ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বৌদ্ধ ভাস্কর্য প্রদর্শনী জাদুঘরে

তান্ত্রিক প্রভাবে বিরল আকৃতি, প্রাচীন সমাজ সংস্কৃতির বোধ

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৯ অক্টোবর ২০১৫

তান্ত্রিক প্রভাবে বিরল আকৃতি, প্রাচীন সমাজ সংস্কৃতির বোধ

মোরসালিন মিজান ॥ একজন-ই ছিলেন গৌতম বুদ্ধ। তবে নানা রূপে তাঁকে কল্পনা করা হয়েছে। তান্ত্রিক বুদ্ধিজমের প্রভাবে বিচিত্র গড়ন, আকার, আকৃতি পেয়েছেন এই ধর্মগুরু। দীর্ঘ সাধনায় পাওয়া রূপ নানা মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন ভক্তরা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গড়া হলেও এগুলো ধারণ করে আছে বঙ্গদেশের ভাস্কর্যশিল্পের সমৃদ্ধ ইতিহাস। আর সে ইতিহাসের কথাই এখন হচ্ছে জাতীয় জাদুঘরে। গ্যালারিতে নিয়মিত দেখানোর পাশাপাশি প্রধান মিলনায়তনের লবিতে আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ প্রদর্শনীর। বুধবার সকালে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এখন কৌতূহল নিয়ে প্রদর্শনী দেখছেন দর্শনার্থীরা। অনেকেই জানেন না, জাতীয় জাদুঘরে রয়েছে বৌদ্ধ ভাস্কর্যের বিশাল সংগ্রহ। সংখ্যায় তা ৫০০ থেকে ৬০০’র মতো হবে। সেখান থেকে ৮৫টি ভাস্কর্য নিয়ে সাজানো হয়েছে প্রদর্শনী। লবির দেয়ালঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আকারে বড় ভাস্কর্যগুলো। ছোট ও ক্ষুদ্র ভাস্কর্য ১২টি গ্লাস শোকেসে। প্রস্থর, টেরাকোটা ও ব্রোঞ্জে তৈরি ভাস্কর্য বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত। পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শতকের ভাস্কর্য বঙ্গদেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্মবোধের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। প্রদর্শনীর কিছু ভাস্কর্যে খুব চেনা ভঙ্গিতে গৌতম বুদ্ধ। কখনও ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। কখনওবা কাত হয়ে শুয়ে। সৌম্য শান্ত চেহারা। বিস্তারিত যাওয়ার আগে একটু পেছনের কথা বলতে হবে। বঙ্গদেশ ছিল ক্ষয়িষ্ণু ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মের শেষ আশ্রয়স্থল। ষষ্ঠ শতকে হর্ষবর্ধনের পতনের পর ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা ও প্রচার প্রসার বিঘিœত হয়। উপমহাদেশের আর কোথাও যখন এই ধর্মের অস্তিত্ব ছিল না, ঠিক সে সময় প্রাচীন বাংলায় দেখা যায় উল্টোচিত্র। এ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম যেন নতুন প্রাণ পায়। মহাযানী তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব ঘটে। অষ্টম থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত পাল-চন্দ্র শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম। হিন্দুরাও এ ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকে। সে সময়কার বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য আছে প্রদর্শনীতে। এসব ভাস্কর্যের গায়ে সময়টা যেন খোদাই করা আছে। গৌতম বুদ্ধকে গড়া হয়েছে বটে, হিন্দু দেব-দেবীর প্রভাব সেখানে স্পষ্ট। বিরল ও বিচিত্র আকার-আকৃতিতে দৃশ্যমান হন গৌতম বুদ্ধ। প্রদর্শনীতে একাদশ শতাব্দীর ‘পর্ণশবরী’-কে হঠাৎ দেখে অবাক হতে হয়। কালো পাথরে গড়া ভাস্কর্যে এক দেবীর তিন মস্তক। ছয়টি হাত। উপরিভাগে আবার একাধিক ধ্যানী বুদ্ধ। পদতলেও তা-ই। ‘পর্ণশবরী’র অনুরূপ বলা চলে ‘মঞ্জুশ্রীকে’। বুদ্ধের মতো আসন পেতে বসেছেন এই দেবী। তার মস্তকের উপরে, পদতলে দৃশ্যমান হচ্ছেন চেনা অঙ্গভঙ্গির গৌতম বুদ্ধ। আনুমানিক দশম শতাব্দীর ভাস্কর্য ‘চুন্দা’। এটিও কালো পাথরে গড়া। উচ্চতা ৫৩ সেন্টিমিটার। প্রস্থ ৩১ সেন্টিমিটার। এখানে হিন্দু দেব-দেবীর প্রভাব আরও জোরালো। আসন পেতে বসা বুদ্ধের হাতের সংখ্যা গুনে শেষ করা যায় না। দ্বাদশ শতাব্দীর নিদর্শন ‘মরীচী’র হাত ৮টি। আনুমানিক একাদশ শতাব্দীর ‘খদিরবনী তারা’। এখানে দ-ায়মান বুদ্ধ। তবে দেব-দেবীদের আদলে গড়া। উচ্চতা ৯৬ সেন্টিমিটার। প্রস্থে ৫৮ সেন্টিমিটার। একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর নিদর্শন ‘অবলোকিতেশ্বর’। এটিও দ-ায়মান মূর্তি। কালো প্রস্থরখ-ে গড়া। উচ্চতায় ৫৬ সেন্টিমিটার। প্রস্থে ৩৭ সেন্টিমিটার। এটিও হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীদের আদলে গড়া। এভাবে প্রদর্শনীর ভাস্কর্যের মূল বৈশিষ্ট্য গড়ে দিয়েছে তান্ত্রিক বুদ্ধিজম। হিন্দু দেব-দেবীর প্রভাবে বিরল আর বিচিত্র রূপ লাভ করেছে বুদ্ধমূর্তি। ব্রোঞ্জের বৌদ্ধমূর্তিগুলো আকারে ছোট। বেশিরভাগই গ্লাস শোকেসে রাখা হয়েছে। ‘অক্ষোভ্য’ শিরোনামের একটি ব্রোঞ্জমূর্তি বলছে অষ্টম-নবম শতাব্দীর কথা। বগুড়া থেকে পাওয়া বুদ্ধমূর্তির উচ্চতা ৯ সেন্টিমিটার। প্রস্থ ৬ সেন্টিমিটার। এখানে চিরচেনা ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখা যায় বুদ্ধকে। বগুড়া থেকে পাওয়া ব্রোঞ্জের দ-ায়মান একটি বুদ্ধমূর্তি ক্ষয়ে যেতে যেতে কোন রকমে টিকে আছে। নবম-দশম শতাব্দীর মূর্তিটির উচ্চতা ১০.৫ সেন্টিমিটার। প্রস্থ ৩ সেন্টিমিটার। টেরাকোটার ভাস্কর্যেও দৃশ্যমান হয়েছেন গৌতম বুদ্ধ। যে মাধ্যমেই গড়া হোক না কেন, প্রতিটি মূর্তির গায়ে প্রচুর শিল্পশোষমা যোগ করা হয়েছে। শিল্পীদের সমাজ সংস্কৃতির বোধ সম্পর্কেও জানান দেয় ভাস্কর্যগুলো। পাথর কেটে যে ভাস্কর্য, সেখানেও অদ্ভুত সুন্দর অলঙ্করণ। দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করানো যায় না। সব মিলিয়ে অনবদ্য আয়োজন। চলবে ১১ নবেম্বর পর্যন্ত।
×