ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুই বছরে খুন হয়েছেন তিন প্রগতিশীল মুক্তমনা লেখক

অসাম্প্রদায়িক ভারতের চরিত্র কী পাল্টে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২০ অক্টোবর ২০১৫

অসাম্প্রদায়িক ভারতের চরিত্র কী পাল্টে যাচ্ছে

নাজনীন আখতার ॥ অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভারতের চরিত্র কী পাল্টে দিতে যাচ্ছে সাম্প্রতিক দাদরি ঘটনা? সংখ্যার বিচারে একটি মানুষের মৃত্যু, কিন্তু প্রেক্ষাপট বিচারে তা যেন পুরো ভারতের মুখে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার কালি লেপন। বিশ্লেষকদের মতে, ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কোন নতুন ঘটনা নয়। শতাব্দী ধরেই দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর পরও ভারত মানেই অহিংস নেতা মহাত্মা গান্ধীর নামটিই সবার আগে উচ্চারিত হয়। এ কাতারে চলে আসে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম উদাহরণ জওয়াহর লাল নেহরুর নাম। তবে ভারতের উত্তর প্রদেশের গ্রাম দাদরিতে গরুর মাংস খাওয়ার গুজবে এক মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা, প্রতিবাদে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্তদের পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়া, স্বয়ং রাষ্ট্রপতির ক্ষোভ প্রকাশ, সঙ্গে সাধারণ মানুষের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ভারতকে বিশ্ব মানচিত্রে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আর পরিচয় দেবে কী না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উল্লেখ্য, গত ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের উত্তর প্রদেশের দাদরি গ্রামে ফ্রিজে গরুর মাংস রাখার গুজবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ৫০ বছর বয়সী মোহাম্মদ আখলাককে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষের প্রতিবাদে বিষয়টি রূপ পায় তুমুল রাজনৈতিক বিতর্কে। এর আগে গত ৩০ আগস্ট সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারজয়ী যুক্তিবাদী লেখক এসএম কুলবার্গ কর্নাটকে নিজ বাড়ির কাছে খুন হন। আট মাস আগে খুন হয়েছেন যুক্তিবাদী লেখক গোবিন্দ পানসার ও দুই বছর আগে খুন হয়েছেন নরেন্দ্র দাভোলকর। ওইসব হত্যার ঘটনায় সাহিত্য অঙ্গনে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছিল। দাদরির ঘটনা সে সবকে আরও উস্কে দিয়েছে। বিজেপি সরকার জোটের অন্যতম দল মহারাষ্ট্রের কট্টর হিন্দুত্ববাদী শিবসেনা দল পাকিস্তানী গজল শিল্পী গুলাম আলিকে মুম্বাইতে অনুষ্ঠান করতে দেয়নি। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ কসুরির একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানেরও বিরুদ্ধাচরণ করে শিবসেনা দল। অনুষ্ঠান বাতিল না করায় এর আয়োজক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সুধীন্দ্র কুলকার্নির মুখে কালি লেপে দেয়া হয়। মুখম-লে কালি নিয়েই সুধীন্দ্র ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ঘরে ফেরার নাম দিয়ে সংখ্যালঘুদের জোরপূর্বক হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করারও চেষ্টা চালাচ্ছে উগ্রপন্থীরা। এর পাশাপাশি সম্প্রতি নিম্নবর্ণের এক পরিবার বিচার চাইতে থানায় গিয়ে হেনস্থার শিকার হন। প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করে ওই পরিবারের পুরুষ ও নারীকে মারধোর করা হয়। চলমান এই সহিংসতার প্রতিবাদে ইতোমধ্যে ভারতে বিভিন্ন ভাষার ৪১ জন সাহিত্যিক সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেন। এসব সাম্প্রদায়িক ঘটনার মধ্যেও গরুর মাংস নিয়ে ভারতের হাজার হাজার কোটি টাকার লাভজনক বাণিজ্যও আলোচনায় উঠে এসেছে। বিবিসি, আনন্দবাজার পত্রিকা, আজকাল, তেহরান রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভারতের এই সাম্প্রদায়িক উগ্র চেহারার কঠোর সমালোচনার সংবাদ ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে। সেসব ঘটনায় গণমাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী চেতনার দল বিজেপির উস্কানি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীরবতাকে দায়ী করা হয়েছে। একাধিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা বেড়েছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৩৩০টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৩৩০টি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে দাঙ্গার ঘটনা ছিল ২৫২টি। বহুমতের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে ভারতের বিভিন্ন ভাষার ৪১ জন লেখকের সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়ার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন বিদেশী সাহিত্যিকরাও। ভারতীয় সাহিত্যিকদের পাশে দাঁড়ালেন আরও ১৫০টি দেশের কয়েক শ’ সাহিত্যিক। কালবুর্গি, নরেন্দ্র দাভোলকার, গোবিন্দ পানসারের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদিকে চিঠি লিখেছেন বিশ্বসাহিত্যিকদের সংগঠন পেন এ্যাসোসিয়েশন। ভারতে ক্রমেই কথা বলা এবং ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা হারাচ্ছেন শিল্পী, সাহিত্যিক থেকে সাধারণ মানুষ- এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ করার আর্জি জানিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এবং সাহিত্য একাডেমিকেও চিঠি লিখেছে এই সংগঠন। সম্প্রতি কানাডার কিউবেক শহরে আয়োজিত হয় পেন এ্যাসোসিয়েশনের ৮১তম সম্মেলন। সেখানেই ভারতে যুক্তিবাদীদের হত্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিদেশী সাহিত্যিকরা। সংবাদ বিশ্লেকদের মতে, গান্ধী-নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অসংখ্য ধর্মনিরপেক্ষ নেতা, কর্মী, বুদ্ধিজীবী ভারতে জন্ম নিয়েছিলেন। যে কারণে ভারত এত দিনব্যাপী ভারসাম্যহীন হয়নি। কিন্তু এখন হিন্দু মৌলবাদী সংঘ পরিবারের অপতৎপরতায় ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ভারতে খ্রীস্টান আর মুসলমানের সংখ্যা ২৫ কোটি। নিম্নবর্ণের হরিজনদের সংখ্যা ৩৫ কোটি। ১২০ কোটি লোকসংখ্যার ভারতের অর্ধেক লোক যদি বৈরী হয়ে যায়, তাহলে দেশেটির সংহতি রক্ষা হতে পারে না।
×