ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আমলাতান্ত্রিক রূপ নিয়েই প্রকাশ হচ্ছে পে স্কেলের গেজেট

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৬ অক্টোবর ২০১৫

আমলাতান্ত্রিক রূপ নিয়েই প্রকাশ হচ্ছে  পে স্কেলের গেজেট

তপন বিশ্বাস ॥ শেষ পর্যন্ত পে-স্কেল আমলাতন্ত্রিক রূপ পাচ্ছে। সকল ক্যাডারের মধ্যে সমন্বয়ের পরিবর্তে প্রশাসন ক্যাডারকেন্দ্রিক পে-স্কেলের গেজেট প্রকাশ হচ্ছে। এতে অন্যান্য ক্যাডারের (লাইন পোস্ট) সৃষ্ট গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ এর ৫০টি পদ আবারও প্রশাসন ক্যাডারের দখলে চলে যাবে। প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ক্যাডার কর্মকর্তারা ৮ম গ্রেডে এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা ৯ম গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত হবেন। এসহ বিভিন্ন বৈষম্য রেখে ৮ম জাতীয় বেতন স্কেলের গেজেট প্রকাশের আগে ভেটিংয়ের জন্য তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ভেটিং শেষে আগামী সপ্তাহে এই গেজেট প্রকাশ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, সকল ক্যাডারের দাবির প্রেক্ষিতে এবং সকল বাধাবিপত্তি মাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১২ সালে সকল সার্ভিসের ৩০টি পদকে গ্রেড-১ এবং ২০টি পদকে গ্রেড-২ করা হয়। এই সকল কর্মকর্তা পদোন্নতিপূর্বক এই সকল পদে নিযুক্ত হবেন। প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগকে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। ফরাসউদ্দিন কমিশন ২০১৫ সালে বেতন স্কেল প্রণয়নের সময় সুপারিশ করে যে, যে সকল সার্ভিসে সীমিত পদোন্নতির সুযোগ রয়েছে বা পদোন্নতিবিহীন সার্ভিস অথবা বিলম্বে পদোন্নতি হয় তাদের সংশ্লিষ্ট বিধিমালা পরিবর্তন করে পদোন্নতির সুযোগ তৈরি করে পর্যায়ক্রমে টাইম স্কেল/সিলেকশন গ্রেড প্রথা বিলুপ্ত করা যেতে পারে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। এটি না করে সরকারকে ভুল বুঝিয়েই টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিলের সুপারিশ করে সচিব কমিটি। বিভিন্ন সার্ভিসের বিধিমোতাবেক লাইন পোস্টে পদোন্নতি পেয়ে গ্রেড-৩ ও গ্রেড-৪ এ উন্নীত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। পরে সিলেকশন গ্রেড পেয়ে হাতেগোনা কয়েক কর্মকর্তা গ্রেড-১ বা গ্রেড-২ তে উন্নীত হন। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করায় এতে বিভিন্ন টেকনিক্যাল ক্যাডারের কর্মকর্তা গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ তে উন্নীত হতে পারবেন না। এর মধ্যে বিভিন্ন চিফ ইঞ্জিনিয়ার, মাউসি’র মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদসহ বিভিন্ন পদ রয়েছে। বর্তমান পেক্ষাপটে টেকনিক্যাল (বিশেষায়িত) এই সকল পদে গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা দিয়ে এ জাতীয় টেকনিক্যাল পদ পূরণের আবশ্যকতা দেখা দেবে। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন ক্যাডারের বক্তব্যÑ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পরও কিছু কর্মকর্তা এই গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ পদ সৃষ্টিতে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আটকে রাখতে পারেনি। এবার পে-স্কেল প্রদানের সময় সুকৌশলে তারা এই পদগুলো কেড়ে নিচ্ছে। এতে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। এতে রাষ্ট্র বিশেষায়িত সার্ভিস থেকে সঠিক সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। ভবিষ্যতে এই সেক্টরগুলো হুমকির মুখে পড়বে। এ প্রসঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা মোঃ আরিফুল কায়সার জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার এ যাবতকালের সবচেয়ে ভাল একটা বেতন স্কেল প্রদান করেছে। কিন্তু টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করে সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার পরিবর্তে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষোভের সম্মুখীন হচ্ছে। সূত্র জানায়, ভেটিংয়ের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ক্যাডার কর্মকর্তারা ৮ম গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত হবেন আর নন-ক্যাডাররা হবেন ৯ম গ্রেডের অন্তর্ভুক্ত। এর আগে প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ক্যাডার ও নন-ক্যাডাররা ৯ম গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত হতেন। এটি আরেকটি বৈষম্য। এছাড়া সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা সরকারী বাসভবনে থাকেন তাদের সকলের প্রাপ্য বাড়িভাড়া কর্তন করা হয়ে থাকে। কিন্তু সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন প্রস্তাব করা হয়েছে। সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্তরা যারা সরকারী বাসভবনে থাকবেন তারা মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া পাবেন। সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ে পে-স্কেল বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছেন এমন এক শীর্ষ কর্মকর্তা যিনি ছিলেন উত্তরা ষড়যন্ত্রের অন্যতম সদস্য। তিনি সরকারের এত বড় সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছেন। সুকৌশলে তিনি বিভিন্ন বৈষম্য তৈরি করে এত ভাল বেতন স্কেল দেয়ার পরও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল হলেও ৩০ জুনের পর প্রাপ্য হওয়া প্রায় এক হাজার কর্মকর্তাকে সিলেকশন গ্রেড প্রদান করা হয়েছে। তারা এখন আইন মন্ত্রণালয়ে এটি বহাল রাখার জন্য বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় বলছে, আইন সকলের জন্য সমান। কেউ সিলেকশন গ্রেড পাবে আর কেউ বঞ্চিত হবে এটি হতে পারে না। এরপর থেকে তারা আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। অথচ অনুমোদিত বেতন স্কেল অনুযায়ী ৩০ জুনের পর আর কেউ টাইম স্কেল বা সিলেকশন গ্রেড প্রাপ্য হবে না। এদিকে, বেতন স্কেলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহাল এবং উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করার নামে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে একক কর্তৃত্ব দেয়ার সার্কুলার বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামছে প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটি। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব থেকে সচিব/সিনিয়র সচিব পর্যন্ত সকল পর্যায়ে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ক্যাডার কর্মকর্তা পদায়নের মাধ্যমে কৃত্য পেশাভিত্তিক জনপ্রশাসন গড়ে তোলা, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন, বঙ্গভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সকল ক্যাডারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, সকল ক্যাডার ও ফাংশনাল সার্ভিসে পদোন্নতির সমান সুযোগ প্রদান, নিজস্ব ক্যাডার ও ফাংশনাল সার্ভিস বহির্ভূত সকল ধরনের প্রেষণ বাতিলের দাবি জানিয়েছে তারা। শনিবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির সমাবেশ থেকে এসব দাবি আদায়ে আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সভাপতি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপি সভাপতির বক্তৃতায় আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করেন। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছেÑ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে সমস্যার সমাধানে তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করা, ২৮ অক্টোবর সকল উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও কেন্দ্রীয়ভাবে দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত মানববন্ধন কর্মসূচী, বেতন-ভাতা উত্তোলনের ক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাগণের পূর্বের নিয়ম অনুসরণ করা, ৫ নবেম্বর উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিবাদ সমাবেশ, ৫ নবেম্বরের মধ্যে উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি ও নীতিনির্ধারকগণের সঙ্গে মতবিনিময় করা। ৮ নবেম্বরের মধ্যে দাবি মানা না হলে পরবর্তীতে আরও কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে বলে জানানো হয়। সভাপতির বক্তৃতায় বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আমাদের আন্দোলন চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে। যেসব আমলা সরকারকে বিভ্রান্ত করছে, কর্মকর্তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার হরণ করছে তাদের বিরুদ্ধে। এই চক্রান্তকারীরা আমাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য করছে। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, অবশ্যই সফল হব। সমাবেশে বলা হয়, ঘোষিত বেতন স্কেলে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া সকল ক্যাডার ও সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী মর্যাদা ও আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ প্রশাসন ক্যাডারের নিজস্ব পদÑ সিনিয়র সহকারী কমিশনার, ডেপুটি কমিশনার, কমিশনার ইত্যাদি পদে তাদের পদোন্নতি দেয়া হয় না। বিধিবহির্ভূত ও অনৈতিকভাবে এবং অবস্থানগত সুবিধার অপব্যবহার করে তাদের সরকারের বিশেষ পদÑ উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে নির্ধারিত পদের চেয়ে অতিরিক্ত সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। কিন্তু অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাগণকে পদ না থাকার অজুহাতে বছরের পর বছর একই পদে ফেলে রাখা হয়। এছাড়া উপজেলা পরিষদের জন্য জারি করা সার্কুলারের মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ের সেলফড্রয়িং অফিসারদের মর্যাদা ক্ষুণœ করা হয়েছে। ইউএনও নিজেও উপজেলা পরিষদে একজন ন্যস্ত কর্মকর্তা। অথচ পরিষদকে কার্যকর করার নামে উপজেলা চেয়ারম্যানের চেয়ে ইউএনওকে অধিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ইউএনও একমাত্র কর্মকর্তা যার উপজেলা পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কোন কর্মসূচী বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেই। উপজেলাকে কার্যকর করতে ইউএনও’র কর্তৃত্ব বাতিল ও উপজেলা চেয়ারম্যানের ক্ষমতায়ন করতে হবে। সমাবেশে বলা হয়, বর্তমান সরকারের সুযোগ্য নেতৃত্ব ও জনমুখী পদক্ষেপের ফলে দারিদ্র্য দূরীকরণ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন, পরিবেশগত উন্নয়ন, শিক্ষা, গবেষণা, তথ্যপ্রযুক্তি, পানি, বিদ্যুত, গ্যাস, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলাসহ সর্বক্ষেত্রে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের এ ধারাকে ত্বরান্বিত করে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটিভুক্ত কর্মকর্তাগণ নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বেতন স্কেল থেকে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেয়া এবং উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করার নামে ইউএনওকে একক কর্তৃত্ব প্রদানের মতো সার্কুলার জারি চলমান স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের ধারাকে বাধাগ্রস্ত করার ‘আমলাতান্ত্রিক চক্রান্ত’ বলে সমাবেশে অভিহিত করা হয়।
×