ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মওলানা আবু জাফর সিদ্দীকী (রা.)

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৩০ অক্টোবর ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মওলানা আবু জাফর সিদ্দীকী (রা.)

২৯ অক্টোবর ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে যামান মওলানা আবূ বকর সিদ্দীকী রহমাতুল্লাহি আলায়হির মেজো সাহেবজাদা মুফতী মাওলানা আবু জাফর ওয়াজীহুদ্দীন মুস্তাফী সিদ্দীকী রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হির ওফাত বার্ষিকী। তিনি ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ অক্টোবর মঙ্গলবার ফুরফুরা শরীফে নিজ হুয্রায় প্রায় ৯৭ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। তিনি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আলিম পীরে কামিল জনপ্রিয় বক্তা, বহু গ্রন্থ প্রণেতা, কবি। ফারসী ভাষায় তাঁর কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। পশ্চিম বাংলার হুগলী জেলার জাঙ্গনপাড়া থানার ঐতিহ্যবাহী ফুরফুরা শরীফে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি মুতাবিক বাংলা ২২ পৌষ শুক্রবার ১৩১২ সনে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মেধার ও প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। পিতা মুজাদ্দিদে যামানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তাঁর ইল্ম হাসিলের সূচনা হয়। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে তিনি উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি পিতার একান্ত সান্নিধ্যে থেকে ইলমে তাসাওউফের সমস্ত তরীকার তা’লীম গ্রহণ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ণ কামালিয়া হাসিল করেন এবং কাদিরীয়া, চিশ্তীয়া, নক্শবন্দী, মুজাদ্দিদীয়ায়ে আলীয়া এবং মুহম্মদীয়া তরীকাসমূহের খিলাফত লাভ করেন। তিনি পিতার সফরসঙ্গী হয়ে দিল্লী, আজমীর, সারহিন্দসহ হিন্দুস্তানের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। এই সফরকালে তিনি সারহিন্দ শরীফে অনুষ্ঠিত এক ওয়াজ মহফিলে পিতা মুজাদ্দিদে যামানের নির্দেশে এক ঘণ্টা স্থায়ী সময় ধরে উর্দু ভাষায় ওয়াজ করে সবাইকে রীতিমতো তাক্ লাগিয়ে দেন এবং মুহুর্মুহু আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে যায় সারহিন্দ শরীফের আকাশ-বাতাস। মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি হজ্জ পালন করেন। এই উক্তির মধ্যেই লুকিয়ে আছে পীর আবু জাফর সিদ্দীকী (রহ.)-এর ইল্ম জ্ঞানের বিরাটত্ব ও মহত্ত্ব। তিনি তদানীন্তন নিখিল বাংলা আসামের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ওয়াজ মহফিল ও মাদ্রাসা কায়েম করে এক বৈপ্লবিক অবদান রাখেন। তিনি কপটতা, ভ-ামি এবং প্রতারণার মুখোশ উন্মোচন করে ওয়াজ-নসিহত করতেন। এক ওয়াজে তিনি বলেন : আজকাল চালে ভেজাল, ডালে ভেজাল, দুধে ভেজাল, চিনিতে ভেজাল তেমনি আলিমে ভেজাল, পীরে ভেজাল, নেতাতে ভেজাল, চারদিকে ভেজাল আর ভেজাল। এই ভেজালের হাত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে হবে। তিনি ওসীয়ত ও নসীহত গ্রন্থে বলেন : কুরআন, ইজ্মা-কিয়াস অনুযায়ী যাহা মুজতাহিদ ও ফিকহতত্ত্ববিদগণ লিখিয়া গিয়াছেন সেই মতো আমল করিবেন। যেমন জাহিরী ইল্ম শিক্ষা করা ফরয, তদ্রƒপ বাতিনী ইলম শিক্ষা করাও ফরয জানিবেন। বদ-আমল আলিম ও বিদ’আতী, বেশরা পীর ফকীর হইতে সতর্ক থাকিবেন। আমলকারী আলিম পীরগণের সঙ্গ লাভ করিবেন এবং তাঁহাদের অনুসরণ করিবেন। ইসলামের নামে যারা রাজনীতি করে, যারা দীনের অপব্যাখ্যা দেয়, যারা মানুষকে সংসারবিমুখ করার মধ্য দিয়ে আল্লাহ্র রাস্তায় মেহনতের নামে পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিষ্ক্রিয় জীবন পথে ধাবমান করে তিনি তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তিনি বলতেন : ইসলামের পথে মানুষকে আহ্বান করবেন অভিজ্ঞ ও বিদ্বান ব্যক্তি। ইসলাম প্রচারিত হয়েছে এবং ইসলামের সম্প্রসারণ ঘটেছে আলিম-ওলামা এবং পীর আওলিয়া কেরামের মাধ্যমে। তিনি হাত তুলে মুনাজাত করা, মিলাদ মহফিল আয়োজন করা, মিলাদে কিয়াম করা জায়েজ বলেছেন। তিনি বলেন : মিলাদের শেষে কিয়াম করলে সওয়াব হবে। তাঁর রচিত পুস্তক-পুস্তিকার সংখ্যা প্রায় ৬৫ খানা। সেই সব বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : তা’লীমে তরীকত, ফতওয়ায়ে সিদ্দীকীয়া, ফুরফুরা শরীফের পর কিবলা (রহ)-এর জীবন চরিত, তেত্রিশ আয়াতের ফযীলত, নসীহাতুন্নবী (আটশ সহীহ হাদীস সঙ্কলন), ধূমপান নিষেধ ও ধূমপানের অপকারিতা, কামিল পীরের আলামত, আখেরী যুহর নামাজ পড়িতে হয় কেন? ওয়াহাবী পরিচয় ও চার ইমামের তাকলীদ ওয়াযীফা শিক্ষা, হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর জীবনী, স্বপ্নের মর্ম, রদ্দে বিদ্’আত, তাহ্কীকুল মাসাবেল, উত্তম বিদ’আত, ওয়াইয়ে তরীকত, মিলাদে কিয়াম, ওলী ও শহীদগণের মাযার যিয়ারতের ফযীলত প্রভৃতি। বর্তমান লেখকের পিতা মুজাদ্দিদে যামান আবু বকর সিদ্দীকী অন্যতম প্রধান খলীফা মেজো হুযুর সম্পর্কে বলেছেন : মেজো হুযুর আবু জাফর সিদ্দীকী ছিলেন ফুরফুরা শরীফে প্রতিষ্ঠিত দারুল ইফ্তার প্রধান মুফ্তী। তিনি যে সমস্ত ফতওয়া দিতেন তা খ-ন করার মতো যুক্তি দেখাতে সবাই ব্যর্থ হতেন। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর বর্তমান লেখকের পিতা বর্তমান লেখককে ফুরফুরা শরীফে নিয়ে যান। তাঁকে দেখে মেজো হুযুর কিবলা বলেন : ভাই ৩৩ বছর পর আপনি ফুরফুরা শরীফ এলেন। ঐদিনই আসর সালাতের পর মেজো হুযুরের হাত দিয়ে বর্তমান লেখককে তাঁর কায়েম মকাম বা গদীনশীন নিযুক্ত করেন। জনাব মেজো হুযুর কিবলার জানাযায় প্রায় ৮ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটেছিলো। তিনি ছিলেন সত্যিকার কামিল পীর। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×