ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অভিযোগ রোগী ও অভিভাবকদের

হাসপাতালের খাবারে অর্থ বরাদ্দ বাড়লেও বাড়েনি মান

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২২ অক্টোবর ২০১৫

হাসপাতালের খাবারে অর্থ বরাদ্দ বাড়লেও বাড়েনি মান

নিখিল মানখিন ॥ সরকারী হাসপাতালে রোগীর খাবারে অর্থ বরাদ্দ বাড়লেও মান বাড়েনি। রোগী ও তাদের অভিভাবকরা এমন অভিযোগ তুলেছেন। তারা অভিযোগ করেন, রোগীর খাবারের জন্য বরাদ্দ অর্থ নানা উপায়ে বিভিন্ন স্তরে কারচুপি হয়ে থাকে। হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে শুরু করে কয়েক পর্যায়ে নানাভাবে এ লুটপাটের কাজ চলে। রোগীর তালিকা বাড়িয়ে দেখানো হয়। নিম্নমানের খাবার উপকরণ ক্রয় করা হয়। ডালের সঙ্গে বেশি পানি মেশানো থাকে। নির্ধারিত পরিমাণের এক টুকরো মাংসকে করা হয় কয়েক টুকরো। তবে সরকারী হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারী বাজেটের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। পুরনো বাজেট দিয়ে ভালমানের খাবার দিতে বর্তমানে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন অবস্থার মধ্যেও রোগীদের জন্য ভাল খাবার দেয়া হয়ে থাকে বলে দাবি করেন রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতালের কর্মকর্তারা। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে দুইবার বেড়েছে রোগীর খাবারের অর্থ বরাদ্দ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রতি রোগীর খাবারের জন্য বর্তমানে দৈনিক বরাদ্দ ৭৫ টাকা। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এ বরাদ্দ ছিল মাত্র ৪৫ টাকা। প্রতি রোগীর খাবার বাবদ ৪৫ টাকা থেকে ৭৫ টাকায় উন্নীত হয় গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। পরবর্তীতে গত ২০১৩ সালে হাসপাতালগুলোতে খাবারের মান বাড়াতে শয্যাপ্রতি দৈনিক বরাদ্দ ৫০ টাকা বৃদ্ধি করে আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে সরকারী হাসপাতালে খাবার বাবদ প্রত্যেক রোগীর জন্য দৈনিক বরাদ্দ বেড়ে এখন ১২৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সরকারী হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়েই চলেছে। সেই তুলনায় অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করে, হাসপাতালে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬শ’ রোগীকে চার বেলা খাবার দিতে হয়। প্রত্যেক রোগীকে সকালে ৪ পিস রুটি, ১টি ডিম, ১টি কলা ও ৫ গ্রাম জেলি দেয়া হয়। দুপুরে দেয়া হয় ভাত, মাংস, সবজি ও ডাল। বিকেলের নাস্তার তালিকায় থাকে চা-বিস্কুট অথবা রুটি ও কলা। আর রাতের খাবার তালিকায় থাকছে মাছ, ১টি ডিম, সবজি ও ডাল। প্রত্যেক রোগীকে এ সব মেনু দিতে হচ্ছে ১২৫ টাকায়। রোগী প্রতি দৈনিক বরাদ্দ ১২৫ টাকা থেকে ২শ’ টাকা করার দাবি জানিয়ে হাসপাতালের কর্মকর্তারা জনকণ্ঠকে বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। দৈনিক ১২৫ টাকায় একজন রোগীকে তিন বেলা মানসম্মত খাবার দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মানসম্মত খাবার না দিলেও রোগী ও অভিভাবকদের সমালোচনায় পড়তে হয়। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এমন কোন ফান্ড নেই, যা থেকে এ ভর্তুকি দেয়া যায়। সরকারের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। নির্ধারিত শয্যা সংখ্যার বাইরে চিকিৎসাধীন ২শ’ থেকে ৩শ’ রোগীকেও খাবার ও ওষুধপথ্য সরবরাহ করা হয়। এর আগে অতিরিক্ত রোগীদের খাবার সরবরাহ করা হতো না বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে তালিকাভুক্ত খাবারের মান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবিকৃত মানের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি। একই অবস্থা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও। ঢামেক কর্তৃপক্ষ জানায়, রোগীপ্রতি বরাদ্দ ১২৫ টাকায় মানসম্মত খাবার দেয়া হচ্ছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় ২৫শ’ রোগীকে চার বেলা খাবার দিতে হয়। প্রত্যেক রোগীকে প্রতিদিন সকালের নাস্তা হিসেবে ৫ পিস পাউরুটি, ১টি ডিম, ১টি কলা ও পায়েস দেয়া হয়। দুপুরে পরিবেশন করা হয় ভাত, মাছ, সবজি ও ডাল। বিকেলে দেয়া হয় ছোট প্যাকেটের বিস্কুট এবং রাতের খাবারের তালিকায় থাকে ভাত, মুরগির মাংস, সবজি ও ডাল। কিন্তু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবিকৃত অবস্থার বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতাল নয়, রাজধানীর সব সরকারী হাসপাতালেই রোগীর খাবারের মান কমে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। রোগীপ্রতি অর্থ বরাদ্দ নয়, খাদ্যের ক্যালরি হিসাব করে বাজেট তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছেন ডক্টরস ফর হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ রশিদ-ই-মাহবুব। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, রোগীর খাবারের মান যেকোন উপায়ে বজায় রাখা উচিত। মানসম্মত খাবার দেয়ার বিষয়টি দেখবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়। বিদ্যমান বাজেটে মানসম্মত খাবার দিতে না পারলে, মন্ত্রণালয় বরাবর বরাদ্দ বৃদ্ধির আবেদন জানাতে পারে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল। নতুন অর্থবছর শুরু হওয়ার অপেক্ষায় থাকলে রোগীদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলে মনে করেন অধ্যাপক ডাঃ রশিদ-ই-মাহবুব। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা জনকণ্ঠকে জানান, সরকারী হাসপাতালের রোগীদের খাবারের পেছনে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়া থাকে। খাদ্যের ক্যালরি হিসাব করে খাবারের তালিকাও নির্ধারিত হয়ে থাকে। অনেক মানুষের জন্য রান্নাকৃত খাবারের মান বাড়ির খাবারের তুলনায় কিছুটা নিম্নমানের হতেই পারে। তবে এটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাকৃত অপরাধ হতে পারে না। রোগীদের খাবার নিয়ে কেউ কারচুপি করতে পারেন না। খাবারের মান তদারকি করার জন্য আলাদা টিম কাজ করে বলে দাবি করেন তারা। সরেজমিন জানা গেছে, সরকারী হাসপাতালগুলোতে সরবরাহকৃত খাবার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব হাসপাতালে যারা খাবার সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের পকেটেই চলে যায় সিংহভাগ অংশ। আর এটি করা হয় প্রতি বছরের এ সংক্রান্ত টেন্ডারকালে। নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসব হাসপাতালে সরবরাহকৃত চালের মূল্য ধরা হয় প্রায় ৫০ টাকা। একইভাবে উন্নতমানের চিকন চালের কথা নথিপত্রে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তার দেখা মিলছে না সরকারী হাসপাতালের খাবারে। সরকারী হাসপাতালে নির্দিষ্ট বেডের অতিরিক্ত ভর্তি রোগীর জন্য কোন খাবার দেয়া হয় না। যে কারণে অনেক গরিব ও অসহায় রোগী ভর্তির পর বেড না পেলে তার জন্য হাসপাতালের খাবার জোটে না। এতে অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় ভর্তি রোগীদের।
×