ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রহমান মতি

সমালোচনার ধারা ও জীবনানন্দ দাশ

প্রকাশিত: ০৬:১২, ২৩ অক্টোবর ২০১৫

সমালোচনার ধারা ও জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে সমালোচনা প্রচুর হয়েছে। সমালোচনার সময়টি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর থেকে এখনকার সময় পর্যন্ত বিস্তৃত?। নতুন বিষয় এবং তার যুগকালীন বিশ্লেষণ এ ধারার সমালোচনার একটি বিশিষ্ট দিক। সাম্প্রতিক ধারার কিছু সমালোচনা দেখা যাক ১. সত্তর দশকের কবি অরুণেষ ঘোষ জীবনানন্দ নামে একটি গ্রন্থে স্বল্প পরিসরে সমালোচনা করেছেন। গল্পটি স্বল্প হলেও তাঁর বিষয় ও বিশ্লেষণের গভীরতা দেখার মতো মনে হয়। কিছু বিষয় এ ধরনের- ক. জীবনানন্দের জন্ম ঝরা পালক-এ হয়নি। হয়েছিল ধূসর পান্ডুলিপি-তে। খ. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁকে কোনো এক গ্রাম্য ও তৃতীয় শ্রেণীর কবি ভাবতেন। প্রমথ চৌধুরী ও আবু সয়ীদ আইয়ুব জীবনানন্দের ভাষা ও জগৎকে বুঝতেই পারেননি। গ. জীবনানন্দ ভয়ংকরভাবে অভিশপ্ত সেটি বুঝেছিলেন তাঁর স্ত্রী লাবণ্য দাশ। আর লাবণ্য দাশের চোখ দিয়েই জীবনানন্দ নিজেকে বুঝে নিতে চেয়েছিলেন, তিনি অভিশপ্ত কিনা। তাঁর সমস্ত গদ্যে এই অভিশপ্তের বিচ্ছিন্নতার মূল অন্বেষণের দিকটা রয়েছে। ঘ. জীবনানন্দ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই তিক্ত অভিজ্ঞতাকে লাঞ্ছনার পরই বোধ হয় বাংলা সাহিত্যের পরবর্তী প্রজন্মের কবি ও লেখকের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে, মিডিয়া সম্পর্কে সচেতন হয়েছিল এবং বুঝে গিয়েছিল এই আগ্রাসী ব্যবস্থার প্রতিবাদ না করে পথ নেই সে সৃজনশীলতার ভিতর দিয়েই হোক বা সৃজনশীলতার বাইরে গিয়েই হোক। ঙ. জীবনানন্দে এসে বুঝতে পারি, অভাবটা সেই ‘বোধে’র, যে বোধের, বাংলা ভাষায় আধুনিক সাহিত্যের শুরুতেই জন্ম হয়েছিল, তার আগে হয়নি। চ. ‘ধূসর পা-ুলিপি’-র বীজ ‘ঝরা পালকে’-র কবিতাগুলোর মধ্যে লুকিয়ে ছিল, যদি না থাকত তাহলে জীবনানন্দের পক্ষে জীবনানন্দ হওয়া সম্ভব ছিল না। ছ. জীবনানন্দ ‘বোধ’কে আবিষ্কার করলেন, করলেন বোধহীনতাকেও। জ. জীবনানন্দের পরে যে বাংলা কবিতা, তার আর কোনো দিক থেকেই ফেরার পথ রইলো না। একটিমাত্র আঘাতে সমগ্র বাংলা কবিতাকে, সমগ্র বাংলা সৃজনশীল সাহিত্যকে এমন সজাগ করে দিলেন- বহুদূর পর্যন্ত এমন আত্মবিশ্বাসী করে তুললেন যে আর কেউই কোনো বড় কবি বা লেখকের অন্ধ অনুকরণ করবে না। ঝ. যে ভাঙে, তাকে একা হতে হয়। ঞ. যার মূলকেন্দ্র ছিল মানুষ। মানুষের অতীত, মানুষের ভবিষ্যৎ, মানুষের বর্তমান। মানুষের দুর্ভাগ্য, মানুষের অমীমাংসিত মহা ইতিহাস। অরুণেষ ঘোষের ভাষা আবেগময় অথচ যুক্তি সংহত। তিনি যখন বলেন জীবনানন্দ ধূসর পা-ুলিপিতে জন্ম নিয়েছেন কিন্তু পূর্বশর্ত ছিল ঝরা পালক। তা মানতে আমাদের সন্দেহ হয় না। কারণ প্রত্যেক সৃষ্টিতত্ত্বের একটি প্রাথমিক অবস্থা থাকে। ঝরা পালকএ একটি ‘নীলিমা’ কবিতা থেকেই ধূসর পা-ুলিপির ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতার জন্ম। কারণ চিত্রকল্প ব্যবহারের রীতিতে কবিতার যাত্রা এভাবেই বৈশিষ্ট্য আকারে এক কাব্যগ্রন্থ থেকে অন্য কাব্যগ্রন্থে প্রবাহিত হয়। রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে জীবনানন্দের কাব্যশিল্পের বিষয়ে যে মন্তব্য তার উত্তরও খানিকটা দেন এই সমালোচক। রবীন্দ্রনাথ ঝরা পালক পড়ে তাঁর বাইরে অন্য কবিতার যাত্রাকে কীভাবে গ্রহণ করেন এবং ধূসর পা-ুলিপির যাত্রাকে না দেখেই বড় সমালোচনা করেন যেখানে এ দুটি বিষয় দ্বান্দ্বিক হয়ে যায়। সুধীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী বা আবু সয়ীদ আইয়ুবরা তখন বেশ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাই, জীবনানন্দের নতুন কবিভাষা তাঁরা সহজেই গ্রহণ করতে চাননি। গল্পের আখ্যানে জীবনানন্দ তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করেন যা লাবণ্য দাশের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এ সত্যটি অরুণেষ ঘোষের মতো আরো অনেক সমালোচকই বলেছেন। জীবনানন্দ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর পরবর্তী কবি-সাহিত্যিক সত্যিকারভাবেই মিডিয়ার ব্যাপারে সচেতন হন। এ ধারা এখনো বহমান। মিডিয়ার চাতুর্যের প্রতি দৃষ্টি থাকলে সচেতন হতে সময় লাগে না এবং বাণিজ্যের পদ্ধতি লেখকসত্তার মধ্যে ঢুকে যায়। সমালোচক তীক্ষè বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গির একজন এটি বুঝতে আমাদের দেরি হয় না। বিভূতিভূষণ ও জীবনানন্দকে পর পর পাঠ করেন সমালোচক। এর মধ্যে বিভূতিভূষণে আগে। কিন্তু জীবনানন্দকে পড়ার পরই তার বোধোদয় হয় জীবনানন্দে যে ‘বোধ’ তা বিভূতিভূষণে নেই। এই ‘বোধ’ আধুনিক সাহিত্যের জন্মকে নির্দিষ্ট করেছিল। এটি আপেক্ষিক এবং বিশেষ সৃষ্টিলগ্নে যুক্তিযুক্ত। জীবনানন্দের বোধ যেমন চিন্তাকে চেনায় তেমনি চিন্তাহীনতাকেও চেনায়। তাঁর মাধ্যমেই অনুপ্রেরণা আসে যাতে কেউ আর অন্ধ অনুকরণ না করে। বিশ্বাসযোগ্য সমালোচনার কারণ জীবনানন্দ অন্ধ অনুকরণ করেননি। ভাঙার কাজ যে নেয় সে সত্যিই বড় একা হয়। কারণ, ভাঙতে গেলে হাজার বাধা আসে। বাধার মুখে অগ্রসর হওয়া কঠিন। জীবনানন্দ বাঁক নিয়েছিলেন ‘আধুনিকতার নবযাত্রা’য় তাই তাঁর প্রতিষ্ঠার পথে যে বাধা ছিল তাকে তিনি জয় করেছেন সৃষ্টি দিয়েই। প্রতিষ্ঠা সে অর্থে বাস্তবিকভাবে হয়নি। কিন্তু তাঁর যুদ্ধ থামেনি। তাই তিনি একাকী হয়েও জয়ী। আজকের জীবনানন্দ দাশকে ঘিরে এত আগ্রহ মূলগতভাবে সেজন্যই। যে মানুষকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন সৃষ্টিকর্মে তার মধ্যেই তাঁর অমরতা। ২. রবিশংকর বল পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন গ্রন্থে প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প ইত্যাদির অপূর্ব সংস্করণে একটি নতুন স্বাদে জীবনানন্দকে উপস্থাপন করা হয়েছে? ক. জীবনানন্দ দাশ এভাবেই তাঁর রচনাগুলোকে প্রতিরোধহীন রেখে যান। এই রচনাগুলোকে সংরক্ষণের জন্য চিঠিপত্র, সাক্ষাতকার, ডায়েরিতে তিনি নির্দিষ্ট কোনো সিস্টেম তৈরি করেন না। যা রবীন্দ্রনাথে আছে, জীবনানন্দের সমসাময়িক লেখকদের ক্ষেত্রেও কমবেশি আছে। অর্থাৎ এই সিস্টেম তৈরি করা। খ. কেন্দ্র ও কিনার, সুস্থতা ও অসুস্থতা। এবার এই ধারণাগুলোকে ইন্টারোগেট করো। খনন করো প্রতœভূমি। দ্যাখো, এইসব ধারণার পিছনে লুকিয়ে আছে কত গোপন কথা। গ. জীবনের কেন্দ্র=সাফল্যের ইতিহাস=তত্ত্ব= ক্ষমতা জীবনের প্রান্ত=ব্যর্থতার আখ্যান=গল্প= আনন্দচেতনা জীবনানন্দের লেখালেখি থেকেই শুরু হয়ে যায় রচনার এক নতুন প্রবাহ জীবনের কেন্দ্র থেকে কিনারে যাওয়ার আখ্যান। যে কোনো মূল্যে বেঁচে থাকার জন্য সমঝোতার পথে যেতে চায়নি নিশীথ, সুতীর্থ, মাল্যবানরা। ইতিহাসের রাজপথের পাশে ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। নিজেদের নক্ষত্রের দোষে। ঘ. তোমার মনে আছে কমল কুমার মজুমদারের সেই শব্দবন্ধটির কথা? ‘ব্যাখ্যাকাংলা’। যারা সবকিছুর ব্যাখ্যা চায়, তড়িঘড়ি বুঝে ফেলতে চায়। কিন্তু জীবন কোনো তর্ক নয় যে কথার পিঠে কথা জমে উঠবে, আর তাতে ভুল থাকবে না। রচনা জীবনেরই সম্প্রসারণ। না, প্রতিফলন নয়। জীবন ও রচনা যেখানে আলাদা, একমাত্র সেখানেই প্রতিফলকের তত্ত্ব জয়ী হতে পারে। বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দের রচনাক্রিয়ায় এই প্রতিফলনতত্ত্ব খারিজ হয়ে গেছে। আর দূর হতে দেখা নয়। দৃশ্যের ভিতরেই সংস্থিত দ্রষ্টা। তিনি অভাবনীয় এক সত্য আবিষ্কার করেন যা হলো মৃত্যুচিন্তা বিষয়ক কিন্তু জীবনেরও অংশ। মৃত্যু সেই প্রান্ত, যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলি। আধুনিকতা এই মৃত্যুচেতনাকে জানে না। এই মৃত্যুচেতনা, যা এক মহাবিশ্ব চেতনার অংশ। বাস্তবিক ‘ঝুংঃবসধঃরপ ঞযবড়ৎু’ থেকে বাইরের মানুষ জীবনানন্দ দাশ। প্রথাগত সিস্টেম তাই জীবনানন্দে মেলে না। সমালোচনার সচেতনতা এই গভীর বিষয়টিকে তুলে এনেছে। জীবনের কেন্দ্র ও কিনারের ভেতরের ‘গোপন কথা’-তে ব্যর্থতা যার হাহাকার বেশি। কার মনের কথা কে জানে এটি খুবই গোপনীয় বিষয়। একে ‘ওহঃবৎৎড়মধঃব’ করার ক্ষমতা সবার থাকে না যা জীবনানন্দ করেছেন। জীবনের ‘কেন্দ্র’ থেকে যে কাহিনীর শুরু হয় তা আর লিখতে চাননি কারণ কেন্দ্রের দিকে বেশি কষ্ট থাকে। কেন্দ্র থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রান্তের আবির্ভাব। প্রান্তকে মনে করলে জীবনে মৃত্যুচেতনা ব্যতীত আর কিছু থাকে না। একে ‘মহাবিশ্বচেতনা’ বলেন রবিশংকর বল যা বিজ্ঞানচেতনারও অংশ। একে ঈড়ংসরপ গড়ষফও বলা হয়। সমালোচক কমলকুমারের ‘ব্যাখ্যাকাংলা’ প্রত্যয়টি তুলে তত্ত্বাশ্রয়ী বা ব্যাখ্যা খোঁজা সমালোচনাকে অহেতুক সম্প্রসারণের সমস্যা বলেছেন। জীবনানন্দে ‘প্রতিফলন তত্ত্ব’ খারিজ হয়ে জীবনেরই সমগ্র রূপে তাঁর রচনাভা-ারকে ব্যাখ্যা করেন। সমালোচনার ক্ষেত্রে রবিশংকর বলের এ যাত্রা পূর্বের অনেক প্রথাবদ্ধতাকেও খারিজ করে দেয়। ৩. আধুনিকতাবাদ ও জীবনানন্দের জীবনোৎকণ্ঠা গ্রন্থে প্রশ্নের আকারে সমালোচনা ও বিতর্কের পথ খুলে দেন আবুল কাসেম ফজলুল হক। সংক্ষেপে গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসাগুলো- ক. যিনি মানুষ হিসেবে দুর্বল, কবি হিসেবে তিনি কি শক্তিশালী হতে পারেন? শুধু কবিতার কথা কেন? তাঁর গল্প-উপন্যাসে যদি তাঁর আত্মজৈবনিক ভিত্তি খোঁজ করা হয় তাহলে সেখানেও কি জীবনানন্দকে শক্তিশালী মনে হয়? খ. জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসে ভোগের বাসনার সঙ্গে মূল্যবোধ ও নৈতিক চেতনার উপলব্ধি দুর্লভ। গ. ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ আর ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ দুটি কবিতাতেই কুৎসিত, কদর্য, বীভৎস, দুঃসহ, মনুষ্যত্ববৈরী-শ্বাসরুদ্ধকর বাস্তবের এক বিস্ময়কর রকম সুন্দর সংক্ষিপ্ত চিত্ররূপ আমি প্রত্যক্ষ করেছি এবং যতবার আমি এসব কবিতা পড়েছি ততবারই আমার মনে অপশক্তির বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভ ঘনীভূত হয়েছে। ঘ. জীবনানন্দকে নৈরাশ্যবাদী বলতে আমার দ্বিধা হয়েছে, আজও হয়। চিন্তা-চেতনার দিক থেকে তাকে প্রগতিশীল বলবার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না। রক্ষণশীল চেতনার, জীবনের বিকার-বিকৃতির ও অবক্ষয়ের অদ্বিতীয় রূপকার তিনি। ঙ. ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যে জীবনানন্দ যেন কবিতা নয় নিজের জন্যই লিখে রেখে গেছেন এক একটি সমাধিলিপি। চ. কাব্যজগতের বা পরিবেশের প্রভাব আর স্নায়ুম-লীর সক্রিয়তা ছাড়া কি কারো মধ্যে কোনো বোধ জন্ম নিতে পারে? ছ. আমরা তাঁর জীবনের দুঃখের সংবাদ জানি না। কোনো দিন জানতে পারব কি? আধুনিকতাবাদীদের নিছক দুঃখবাদী কিংবা বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমাদের পরিতৃপ্ত করে না। সমালোচক পুরো গ্রন্থে এত বেশি প্রশ্ন করেছেন যে উত্তরের দিকটি তার মনোযোগে আসেনি। সমালোচনার ধারায় এটি এক প্রতিবন্ধকতা। হতে পারে প্রশ্নগুলো ভবিষ্যৎ সমালোচকদের প্রতি কিন্তু তিনি প্রশ্ন করে যাচ্ছেন গতিময় ভঙ্গিতে। যে তথ্য ও জানার ব্যাপ্তিতে প্রশ্ন করেছেন তাতে ফাঁকি আছে। শেষে উদাহরণটিতে সমালোচক স্বীকার করেন তিনি জীবনানন্দের জীবনের দুঃখের সংবাদ জানেন না। কোনোদিন জানবেন কি না তাও অনিশ্চিত। বিস্ময়ের ব্যাপার না যে তিনি না জেনেই সমালোচনায় এসেছেন। পূর্বসূরিদের কিছু অসৎ সমালোচনা তিনিও করে যান। লাবণ্য দাশ মানুষ জীবনানন্দ গ্রন্থে বলেন ‘ছাইচাপা আগুনের ভিতরেই জীবনানন্দের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে থাকত’। অকারণে নিজেকে প্রকাশ করতেন না। আবুল কাসেম ফজলুল হক মানুষ হিসেবে দুর্বল ভেবে জীবনানন্দকে কবি হিসেবেও দুর্বল ভাবেন। গল্প-উপন্যাসের শক্তির প্রসঙ্গ তাঁর সমসাময়িক সমালোচকের অনেকেই প্রমাণ করেন। শক্তি আছে কি না আগামীতে আরও প্রমাণ হবে। তিনি গল্প-উপন্যাসে নৈতিক চেতনা ও মূল্যবোধজনিত অনুপস্থিতির কথাও বলেন অথচ গল্প-উপন্যাসে চরিত্রের মাধ্যমে যে মানসিকতার দ্বন্দ্ব ফুটে ওঠে তাতে নৈতিক মূল্যবোধজনিত সংকটকে তুলে ধরা হয়েছে। ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে সমালোচক পরে জীবনানন্দকে নৈরাশ্যবাদী, রক্ষণশীল ও বিকার-বিকৃতির রূপকার বলেছেন। এ সমালোচনায় লেখকের রক্ষণশীলতা বিদ্যমান। বইটি পাঠের সময় বইটিতে জীবনানন্দের প্রতি সমালোচক অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ হয়েছেন। তিনি জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবন নিয়ে নেতি ধারণা পোষণ করেন। যার কারণে তাঁর সমালোচনা একমুখী প্রবাহে নেতি হয়ে ওঠে। ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতা ভয়ংকর সুন্দর রীতিতে বিশ শতকীয় ঔপনিবেশিক সমাজবাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে যার বিস্তৃতি আজকের পৃথিবীতে বহমান এবং ভবিষ্যতের রূপ আরো ভয়ংকর হতে যাচ্ছে। যে প্রগতির কথা সমালোচক বলেন সে প্রগতি এই কবিতার বিষয় নয়। তিনি বিষয় না বুঝে সব কবিতার আদলেই জীবনানন্দকে বিকার বিকৃতির রূপকার বলেন। আশাবাদিতার কবিতা জীবনানন্দে প্রচুর। যেমনÑ ‘নাবিক’, ‘সময়ের কাছে’, ‘প্রতীতি’, ‘মৃত্যু স্বপ্ন সংকল্প’ প্রভৃতি। ‘রূপসী বাংলা’কে বলেন ‘সমাধিলিপি’। ভাষায় ‘যেন’ ব্যবহার করে নিজস্ব চেতনাগত বিভ্রান্তিকে বড় করে তোলেন। ‘রূপসী বাংলা’র প্যাস্টোরাল পরিবেশকে তিনি এড়িয়ে যান এবং তাতেই তিনি এ কাব্যগ্রন্থের মূলগত স্বরকে মানতে চান না। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা স¤পর্কে সমালোচক ‘বাহ্য জগতের পরিবেশগত প্রভাব ও স্নায়ুম-লীর সক্রিয়তা’র অভাব লক্ষ করেন। সমালোচকের এ মন্তব্য আমাদের হতাশ করে। একটি উদাহরণ দেখে নেয়া যাক- জানি-তবু জানি নারীর হৃদয়-প্রেম- শিশু গৃহ -নয় সবখানি; অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে। এখানে- বাহ্যজগতের উপাদান- নারী, শিশু, গৃহ, অর্থ। স্নায়ুম-লীর সক্রিয়তা- হৃদয়, প্রেম, রক্ত। কবিতায় অনেক ঘটনাপ্রবাহের পর শেষ পর্যন্ত মানব জীবনের গূঢ় রহস্যকে ‘বিপন্ন বিস্ময়’ রূপে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বাহ্য উপাদান নারী, শিশু, গৃহ, অর্থ ইত্যাদির প্রভাবে মানুষের অনুভূতির জগৎ সঞ্চারিত হয় এসবের প্রভাবে। প্রেম বা হৃদয়কে অনুভব করেও সে রহস্য আরো গভীরের সংজ্ঞার্থে ‘বিপন্ন বিস্ময়’কে তুলে ধরা হয়েছে। এই ‘বিস্ময়’ মানুষের ‘রক্তের ভিতরে’ খেলা করে। ‘রক্ত’ সেই ¯èায়ুর আধার। সমালোচক এই ‘বোধ’কে দেখতেই পাননি। ৪. পিয়াস মজিদ তাঁর করুণ মাল্যবান ও অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থে প্রথাগত সূত্রেই বিরাট মাত্রায় সমালোচনার পথে হাঁটেন। তিনি জীবনানন্দ দাশের ওপরে এক পৃষ্ঠার কিছু বেশি আকারের একটি প্রবন্ধ লেখেন। সবশেষে তিনি একটি মন্তব্য করেনÑ আমার জীবনানন্দ জগতের যাবতীয় সুতীর্থে খাপ না খাওয়া এক করুণ মাল্যবান মাত্র। ভাষার ব্যবহার এখানে ‘ফরধষবপঃ’ ভঙ্গির। যে মন্তব্য শেষ পর্যন্ত আসে তা শেষ হয়ে যায় একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে। জীবনানন্দের সমসাময়িক সমালোচনাতেও এরকম উদাহরণ সুপ্রচুর ছিল। জীবনানন্দকে সমালোচক ব্যক্তিক উপলব্ধি থেকে দেখেছেন। ব্যক্তি জীবনানন্দকে উপন্যাসের চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে সিদ্ধান্তে আসেন। যে সিদ্ধান্তটিকে আমরা পাই তা হলো ‘মাল্যবান’ রূপেই সমালোচক জীবনানন্দের মূল্যায়ন করেন। এ মূল্যায়নটি দুঃখবাদী। অর্থাৎ জীবনানন্দ তাঁর কাছে মাল্যবানের মতই করুণ। কিন্তু মাল্যবানকে তিনি ‘করুণ’ রূপে দেখে জীবনানন্দ দাশের যাবতীয় সুতীর্থে খাপ না খাওয়ার কথাও তোলেন। যেখানে ‘সুতীর্থ’ শব্দটি ‘সু’ ও ‘তীর্থ’ অনুসারে আলাদা অর্থ প্রদান করে। সমালোচকের ধারণায় ঠিক সেটিই বদ্ধমূল হয়েছে। প্রবন্ধের প্রথমে তিনি যে সিদ্ধহস্ত মনোভাব দেখান পরে শেষের দিকে তা আর রক্ষা করতে পারেন না। কারণ জীবনানন্দকে তিনি ভালোমতো পাঠ করেননি। জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবন, সাহিত্যজীবন, সমালোচনার সূত্র ইত্যাদি অনুসারে যাবতীয়ভাবে তিনি পাঠ করার ক্ষেত্রে অনেক দূরে অবস্থান করেন। তিনি যেহেতু জীবনানন্দ স¤পর্কে চূড়ান্তভাবেই বলেছেন সেখানে জানা ও উপলব্ধিও সেরকম হওয়া উচিত। সমালোচনার ক্ষেত্রে আমরা এ প্রতিবন্ধকতা প্রায়ই লক্ষ করি। ৫. ‘বনলতা সেন’ কবিতার যুগোপযোগী নতুন বিশ্লেষণে শামীম রেজার ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ প্রবন্ধটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কবিতার কাল এবং উপস্থাপনাগত নবপর্যায় একজন সমালোচকের কাছেই পাঠক আশা করেন। তাঁর সমালোচনায় বনলতা সেন কবিতার কিছু বিশ্লেষণকে দেখে নেয়া যাক । সমালোচনার ধারা ও জীবনানন্দ দাশ ক. আধুনিকতার জন্ম সংশয়, ক্লান্তি আর নিরাশার মধ্যে আশা আর বিস্ময়ের সংগীতকে বহন করে। আধুনিক নারী, ‘প্রেমিককে’ দুদ- শান্তি দিতে পারেন- এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। খ. ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’ তখন এই ‘আমি’র স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে হয় প্রথমেই ১. পাঠক অর্থাৎ যিনি পড়ছেন ২. কবি নিজে (জীবনানন্দ) ৩. প্রেমিক ‘আমি’ ৪. বোদলেয়ার কথিত ঐতিহাসিক ও জীনের ধারাবাহিকতায় সৃষ্ট ‘আমি’ ৫. সর্বভারতীয় ‘আমি’ ৬. ঔপনিবেশিক ‘আমি’ ৭. বিশ্বসভার এই ‘আমি’ সমালোচকের সততা, সচেতনতা, নির্বাচন ক্ষমতা সবই এ সমালোচকের আছে। সমালোচক প্রথমেই আধুনিকতার নামে নিরাশার বিপরীতে আশাবাদিতার কথা বলতে বেশিরভাগ সমালোচক যে উদ্বাহু থাকেন তাঁদের সংশয় দূর করেন। বোদলেয়ার আধুনিক কবিতার সর্বোত্তম কবিপুরুষ। তিনি প্যারিস স্বপ্লীন এ যে ‘অদ্ভুত অচেনা মানুষ’ কে পরিচিত করান তাঁর কেন্দ্রে আছে জমাটবদ্ধ নিরাশা, ক্লান্তি, দুঃখ বা ক্ষোভ। নইলে তিনি বলতেন না Ñ আমি ভালোবাসি মেঘ......... চলিষ্ণু মেঘ...... ঐ উঁচুতে.... ঐ উঁচুতে... আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল। [অদ্ভুত অচেনা মানুষ, শার্ল বোদলেয়ার] এ কবিতার যে উৎস সেই ‘ঝঢ়ষববহ’ বিষয়টির অর্থ হয় শারীরিক বৈকল্য থেকে জাত বিষাদ। বোদলেয়ার আধুনিকতাবাদের সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করেও হচ্ছেন ‘অদ্ভুত অচেনা মানুষ’-এর মতো বিশ্বখ্যাত কবিতার রচয়িতা। সেখানে বনলতা সেন এর স্থানও এ সূত্র থেকে উদ্ভাবিত আধুনিকতার বিষাদ। সমালোচকের সচেতনতা আমাদের আশান্বিত করে তোলে। কবিতার একজন পাঠক হয়ে, সমালোচক হয়ে এক ‘বনলতা সেন’-এর কথক ‘আমি’-কে সমালোচক ভাগ করেন নান্দনিক দৃষ্টিতে। ‘আমি’র এতরূপ কবিতাপাঠের সঙ্গে আলাদা ক্ষেত্র অনুসারে কবিতাটিকে আকর্ষণীয় এবং যুগোপযুগী করে তোলে। সমালোচনার এমন বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গিকে পাঠ করার যথার্থ স্ফুরণরূপে আমরা দেখি এবং আশান্বিত হই। শামীম রেজা ‘বনলতা সেন’-এর সঙ্গে এডগার অ্যালান পো’র কবিতার সাদৃশ্য প্রসঙ্গেও কথা বলেন। বৈপরীত্যও তিনি দেখান। এ প্রসঙ্গে ‘জীবনানন্দ ও ভূমেন্দ্র গুহ’র একটি পরিচিত কথোপকথন দেখে নেয়া যায়Ñ ভূমেন্দ্র গুহ : লোকে বলে, আপনি নাকি ‘বনলতা সেন’ কবিতাটা এডগার অ্যালন পো’র ‘ঞড় ঐবষবহ’ কবিতা থেকে মেরেছেন, ‘হায় চিল’ কবিতাটার সঙ্গে নাকি ইয়েটসের ‘ঐব ৎবঢ়ৎড়াবং ঃযব পঁৎষব’ির মিল আছে? জীবনানন্দ দাশ : তুমি কি কুম্ভীলকবৃত্তির কথা বলছো? ভূমেন্দ্র গুহ : তা না, লোকে বলে। জীবনানন্দ দাশ : তুমি যে সমাজে বাস করো, সে সমাজের ভাষাও তোমার জিভে চলে আসে। তুমি বাংলা ভাষায় কেন কথা বলো? ছেলেবেলায় তুমি বাঙালি সমাজে বড় হয়ে উঠেছো। অতএব, বাংলা ভাষা তোমার জিভে আছে। তুমি যদি এডগার অ্যালান পো’র, ইয়েটসের, কীটসের বা এলিয়টের সমাজে বাস করো, তোমার জিভে কী ভাষা আসবে? সেই ভাষাই চলে আসে জিভে। তাকে কুম্ভীলকবৃত্তি বলে না। অর্থাৎ স্থানিক তাৎপর্যে কবি যে ভাষায় কবিতা লেখেন বিশেষভাবে বা কবির অগোচরে তাঁর সে ভাষা অন্য কোনো স্থানিক ভাষার কবির ভাষার সঙ্গে মিলে যেতে পারে। কিন্তু তা তাঁরা উভয়েই নিজ ভাষায় স্বতন্ত্র সময়ে লিখেছেন। এটি তাদের নকল নয়, বরং একক সৃষ্টি। জীবনানন্দ ‘বনলতা সেন’-এ তাই করেছেন। শামীম রেজা ঐ কথাটাই বলেন। সমালোচকের এ সচেতনতা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। সমালোচনার দিক থেকে জীবনানন্দের সমসাময়িক থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত পরিবর্তনশীল মানসিকতার ছাপ আমরা দেখতে পাই। সমালোচনাকে আমরা কীভাবে গ্রহণ করব এ সংক্রান্ত মননশীলতার পরিচয় দিয়ে সাম্প্রতিককালের সমালোচকরা নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে পুনরায় বিচার-বিশ্লেষণ করেন। সমালোচনাও যে শেষ পর্যন্ত সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে সমালোচনার ধারায় কোনো কোনো সমালোচকের লেখায় তা বোঝা যায়। জীবনানন্দ দাশের একটি সমালোচনা এ সূত্রে আমাদের নজর কাড়বে Ñ আচ্ছা, এত যে লিখেছি, একটিও কি সুপ্রিম পোয়েট্রি হয়নি? যা আমার মৃত্যুর পর বেঁচে থাকতে পারে। জীবনানন্দ নিজেই তাঁর কাব্যসম্ভার স¤পর্কে সুবোধ রায়কে একথা বলেন। সুবোধ রায় কবিকে বলেন, ‘আপনার সুপ্রিম পোয়েট্রির কী অভাব আছে?’ তাঁর মতে ‘কবির এ সামান্যতম সাধ প্রকাশেও কত দ্বিধা’, এই দ্বিধাই আজকের আধুনিক যুগের সাহিত্যিক, সমালোচকদের জন্যও আদর্শ। নিজেই সবচেয়ে বড় সমালোচক হয়ে কাব্যবিচারে ‘সুপ্রিম পোয়েট্রি’-র আশা যিনি করেন তাঁর মধ্যে মহৎ সাহিত্যের গুণাবলি অনায়াসে চলে আসে। বিনয় বা প্রকাশের সরলতায় এত জটিল বিষয় শেষ পর্যন্ত বড় এক ধরনের সমালোচনাও হয়ে যায়। জীবনানন্দ দাশের সামগ্রিক সাহিত্যকীর্তিতে আজকের সমালোচনায় সমালোচকরা নতুন ধারার প্রর্বতন করবেন এটি আশা করা যুগ ও মনের দাবি।
×