ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রেজাউল করিম খোকন

চিঠি দিও প্রতিদিন...

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৬ অক্টোবর ২০১৫

চিঠি দিও প্রতিদিন...

চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও/ নইলে থাকতে পারবো না/চিঠিগুলো অনেক বড় হবে/পড়তে পড়তে সকাল দুপুর আর রাত্রি চলে যাবে/কোথায় থাকো, কেমন থাকো একে একে সবই লিখো। সেই তো হবে মোর সান্ত¡না। আশির দশকের একটি বাংলা ছবি ‘অনুরোধ’-এর জনপ্রিয় গানের কয়েকটি কলি এখানে উদ্ধৃত করা হলো। গানটি গেয়েছেন প্রখ্যাত গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিন। নায়কের অনুপস্থিতিতে বিরহকাতর নায়িকা গানের মাধ্যমে তার হৃদয়ের একান্ত আবেগ প্রকাশ করছে। গানে গানে নায়িকা প্রতিদিন চিঠি লিখতে অনুরোধ জানায় নায়ককে। চোখের আড়ালে অনেক দূরে অবস্থান করলেও চিঠির মাধ্যমে পরস্পরের কাছাকাছি থাকার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে নায়িকার মুখের গানটি দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। এখনও গানটি বেশ জনপ্রিয়। চিঠি নিয়ে আরেকটি জনপ্রিয় গানের কথা এখানে উল্লেখ না করে পারা যায় না। সত্তর আশির দশকের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত শিল্পী মিনা বড়ুয়া গেয়েছিলেন গানটি। বাংলার পথে প্রান্তরে লোকমুখে দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল এ গানটিও। গানটি হলোÑ ‘যারে যা চিঠি। লেইখা দিলাম সোনাবন্ধুর নামে রে। আমার অন্তরের প্রেম ভরিয়া ভালোবাসার খামেরে। যারে যা চিঠি। চিঠি রে তুই পঙ্খী হ। পলকে তুই উইড়া যা। তখনকার দিনে পত্রমিতালী করা ছিল একটি বিশেষ শখ। বিদেশী পত্রবান্ধবীদের সঙ্গে আমার নিয়মিত পত্রযোগাযোগ ছিল। আমি আবার নিজের কথা, পরিবারের কথা, বন্ধুবান্ধবদের কথা, পড়াশোনা এবং দেশের সাংস্কৃতিক সামাজিক, প্রাকৃতিক নানা বিবরণ তুলে ধরতাম তাদের কাছে লেখা চিঠিগুলোতে। তারাও তাদের নিজেদের কথা, পরিবারের কথা, সামাজিক নানা বিষয়, ভাললাগা মন্দলাগা নানা অনুভূতির কথা জানাত তাদের পত্রে। আমি ভীষণ উপভোগ করতাম বিদেশী পত্রবান্ধবীদের সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগের ব্যাপারটা। একইভাবে দেশেও কয়েকজনের সঙ্গে নিয়মিত পত্রযোগাযোগ ছিল। তারা কেউ আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন, কেউ বা সমবয়সী আবার বয়সে ছোটও ছিল কয়েকজন। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে যতœসহকারে চিঠিগুলো লিখতাম। তারা সবাই আমার চিঠিগুলো পড়ে দারুণ মুগ্ধ হতো। আমার চিঠির প্রশংসা করে তারা অনেক কথাই বলত। তারা বলত, আমার লেখা চিঠিগুলো স্রেফ চিঠি নয়, যেন একেকটি গল্প। যা পড়ে তারা বেশ আনন্দ পেত। চিঠি পাঠিয়ে তাদের কাছ থেকে চিঠি পাবার প্রতীক্ষায় থাকতাম আমিও। আমাদের এলাকার পোস্ট অফিসের ডাকপিয়ন ছিলেন হারুন ভাই। রাস্তা ধরে তিনি হেঁটে আসছেন দেখামাত্রই ছুটে যেতাম, আমার কোন চিঠি আছে কিনা জানতে চাইতাম, চিঠির জন্য আমার অপেক্ষার কথা তিনি জানতেন, আমার চিঠি থাকলে হাসিমাখা মুখ নিয়ে বলতেন, ‘চিঠি আছে, খোকন ভাই।’ চিঠিগুলো পেলে মনটা অনেক আনন্দে ভরে যেত। খাম খুলে সঙ্গে সঙ্গে চিঠি পড়তে শুরু করতাম না। একটু ধীরে সুস্থে বেশ সময় নিয়ে চিঠিগুলো পড়তাম। ওটা ছিল দারুণ আনন্দময় একটা সময়। আমার কাছে যারা চিঠি লিখত তারাও বেশ পটু ছিল। আমিও বেশ উপভোগ করতাম তাদের লেখা চিঠিগুলো পড়ার সময়টা। চিঠি পড়েই আবার বসে যেতাম তার জবাব লিখতে। সেই চিঠিগুলোতে অনেক জিজ্ঞাসা থাকত, প্রশ্ন থাকত, নানা প্রসঙ্গে কৌতূহল থাকত। থাকত সদ্য পড়ে শেষ করা কোন জনপ্রিয় লেখকের উপন্যাসের ছোটখাটো আলোচনা, কিংবা টিভির সাপ্তাহিক কিংবা এ মাসের নাটকটি নিয়ে আলোচনা, সিনেমা হলে গিয়ে দেখা কিংবা ভিডিওতে দেখা হিন্দী ইংরেজী ছবিটির ভাললাগা মন্দলাগা বিষয়, রাজনীতি নিয়ে তেমন বিচার বিশ্লেষণ না থাকলেও বিদ্যমান রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে একান্ত অনুভূতিরও প্রকাশ থাকত। আশির দশকের প্রথম দিকে তখন দেশে এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসন চলছে। দেশজুড়ে নির্যাতন আর অনাচারে অতিষ্ঠ সবাই। আমার লেখা চিঠিগুলোতে স্বৈরাচারী সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ক্ষোভের প্রকাশ থাকত। তখন অনেকেই বলতেন, ‘খবরদার চিঠিতে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লিখতে যেওনা, পোস্ট অফিসে চিঠিগুলো খুলে খুলে দেখা হয়, কেউ যদি স্বৈরাচারী সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে কিছু লিখে তাহলে তার খবর আছে। এসব শুনে ভয় পেলেও আমার চিঠিতে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, ঘৃণার প্রকাশ বন্ধ হয়নি। আমার চিঠি লেখার এবং বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চিঠি পাবার সেই মধুমাখা স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা মনে হলে কেমন যেন লাগে। আহা, আমার চিঠি লেখা ও পাবার দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল। তখন চিঠি লিখে তা পোস্ট করার জন্য পোস্ট অফিসে যেতে হতো। খাম কিনতে, টিকেট কিনতে পোস্ট অফিসে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হতো, বিদেশে চিঠি পাঠাতে হলে ফ্রাংকিং মেশিনে খামে সিল মারাতে হতো, সেই কাউন্টারের সামনে কতদিন লাইনে দাঁড়িয়ে চিঠি পোস্ট করেছি। ঈদ কিংবা ইংরেজী নববর্ষ এলে পোস্ট অফিসে এই লাইন আরও দীর্ঘ হয়ে যেত। তখন ডাকযোগে প্রিয়জনের কাছে ঈদ কার্ড, নিউ ইয়ারস গ্রিটিংস কার্ড পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। এ কারণেই ঈদ কিংবা নববর্ষ এলে পোস্ট অফিসে গেলে ভিড়ের ধাক্কা সহ্য করতে হতো সবাইকে। সময়ের আবর্তনে ধীরে ধীরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। এখন আর আগের মতো চিঠি লেখার প্রচলন নেই। বলা যায়, চিঠি লেখার দিন বিদায় নিয়েছে, চিঠিরও প্রয়োজন ফুরিয়েছে। মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের যুগে এখন আর কেউ কাগজ-কলম নিয়ে একজন আরেকজনের কাছে চিঠি লিখতে বসে না। সেই সময় বা ফুরসত কোথায়? সবাই তুমুল ব্যস্ত হরেক রকমের কাজে। যে যেখানেই থাকুক না কেন কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইলেই মোবাইল ফোনে প্রয়োজনীয় কথা সেরে ফেলছেন ঝটপট। শহর থেকে গ্রামে কিংবা গ্রাম থেকে শহরে এমনকি সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে প্রবাসী প্রিয়জনের সঙ্গে মুহূর্তেই যোগাযোগ করতে পারছেন। মন খুলে কথা বলতে পারছেন, নিজের সমস্যা, আবেগ অনুভূতি, চাহিদা সবকিছুই মোবাইল ফোনে জানাতে পারছেন ও প্রান্তের প্রিয়জনের কাছে। আগে যেখানে চিঠি লিখে পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্ট করার পর নির্দিষ্ট ঠিকানায় প্রাপকের কাছে পৌঁছুতে সপ্তাহ এমনকি মাস পেরিয়ে যেত আর এখন মোবাইলে যখন খুশি তখনই দূরদূরান্তে থাকা প্রিয়জনের সঙ্গে মুহূর্তেই কথা বলতে পারছেন সবাই। শুধু কথা বলেই সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না কেউ কেউ থ্রি জি মোবাইল সার্ভিস চালু হওয়ায় স্মার্ট ফোন সেটের মাধ্যমে কথা বলার সময় অন্য প্রান্তে থাকা মানুষটিকেও সরাসরি দেখতে পারছেনও। একইভাবে স্কাইপি, ভাইভার, ইমো প্রভৃতির কথা বলা যায়। আজকাল ভিডিও কল এ তেমন খরচ হয় না বলে অনেকেই এভাবেই মোবাইলে অন্যপ্রান্তে থাকা মানুষটির সঙ্গে খোশগল্পে মেতে উঠছেন। ঈদ কিংবা নববর্ষ এলে এখন আর আগের মতো দোকানে কার্ড কেনার ধুম পড়ে না। ফেস বুক, ই-মেইল, মোবাইল এসএমএস, এমএমএসের মাধ্যমে একজন আরেক জনকে শুভেচ্ছা জানাতে দেরি করছেন না। অতীত দিনের চিঠির একুশ শতকীয় সংস্করণ, ই-মেইল আর এসএমএসেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন সবাই। আজকাল কারও পক্ষে নীরব নিভৃত নিরবচ্ছিন্ন শান্ত ঢিলেঢালা জীবন কাটানোর উপায় নেই। এক চিলতে অলস হলুদ কিংবা নীল মায়াবী চিঠির খাম এখন অতীত স্মৃতিময় উপাদানে পরিণত হয়েছে। চিঠি লেখা এবং পড়ার দিনগুলো এখন নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করে আমাকে, আমার মতো আরও অনেককে। কর্পোরেট কিংবা নন কর্পোরেট দুনিয়ায় সবাইকে ই- মেইলের ওপর নির্ভর করতে হয়। এছাড়াও আছে মোবাইল ফোনে এসএমএসে লুকোচুরি খেলা, ফাঁকিবাজির নিত্য নতুন কৌশল প্রয়োগ। প্রিয় মানুষটির বিরহ যন্ত্রণায় হৃদয়ে তোলপাড় হলেও কেবলমাত্র কয়েকটি শব্দের কথা ‘মিস ইয়্যু’ অথবা ‘লাভ ইয়্যু’ লিখেই ক্ষ্যান্ত দেয় ইন্টারনেট যুগের মানুষ। কেউ বাড়তি শব্দ প্রয়োগের দিকে পা বাড়ায়না, যত সংক্ষিপ্ত আকারে মনের ভাব প্রকাশ করা যায় তার প্রতিযোগিতা যেন লেগে আছে, পৃষ্ঠাভর্তি চিঠি লেখা এবং পড়ার ধৈর্য্য এখন আর নেই কারো। মেদহীন, স্মিম এসএমএসই এখন সবার পছন্দ, যেখানে আবেগের প্রকাশ থাকলেও সেটা অনেকটাই ফর্মাল। আগের মতো পত্রমিতালীর জোয়ার কিংবা উচ্ছ্বাস নেই। ফেসবুকের বন্ধুবান্ধীদের সামাল দিতে দিতে একেকজনের বেকায়দা অবস্থা। সবার সঙ্গে প্রতিদিন চ্যাট রার সুযোগ কোথায়, তারপরেও ‘হাই’ ‘হ্যালো’ বলে কেউ পার পেয়ে যেতে চেষ্টা করেন। বিখ্যাত ইংরেজী সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছিলেন, ‘ভাষার কাজ হলো ভাবকে একটুও বাকি না রেখে পুরোপুরি প্রকাশ করা। যা কিছু চোখ দিয়ে দেখা যায়, নাক দিয়ে গন্ধ পাওয়া যায়, হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায় এবং সবকটি ইন্দ্রীয় দিয়ে যে ইন্দ্রীয় সুখ লাভ করা যায় তার ভাগ পাঠককে দেয়া।’ এসএমএস, টুইটার, হোয়াটস এ্যাপ এ কি তা সম্ভব? কিংবা ই-মেইলেও? একটা খাম কেনার আয়োজন থেকে আরম্ভ করে চিঠির নীল, হলুদ- রঙের কাগজ, হাতের লেখা কলমের কালি- প্রিয় মানুষের হাতের ছোঁয়া, একান্ত সৌরভ, সব মিলিয়ে চিঠির মধ্যে যে, অফুরন্ত আন্তরিকতা, অকৃত্রিমতা, স্বতঃস্ফূর্ততা, প্রাণময়তার প্রকাশ ছিল, এখনকার ই-মেইল কিংবা এসএমএসের ক্ষেত্রে তা কোথায়? চিঠির গদ্য সাহিত্যের পদবাচ্য হয়ে উঠেছে কত সময়ে, তা সাহিত্যকেও অতিক্রম করে গেছে অনেক সময়। চিঠি লেখার কালে যে আবেগ, ওই আবেগই সম্ভবত তাড়িত করে ওরকম নিখাদ গদ্য লেখার। অভিধানের কাটখোট্টা শব্দও চিঠিতে ভর করে হয়ে গেছে স্নিগ্ধ কোমল মন ছুঁয়ে যাবার মতো। পত্র সাহিত্য বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। এখন এসএমএস কিংবা ফেসবুকে কেউ ‘মিসিং’ শব্দুটি লিখে তার নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব, বিরহকাতরতা প্রকাশ করতে চায়, সামান্য একটি শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে কি একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, বিরহকাতরতার অনুভূতি পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটানো সম্ভব? প্রেমকাতর মানবমানবী একান্ত আবেগগুলো চিঠির মাধ্যমে প্রকাশ করে আদান প্রদান করেছে। সেই চিঠি নিয়ে কত ঘটনা, কত নাটক হয়ে যেত। প্রেমিক-প্রেমিকার হাতে চিঠি পৌঁছাতে কত ফন্দি ফিকির করত তখন। অনেক গোপনীয়তার মধ্যে চিঠির আদান প্রদান করতে হতো তখনকার দিনগুলোতে। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, বিরহ বিষাদ, আবেগ উচ্ছ্বাসের প্রকাশ হিসেবে চিঠিই ছিল অবলম্বন একসময়ে। ষাটের দশকে বেশির ভাগ চিঠিরই থিম ছিলÑ বাবার কাছে টাকা চেয়ে ছেলের কিংবা ছেলেকে রাজনীতি থেকে দূরে থেকে পড়ালেখায় মনোযোগ দেয়ার উপদেশ, পরামর্শ। সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া সেই বিখ্যাত গান ‘চিঠি দিও প্রতিদিন’ অথবা মিনা বড়ুয়ার ‘যারে যা চিঠি লেইখা দিলাম সোনা বন্ধুর নামে’ গানের আবেদন এখন আর নেই। এখন প্রেমিকা কিংবা বিরহকাতর স্ত্রীকে প্রেমিক কিংবা স্বামীর চিঠির জন্য প্রতীক্ষা করতে হয় না দিনের পর দিন। ইচ্ছে করলেই মোবাইলে, ফেসবুকে, ই-মেইলে তাৎক্ষণিকভাবে মনের একান্ত আবেগ অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে পারে। মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট এখন প্রত্যেককে অন্যের খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এখন বিকাশ ওয়ালেট, ই-ক্যাশ, ইএফটি, শিওর ক্যাশ- মোবাইল ব্যাংকিং সেবার প্রসার ডাক বিভাগের মানি অর্ডার ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়েছে। এখন কেউ কারও কাছে মানি অর্ডারের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর কিংবা পাবার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা ডাকঘর চেনে না, কেউ জীবনে কোনদিন ডাকঘরে গেছে কিনা সেটাও গবেষণার বিষয়। কেউ কেউ চাকরি বাকরির দরখাস্ত কয়েক বছর আগেও পাঠানোর জন্য ডাকঘরে যেত। পাঠানোর জন্য কুরিয়ার সার্ভিসের ওপর ভরসা করেছে। আর এখন চাকরি-বাকরির জন্য অনলাইনে দরখাস্ত করতে হয়। ফলে ডাকঘরে যাবার প্রয়োজন আছে কি? আমরা দেখেছি একসময়ে ডাক পিওন আর পোস্টমাস্টার সাহেব দেশের সব এলাকায় শহর-বন্দর গ্রাম-মফস্বলে সর্বত্রই সবার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন। সবার বাড়িতে যাতায়াত ছিল ডাকপিওনের। বহুল প্রতিক্ষীত অনেক প্রত্যাশিত চিঠি কিংবা মানি অর্ডানের টাকা নিয়ে আসতেন বলে ঘরে ঘরে তার বেশ খাতির যতœ হতো। এখন চিঠির আদান প্রদান কমে যাওয়ায় ডাকঘর, পোস্টমাস্টার, ডাকপিওন তথা পোস্টাল সার্ভিসের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। মোবাইল-ইন্টারনেটের এই যুগে কমেছে চিঠি বিলির সংখ্যা, ডাক বিভাগের লোকসান গত ১৫ বছরে ১৩০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ২০০০ সালেও যেখানে ডাক বিভাগের বিলি করা চিঠির পরিমাণ ছিল ২৪ কোটি ৪ লাখ ২৭ হাজার, সেখানে ২০১৪ সালে বিলি হওয়া চিঠির সংখ্যা নেমে এসেছে ৪ কোটিতে। অর্থাৎ দেড় দশকে ডাক বিভাগে চিঠি বিলির সংখ্যা কমেছে ২০ কোটি বা প্রায় ৮৫ শতাংশ। অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী ডাক বিভাগে বছরে ২২ শতাংশ হারে লোকসান বাড়ছে। গত ১৫ বছরে ডাক বিভাগের লোকসান প্রায় সাড়ে ১৩শ’ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও আধুনিকায়নের সুবাদে এশিয়া মহাদেশের চীন, থাইল্যান্ড, ইউরোপের স্পেন, গ্রিসসহ অনেক উন্নত দেশে সরকারী ডাক বিভাগ এখনও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে আছে। বাংলাদেশেও ডাক বিভাগ আধুনিকায়নের লক্ষ্যে একাধিক প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। কিন্তু এক দশকেও কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ডাক বিভাগের অধীনে গত পাঁচ বছর আগে নেয়া প্রকল্প এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। অত্যন্ত ধীর গতিতে চলা এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হার মাত্র ১০ শতাংশ। ফলে এখন পর্যন্ত ডাক বিভাগের পরিবহন কাজ চলছে ট্রেন ও সরকারী স্টিমারে। যোগাযোগের জন্য এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে ল্যান্ডফোন। মান্ধাতার আমলের এমন যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ডাক বিভাগের চিঠি, পার্সেল, এমনকি টাকাও গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগছে দুই-তিন দিনের বেশি। অথচ পাশাপাশি ডাক বিভাগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বেসরকারী কুরিয়ার সার্ভিসগুলো আধুনিক দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থার কারণে লাভজনক ব্যবসা করে যাচ্ছে। মূলত বেসরকারী কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই ডাক বিভাগকে আধুনিক করা হচ্ছে না। সাধারণ চিঠির চেয়ে এখন পার্সেল ও টাকা পাঠানোর চাহিদা বেশি। বেসরকারী কুরিয়ার সার্ভিসগুলো এ ব্যবসা লুফে নিয়েছে। তাদের ব্যবসা দিন দিন রমরমা হচ্ছে। বেসরকারী কুরিয়ার সার্ভিস নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে টাকা লেনদেন করছে। ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়া শুধু মোবাইল-টেলিফোনে শাখা অফিসে কল করে মোটা অংকের চার্জ নিয়ে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। এ প্রক্রিয়া দেশের ভেতরে হুন্ডি কিংবা মানি লন্ডারিংয়ের মতো ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দেখেও যেন না দেখার ভান করছে। যদি ডাক বিভাগের মাধ্যমে যথাযথ নিয়মে আধুনিক পদ্ধতিতে দ্রুত টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে খুব কম সময়ের মধ্যে লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবে ডাক বিভাগ। বৈদেশিক চিঠি ও পার্সেল আদান-প্রদানে স্বচ্ছতা ও বিতরণ ব্যবস্থায় দ্রুততা আনতে পারলে ডাক বিভাগ অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারবে টিকে থাকার লড়াইয়ে। মডেল : তুর্য, নাজনিন ও সন্ধ্যা
×