ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

রফতানি খাতে হতে পারে অনন্য সংযোজন

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২৮ অক্টোবর ২০১৫

রফতানি খাতে হতে পারে অনন্য সংযোজন

আমাদের দেশে হলুদ ব্যবহৃত হয় প্রধানত ৩ কাজে। এক. এখনও বিয়ের আগে হিন্দু, মুসলমান এমনকি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ভাবি বর-বধূকে মাঙ্গলিক সূত্র অনুযায়ী হলুদ দিয়ে গা ধুয়ে দেয়া হয়। দুই. আমাদের রান্নায় হলুদের ব্যবহার সর্বজনীন। পৃথিবীর অন্য কোন দেশের রান্নায় হলুদ ব্যবহৃত না হলেও এই উপমহাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশে এবং অন্যান্য দেশে ছড়ানো ভারতীয় বা বাংলাদেশী হোটেল রেস্টুরেন্টে কারি নামে পরিচিত রসনা তৃপ্তিকরণের নিরামিষ তরকারি, মাছ বা মাংস রান্নায় হলুদের ব্যবহার সর্বজনবিদিত। তিন. হিন্দু পুরোহিত ও বৌদ্ধ সাধু-সন্তরা, দেহ ও মন পবিত্র রাখার সহায়ক হিসেবে হলুদ দিয়ে রঞ্জিত বস্ত্র পরিধান করেন। আদা গোত্রের গেড় বা কন্দ বা শিকর রূপে সারা বছর ধরে বেড়ে ওঠা বা গজানো গাছ হলো হলুদের। ২০-৩০ সে: তাপ এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টি বা হলুদের কন্দ গজানোর জন্য অনুকূল। বন্যা বা জমে থাকা পানি হলুদ গজানোর জন্য প্রতিকূল। প্রতিবছর গাছ তুলে বা গাছের নিচ থেকে তার গেড় ও কন্দ হলুদ হিসেবে আহরণ করা হয়। তাজা বা কাঁচা হলুদ হিসেবে ব্যবহার না হলে আহরিত কন্দ ৩০-৪৫ মি. সিদ্ধ করে তা শুকিয়ে নিয়ে গুঁড়ো করে হলুদকে মসলা, গা ধোয়ার উপকরণ কিংবা পরিধেয় রঞ্জিত করার কাজে ব্যবহৃত করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৩ সালে দৈবচয়নের ভিত্তিতে দেশে প্রতি ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ বা তার চাইতে বেশি পরিমাণ জমি হলুদ চাষে প্রযুক্তকৃত সকল গৃহস্থালির জরিপের ভিত্তিতে হলুদ চাষের ওপর একটি প্রতিবেদন বের করেছে। এই জরিপে দুটি ভৌগোলিক ভাগ ছিল। প্রথম ভাগে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িসহ ৫টি পার্বত্য জেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। জরিপে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জকে পার্বত্য এলাকা হিসেবে পৃথকভাবে বিবেচনা করা যায়নি। দ্বিতীয় ভাগে বৃহত্তর সিলেটসহ দেশের অন্য ৫৯টি জেলা বা সমতল ভূমিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সর্বমোট ৩০ হাজার গৃহস্থালিকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে এই জরিপের মোড়কে নেয়া হয়েছিল। জরিপে প্রাপ্ত উপাত্তাদি ২০১৪ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে। জরিপে জানা গেছে যে, সারাদেশে ৫ শতাংশ জমি হলুদ চাষে প্রযুক্ত করছে এমন গৃহস্থালির আওতায় সর্বমোট ৭৭৮৩৭ একর জমিতে হলুদ চাষ হয়। অর্থাৎ দেশে সর্বমোট ৭৭৮৩৭ একর জমি বাণিজ্যিকভাবে হলুদের চাষে প্রযুক্ত। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী হলুদ চাষের যে ব্যাপ্তি তার তুলনায় প্রকৃত চাষ অনেক কম। হলুদ চাষে প্রযুক্ত জমির মধ্যে প্রায় শতকরা ৩৮ ভাগ চাষ হয় পার্বত্য এলাকার চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায়। বাকি শতকরা ৬২ ভাগ চাষ হয় সমতল এলাকার ৫৯টি জেলায়। বাণিজ্যিক চাষের বাইরে গৃহস্থালির আনাচে-কানাচে পতিত ভূমিতে, কবরস্থান ও শ্মশানের কোণে খোরপোষের প্রয়োজন মিটানোর জন্য সক্ষম হলুদ গাছ জন্মে। এসব জমি হিসেবে নিলে সারাদেশে প্রায় ১.৫০ লাখ একর জমিতে হলুদ উৎপন্ন হয় বলে অনুমান করা যায়। দৃশ্যত হলুদ চাষের শীর্ষ স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা। ধারণা করা যায় যে, এই ৫টি জেলায় হলুদ চাষ আরও বিস্তৃত করার পরিধি রয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, বৃহত্তর সিলেট জেলাকে সমতল এলাকার ভূমি থেকে পৃথক করে জরিপের আওতায় আনা হয়নি। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সারাদেশের হলুদ চাষে প্রযুক্ত জমির শতকরা ২৫ ভাগে হলুদ একক ফসল হিসেবে এবং বাকি শতকরা ৭৭ ভাগ জমিতে তা অন্যান্য ফসলের সঙ্গে মিশ্রভাবে চাষ করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে একক ফসল হিসেবে হলুদের চাষ, ধান, গম ইত্যাদি চাষে অপ্রযোজ্য পাহাড়ী বা অনুর্বর জমিতে করা হয়। ভূমি উন্নয়নের মাধ্যমে এসব জমিতে মিশ্র চাষের প্রবর্তন করে হলুদের বাণিজ্যিক চাষে উৎপাদনরত গৃহস্থালিসমূহ অধিকতর লাভ অর্জন করতে পারে। দেশব্যাপী বাণিজ্যিকভাবে প্রযুক্ত হলুদ উৎপাদনের খামারে ক্রমান্বয়ে মিশ্র চাষ বাড়বে বলে মনে হয়। জরিপে দেখা গেছে, বাণিজ্যিকভাবে হলুদ উৎপাদনরত সকল গৃহস্থালির প্রায় শতকরা ১৭ ভাগ ছায়ায় আচ্ছাদিত জমিতে হলুদের চাষ করে। আর বাকি প্রায় শতকরা ৮৩ ভাগ উন্মুক্ত ভূমিতে হলুদ উৎপাদন করে। অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদনশীল ৫৯টি জেলায় উন্মুক্ত স্থানে বাণিজ্যিকভাবে হলুদ উৎপাদনরত গৃহস্থালির সংখ্যা এই সকল গৃহস্থালির প্রায় শতকরা ৪৯ ভাগ। আর অপেক্ষাকৃত অধিক উৎপাদনশীল পতিত এলাকায় প্রায় শতকরা ৩৪ ভাগ উন্মুক্ত জমিতে হলুদের চাষ হয়। ছায়ায় আবৃত জমি অনেকাংশে পতিত বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে হলুদের চাষ বিস্তৃত করতে হলে এই সব পতিত বা প্রধান প্রধান ফসল উৎপাদনে অব্যবহৃত জমিতে হলুদের চাষ প্রসারিত করতে হবে। এই লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কর্তৃক যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া সঙ্গত হবে। জরিপে জানা গেছে, একরপ্রতি এক বছর ধরে হলুদ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় চারা রোপণে প্রায় ২০ জন শ্রমিক, আগাছা পরিষ্কারকরণে বা নিড়ানিতে ১৮ জন শ্রমিক এবং ফসল তোলায় ২৫ জন শ্রমিক অর্থাৎ মোট প্রায় ৬৩ জন শ্রম দিবসের হিসাবে প্রয়োজন হয়। পার্বত্য ৫ জেলায় একরপ্রতি উৎপাদনে শ্রমিকের প্রয়োজন প্রায় ৩৪ জন আর সমতল এলাকার ৫৯টি জেলায় এই প্রয়োজনের সংখ্যা ৭৬ জন। রোপণে পার্বত্য এলাকায় গড়ে একরপ্রতি প্রায় ১৩ জন শ্রমিক, নিড়ানিতে ১০ জন শ্রমিক এবং ফসল তোলার জন্য ১৭ জন শ্রমিক প্রয়োজন হয়। দৃশ্যত পার্বত্য এলাকায় হলুদ চাষ অনেকটা মানব পরিশ্রমের বাইরে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। হলুদের চাষ অধিকতর লাভজনক হলে কিংবা পার্বত্য এলাকার কৃষকগণ অধিকতর আগ্রহী হলে একরপ্রতি শ্রমিক সংখ্যার প্রয়োজন বাড়বে। অবশ্য যদি নির্বাচিতভাবে রোপণ, নিড়ানি ও ফসল তোলায় যন্ত্রীকরণ আসে বা প্রচলিত হয় তাহলে প্রয়োজনীয় শ্রমিক সংখ্যা কমে আসবে। জরিপে, একরপ্রতি ছায়ায় আবৃত হলুদের জমিতে বছর বা মৌসুম প্রতি ২১ জন শ্রমিক প্রয়োজন হয়। অথচ ছায়াবিহীন বা উন্মুক্ত হলুদ খামারের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ১৯ এর বেশি নয়। সমতল ভূমির ৫৯টি জেলায় একর ও মৌসুমপ্রতি শ্রমিকের প্রয়োজন হিসাবকৃত হয়েছে ৭৬ জনেরও বেশি। পার্বত্য এলাকার তুলনায় রোপণ, নিড়ানি এবং ফসল তোলার এই তিন কাজেই সমতল এলাকার হলুদ চাষে প্রায় শতকরা ২২ ভাগ অধিক সংখ্যক শ্রমিক প্রয়োজন হয়। এর কারণ সম্ভবত পার্বত্য ৫টি জেলায় হলুদ চাষ অনেকটা অপেক্ষাকৃত কম নজর দেয়া বনজ ফসল রোপণ ও ঘরে তোলার মতো। এর প্রতিফলন অনেকাংশেই ঘটেছে হলুদ চাষে প্রযুক্ত প্রতিএকর জমির ইজারা মূল্যের তারতম্যে। সারা বাংলাদেশে হলুদ চাষে প্রযুক্ত ১ একর জমির বার্ষিক ইজারা মূল্য ২১,৪২২ টাকা; পার্বত্য এলাকায় এই মূল্য ১০,১৩০ টাকা এবং সমতল ভূমির জেলাসমূহে এই রূপ ইজারা মূল্য হিসাবকৃত হয়েছে ২৪,৬৪৩ টাকায়। জরিপ অনুযায়ী হলুদ চাষে একরপ্রতি ৩৫৩৬ টাকার সার প্রয়োগ করা হয়। ব্যবহৃত সারের মধ্যে ইউরিয়া সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। পার্বত্য এলাকায় সারের ব্যবহার কম-সমতল এলাকায় ব্যবহৃত সারের মূল্যের তুলনায় মাত্র শতকরা ১৮%। মূল্যের হিসাবে জৈব সারের ব্যবহার মোট ব্যবহৃত সারের মাত্র শতকরা ১৫%। তর্কাতিতভাবে বলা চলে, পার্বত্য এলাকায় সুসম সার ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানোর পরিধি বিস্তৃত। জরিপে দেখা গেছে, ১ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে এক মৌসুমে বা বছরে হলুদ উৎপাদনে খরচ পড়ে ৩১৫৭৫ টাকা। এর মধ্যে জমি তৈরিতে ব্যয় হয় প্রায় শতকরা ১২ ভাগ, বীজ বাবদ ব্যয় হয় প্রায় ২০ ভাগ, রোপণ ব্যয় প্রায় শতকরা ১৪ ভাগ, নিড়ানিতে ব্যয় হয় প্রায় শতকরা ১২ ভাগ, সেচ ও কীটনাশকাদিতে ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় শতকরা ৩.৫ ভাগ। সারে ব্যয় হয় মোট ব্যয়ের শতকরা ১১ ভাগ; ফসল তোলায় ব্যয় হয় প্রায় শতকরা ১৯ ভাগ এবং সিদ্ধকরণে ব্যয় হয় প্রায় শতকরা ৬ ভাগ। লক্ষণীয়, সমতল ভূমিতে একরপ্রতি উৎপাদন ব্যয় হয় ৩৬,৮৫৪ টাকা এবং পার্বত্য জেলাগুলোতে এরূপ ব্যয়ের পরিমাণ হিসাবকৃত হয়েছে ২২,৯০১ টাকায় বা প্রায় শতকরা ৩৮ ভাগ কমে। দৃশ্যত পার্বত্য জেলাসমূহের আপেক্ষিকতায় সমতল জেলাগুলোতে হলুদ চাষে অধিকতর মনোযোগ ও ব্যয় প্রযুক্ত করা হয়। হলুদ চাষে প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ প্রদানের কোন তথ্য জরিপে প্রতিফলিত হয়নি। অনুমান করা যেতে পারে যে হলুদ চাষে প্রাপ্ত বা ব্যবহৃত ঋণ প্রায় সর্বাংশে মহাজন বা ফড়িয়া থেকে নেয়া হয় এবং সম্ভবত প্রয়োজনের নিরিখে এই ঋণাঙ্ক অপ্রতুল। কৃষি ব্যাংকসহ কৃষি-ঋণ দেয়ার-নেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যান্য ব্যাংকের এদিকে নজর দেয়া সঙ্গত হবে। সারাদেশে ছায়ায় আচ্ছাদিত হলুদ চাষের জমিতে একরপ্রতি বার্ষিক উৎপাদন ব্যয় হয় ৩২,৩৪৭ টাকা আর উন্মুক্ত এলাকায় এরূপ ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩১,৪২৩ টাকা। উন্মুক্ত এলাকার তুলনায় ছায়াযুক্ত এলাকায় উৎপাদন খরচ কেন বেশি তার কোন বোধগম্য কারণ জরিপে শনাক্ত হয়নি। দেখা গেছে, পার্বত্য এলাকার ৫টি জেলায় সমতল ভূমির জেলাগুলোর তুলনায় ছায়ায় আচ্ছাদিত এবং উন্মুক্ত জমির উভয়ই ক্ষেত্রেই উৎপাদিত হলুদের একরপ্রতি উৎপাদন ব্যয় দেশের অন্য জেলাগুলোর তুলনায় বেশ কম। এক কেজি কাঁচা হলুদ উৎপাদনে সারাদেশে গড়ে ব্যয় হয় ৫.৩২ টাকা আর একই পরিমাণ শুকনো হলুদ উৎপাদনে ব্যয় হয় ২৬.৬২ টাকা। শুকনো হলুদ উৎপাদনের ব্যয়ে অবশ্য হলুদ গুঁড়ো করার ব্যয়ও অন্তর্ভুক্ত। জরিপ অনুযায়ী নিজস্ব জমিতে একরপ্রতি বার্ষিক উৎপাদন ব্যয় হিসাবকৃত হয়েছে ৩১,৫৩৩ টাকায়। ভাগ চাষের ক্ষেত্রে এই ব্যয়ের পরিমাণ ৩০,৭৩২ টাকা। বন্ধকে নেয়া জমির ক্ষেত্রে বার্ষিক উৎপাদন ব্যয়ের পরিমাণ ৩২,৮৩৬ টাকা আর ইজারায় গৃহীত জমির ক্ষেত্রে এই ব্যয় হিসাবকৃত হয়েছে ৩৩,৬২২ টাকায়। সারাদেশে একরপ্রতি বার্ষিক উৎপাদিত হলুদের মূল্য হিসাবকৃত হয়েছে ৬৪,৩৪৮ টাকা। একরপ্রতি উৎপাদন ব্যয় ৩১,৫৭৫ টাকার তুলনায় এ প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি। সমতল ভূমিতে একরপ্রতি বার্ষিক উৎপাদন ব্যয় ৩৬,৮৫৪ টাকার বিপরীতে উৎপাদিত হলুদের মূল্য হিসাবকৃত হয়েছে ৭৯,৩৪৩ টাকা। আর পার্বত্য জেলাসমূহের একরপ্রতি বার্ষিক উৎপাদন খরচ ২২,৯০১ টাকার তুলনায় উৎপাদিত হলুদের মূল্য হিসাবকৃত হয়েছে ৩৯,৭০৭ টাকায়। উভয় ক্ষেত্রেই হলুদের চাষ বেশ লাভজনক বলে বিদিত হয়েছে। সমতল ভূমির তুলনায় পার্বত্য এলাকায় হলুদের দাম বেশ কম। সম্ভবত এই কমতি পার্বত্য জেলাসমূহে হলুদের বাণিজ্যিক বাজারের সীমাবদ্ধতা এবং বাজার ও উৎপাদন ক্ষেত্রের মাঝে অপর্যাপ্ত পরিবহনের নিশানা বহন করে। সারাদেশে নিজস্ব মালিকানায় একরপ্রতি বার্ষিক বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হলুদের মূল্য হিসাবকৃত হয়েছে ৬৪,৬১৬ টাকায়; ভাগ চাষের ক্ষেত্রে এই মূল্য হিসাবকৃত ৫৫,৬৭৯ টাকায়; বন্ধককৃত জমির ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৬৮,০৮২ টাকা আর ইজারায় নেয়া জমির ক্ষেত্রে এই মূল্য দাঁড়িয়েছে ৬৯,০৬৮ টাকা। সারাদেশে উন্মুক্তভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হলুদ চাষের ক্ষেত্রে একরপ্রতি উৎপাদন ব্যয় ও উপযোগ বা ফিরতির হার হিসাবকৃত হয়েছে ২.৭ এ এবং ছায়ায় আবৃত জমির ক্ষেত্রে ১.৮৬ এ। দৃশ্যত সারাদেশে হলুদ চাষ লাভজনক বলে প্রতীয়মান। এতদসত্ত্বেও স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, হলুদের বাজার বা চাহিদা দেশে এবং দেশের বাইরে সীমিত বা অস্থিতিস্থাপক এবং সমকালে সমকালীন লাভজনকতার নিরিখে সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে হলুদ চাষের প্রসারণ তার গড় আয় বা উৎপাদন মূল্য কমিয়ে দিতে পারে। এই প্রেক্ষিতে হলুদ চাষের প্রসারণের জন্য ধান ও গম চাষে প্রযুক্ত জমির বাইরে অপ্রচলিত শস্য জন্মানোর এলাকায় প্রসারিত করা উত্তম হবে। এই লক্ষ্যে হলুদ চাষের জন্যে সমতল ভূমি বাদ দিয়ে ৫টি পার্বত্য জেলার ওপর যথাযথ জোর দেয়া লক্ষ্যানুগ হবে। বৃহত্তর সিলেট জেলাকেও এই লক্ষ্যে শ্রেণীভুক্ত করা উত্তম হবে। উপরোক্ত তথ্য-উপাত্তাদি বিশ্লেষণ করে হলুদ চাষের সম্প্রসারণ ও চাষের বিপরীতে অধিকতর আয় অর্জনের লক্ষ্যে কতগুলো পদক্ষেপ নেয়া সমীচীন হবে। এক. হলুদ গাছের উচ্চ ফলনশীল সঙ্কর বীজ বা চারা উদ্ভাবন করা সঙ্গত হবে। দেশে জমির স্বল্পতার বিবেচনায় একরপ্রতি উৎপাদন বাড়ানোর এই হবে সবচেয়ে ফলপ্রসূ কার্যক্রম। দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এদিকে যথাযথ দৃষ্টি দিতে পারে। দুই. হলুদের বাজার প্রসারণের লক্ষ্যে তার ভেষজ ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। জানা গেছে, আলজাইমার ও বহু মূত্র রোগ, পরিপাকতন্ত্রের অসুখ, বৃক্কের রোগ, বক্ষব্যাধি, গ্রন্থিবাত নিরাময়ে ও ঘা শুকনোকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে হলুদকে কার্যকরভাবে ব্যবহৃত করা যায়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ এখন হাতে নেয়া বা সমাপ্ত হয়নি। এই লক্ষ্যে দেশীয় ও বিদেশী ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন হবে। একই লক্ষ্যে হলুদ ব্যবহারকারী বাঙালী কারির রান্নার প্রক্রিয়া বিদেশে বিচ্ছুরিত করা কর্মানুগ হবে। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আমেরিকার নির্বাচিত এলাকায় বাঙালী ও ভারতীয় হোটেলের বাইরে ব্র্যান্ড সংযুক্ত হোটেল-রেস্তোরাঁর শেফদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই কাজটি সম্পন্ন করা যেতে পারে। তিন. কাপড়ের রং হিসেবে হলুদের ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে ধর্মতান্ত্রিকতার বাইরে হলুদ রঞ্জিত পোশাককে সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত পরিধেয় হিসেবে বের করে নিয়ে আসতে হবে। এই লক্ষ্যে ফ্যাশন ডিজাইনার, তৈরি পোশাক এবং বস্ত্র উৎপাদনকারীদের সঙ্গে হলুদ উৎপাদনকারীর প্রাযুক্তিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। বলা প্রয়োজন সমকালে এই ধরনের যোগাযোগ হয় অনুপস্থিত নয় খুবই সীমিত।
×