ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকল্প নিয়ে রশি টানাটানি

বে-টার্মিনাল নাকি স্মার্ট সিটি

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২৯ অক্টোবর ২০১৫

বে-টার্মিনাল নাকি স্মার্ট সিটি

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় সাগর পাড়ে বে-টার্মিনাল নাকি স্মার্ট সিটি হবে এ নিয়ে চলছে এক ধরনের রশি টানাটানি। বন্দর কর্তৃপক্ষের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় রয়েছে বে-টার্মিনাল, যা বাস্তবায়িত হলে অনায়াসে ভিড়তে পারবে পণ্যবাহী বড় জাহাজ। অপরদিকে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রীর পরিকল্পনায় বিশ্বের উন্নত শহরগুলোর আদলে দৃষ্টিনন্দন একটি স্মার্ট সিটি, যেখান থেকে সাগরের মনোরম দৃশ্য অবলোকন করা যাবে। এটি করা গেলে চট্টগ্রাম সত্যিকারের পর্যটন নগরীর পথে একধাপ এগিয়ে যাবে। সার্বিক বিবেচনায় কোনটি বেশি জরুরী তা নিয়ে রয়েছে পাল্টাপাল্টি। বন্দর ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর জোরালো দাবি রয়েছে পতেঙ্গায় অত্যাধুনিক বে-টার্মিনাল নির্মাণের। কারণ দেশের আমদানি-রফতানি যে হারে বাড়ছে তাতে চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান সক্ষমতা দিয়ে আর কতদিন পরিপূর্ণভাবে সেবা দেয়া সম্ভব হবে তা নিয়ে তারা বেশ শঙ্কিত। সার্বিক বিবেচনায় বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখবে কিনা সংশয় দেখা দিয়েছে ৯০৭ একর আয়তনের বিরাট এই ভূমির উপর আবাসিক এলাকা গড়ার নতুন পরিকল্পনা যুক্ত হওয়ায়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বিভিন্ন সময়ে তাঁর বক্তৃতায় সাগর পাড়ে স্মার্ট সিটি গড়ার কথা জানিয়েছেন। তাঁর পরিকল্পনায় পাহাড়-নদী-সাগর বেষ্টিত চট্টগ্রামকে একটি অপার সৌন্দর্যের নগরী হিসেবে গড়ে তোলা। তবে এক্ষেত্রে ঘোর আপত্তি রয়েছে দেশের ট্রেড বডিগুলোর। ১৮৭ বছরের প্রাচীন চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান বহির্নোঙ্গর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উজানে। প্রাকৃতিক এই বন্দরটি জোয়ার ভাটানির্ভর। ফলে আসা যাওয়ার জন্য জাহাজগুলোকে থাকতে হয় জোয়ারের অপেক্ষায়। নদী পথে দুটি বাঁক থাকায় জাহাজ চলাচলে ঝুঁকিও রয়েছে। রাতে জাহাজ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় নাইট নেভিগেশন বন্ধ। সব মিলিয়ে জাহাজ আসা যাওয়ার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সময় পাওয়া যায় সর্বোচ্চ চার ঘণ্টা। তাছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষও মনে করছে, বর্তমান সক্ষমতা দিয়ে দেশের আমদানি-রফতানিকে আর বেশিদিন সার্ভিস দেয়া সম্ভব হবে না। দেশের চাহিদার প্রেক্ষিতে আগামী ২০১৯ সালে সক্ষমতার ঘাটতি হবে প্রায় আড়াই লাখ টিইইউএস কন্টেনার। আর ২০২২ সালে সেই ঘাটতি পৌঁছবে ১০ লাখ টিইইউএস কন্টেনারে। এসব বিবেচনায় রেখে দ্রুততার সঙ্গে বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা না হলে বড় ধরনের বিপাকের মুখে পড়ার আশঙ্কা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য এমএ লতিফ এমপি এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আবাসিক এলাকা গড়বার জন্য অনেক জায়গা পাওয়া যাবে। কিন্তু বন্দর যেখানে সেখানে করা যায় না। বন্দর গড়তে হবে সাগর পাড়ে। আবাসিক এলাকা হলে তা হবে শুধুই চট্টগ্রামের। তা দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু বন্দর হলে তা হবে পুরো দেশের। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরী। অগ্রগতি প্রসঙ্গে তিনি জানান, সেখানে বে-টার্মিনালই নির্মিত হবে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা রয়েছে। চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা প্রয়োজন। এটি শুধু ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয় নয়। বরং চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারণ না ঘটিয়ে কোন বিকল্প নেই। সেখানে টার্মিনাল হলে অনেক বড় এবং বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যাবে। তাছাড়া বে-টার্মিনাল নির্মাণের জন্য এটি অত্যন্ত উপযোগী একটি স্থান। সেখানে বন্দর ছাড়া অন্য কিছু করতে গেলে তা আত্মঘাতী হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, বে-টার্মিনাল বাস্তবায়ন করতে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে। এ প্রকল্পে যুক্তরাজ্য, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ সহায়তা প্রদানে আগ্রহী। বন্দরনগরীর পতেঙ্গা সংলগ্ন উত্তর হালিশহর এলাকায় জেগে উঠা চর এলাকাটি বিকল্প বন্দর গড়ে তোলার জন্য খুবই উপযোগী। সেখানে সব মিলিয়ে আড়াই হাজার একর জমি পাওয়া যাবে। বে-টার্মিনাল হলে ৫ হাজার কন্টেনার ধারণক্ষমতার জাহাজ অনায়াসে ভিড়তে পারবে। আর বর্তমানে বন্দর জেটিতে ভিড়তে পারছে সর্বোচ্চ ১৮শ’ টিইইউএস কন্টেনার ধারণ ক্ষমতার জাহাজ। তাছাড়া জোয়ারভাটা নির্ভর হওয়ায় জাহাজগুলোকে কর্মহীন ভাসতে হয় দৈনিক প্রায় আঠার ঘণ্টা। দেশের আমদানি-রফতানি এবং একইসঙ্গে জাহাজের সাইজ যেভাবে বড় হচ্ছে তাতে বে-টার্মিনাল না হলে বর্তমান বার্থ দিয়ে চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে না। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (এডমিন এ্যান্ড প্লানিং) মোঃ জাফর আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা তো টার্মিনালের জন্য পুরো জায়গা চাচ্ছি না। বে-টার্মিনাল হবার পরও সেখানে আরও জায়গা থাকবে। কাজের অগ্রগতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হলে বিদেশী পরামর্শক নিয়োগ করা হবে। ভূমির সঙ্গে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা যেহেতু রয়েছে, সেহেতু চউকের অনুমোদন নিয়ে ভূমি অধিগ্রহণ কাজ শুরু করা হবে। খুব শীঘ্রই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বে-টার্মিনাল প্রকল্প অনুমোদিত হয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
×