিন তুমি যে আমার’ ইত্যাদি হাজার কথামালা সাজিয়ে রাখা হয় ঘরের দেয়ালে কিংবা উপহার হিসেবে দেয়া হয় এসব পাখা। আবার বালিশের কভারে বিভিন্ন রকম সুতা দিয়ে ডিজাইন করে সাজিয়ে তোলা হয় নিপুণভাবে। যার কোন প্রাথমিক শিক্ষা নেই। তারপরও নিজের ইচ্ছেতে এসব করে থাকেন। শুধু শিল্পসত্তা মন দিয়ে। দেশের নারীরা এমনিতেই অনেক বেশি শিল্পরস ধারণ করে তাদের অন্তরে। অথচ তারা নিজেরাও জানে না তারা কতটা সাবলম্বী হতে পারে এসব শিল্পকর্মে। শিল্পবোধ ও চেতনাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সমাজের। তাহলে অর্থনৈতিক মুক্তি যেমন আসবে, সহজেই তেমন প্রসার ঘটবে নারী শিল্প সত্তার। আর ঘরের যে নারীকে বোঝা মনে করেন অনেকে, অনেক ক্ষেত্রে সেই নারীই হয়ে উঠতে পারে পরিবারের আয়ের উৎস। এ ক্ষেত্রে অধিকার রক্ষা এবং সমাজে নারীর অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন খুবই দরকার।
×