ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অজিত কুমার দত্ত

মা দুর্গার কাঠামো

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২০ অক্টোবর ২০১৫

মা দুর্গার কাঠামো

হিন্দুদের সর্ববৃহৎ এবং ব্যয়বহুল আনন্দঘন ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। সকল শক্তির আধার, সর্বভূতের অবস্থান, সৃষ্টি, রক্ষণ ও বিনাশের একমাত্র শক্তিকে মাতৃরূপে স্থাপন করে মনের সকল আকুতি দিয়ে ভক্তগণ সন্তানরূপে মায়ের অর্চনা করার আয়োজন করে। মন্দিরে মন্দিরে বেজে উঠছে শঙ্খধ্বনি. উলুধ্বনি। বাজছে শত তালে বাদ্যধ্বনি। মনে হচ্ছে ধরণী বুঝি পূর্ণ হলো মহাআনন্দে। এ যে মাতৃ মূর্তির কাঠামো। এর এক আধ্যাত্মিক দিক যেমন প্রকট, তেমনি বাস্তব বা দার্শনিক দিকও প্রকট। আজকাল আধ্যাত্মিক দিকটি যেমন অনেকাংশে উপেক্ষিত, তেমনি দার্শনিক দিকটি অজ্ঞাত, যার কারণ পূজা এখন আনন্দ-ফুর্তিসর্বস্ব হয়ে উঠেছে হিন্দু সমাজে। আজকাল পূজা মানে নতুন কাপড়-গয়নার কেনাবেচা। সাজসজ্জার আড়ম্বর। কিন্তু ভক্তির অধ্যাত্ম কম হয় না। দেবী দুর্গার পুরো কাঠামোতে থাকে ৮টি মূর্তি। এটি তার সংহতি শক্তি বা সকল শক্তির ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখানো এক রূপের স্থিতি। যেমন গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ তার এক অঙ্গে বিশ^রূপ দেখিয়েছিলেন। তেমনি সর্বশক্তি মায়েরও সেইরূপ এক কাঠামোতে পরিস্ফুটন করা হয়েছে। এবার দেবী কাঠামোর খুব সংক্ষিপ্ত একটু বর্ণনায় যাই। প্রত্যেক জাতি, দেশ, রাষ্ট্র চারটি শক্তির মাধ্যমে গঠিত হয় এবং প্রসার ও স্থিতি লাভ করে। এই চারটি শক্তি হচ্ছে জ্ঞান, ক্ষেত্র, ধন ও জনশক্তি। গীতাতে যাকে বলা হয়েছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র বর্ণরূপে। মূলত এ বিভাগ কোন ভেদ বা পৃথকীকরণ নয়, একের মধ্যেই যে এ চারের অবস্থান তাতেই দেখানো হয়েছে। দেবী দুর্গা কাঠামোতে জাতি ভেদ নয়, প্রকৃত প্রস্তাবে একই দেহে চারগুণের এক দেহে অবস্থিত চার শক্তির কথাই গীতাতে বলা হয়েছে। আমাদের স্বার্থপর ধর্মীয় প্রচারকরা গীতার কথা বাদ দিয়ে সুবিধার জন্য নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছে। গীতাতে আছে ‘... গুণ কর্ম বিভাগ...’। কাঠামোতে প্রধান রূপ মায়ের, মা দুর্গার/আধ্যাত্মিক রূপ হলো দুঃখ, দুর্গতিনাশিনী সর্বকল্যাণ কাম্য দশভুজা/মা এক কিন্তু অনন্ত অসীম সকল স্থাবর, সকল ভূতগণের স্থিতাবস্থা সর্বপালব্য বলে ‘০’ শূন্য ইনফিনিটি (অনাদি অনন্ত) বলে তাকে বোঝানোর জন্য ১-এর পিঠে ০ দিয়ে অনন্তের প্রকাশ ঘটানো হয়েছে।... সকল শক্তি থেকে সৃষ্টি সকল শক্তির আধার, একের মাঝেই সকল শক্তির আধার, একের মাঝেই সকল শক্তি নিহিত। সন্তানের শেষ আশ্রয় মা। সুখে-দুঃখে সব কিছুতেই মা, তাই তার রূপ মাতৃরূপ। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, মায়ের ওপর সন্তানের জোর বেশি খাটে, তাই মাতৃরূপে তার আরাধনাই হিন্দুদের কাছে অধিক প্রাধান্য। তাই মায়ের দশ হাত সর্বব্যাপিত্বের প্রতিনিধি। সন্তানের কল্যাণ কামনায় সব সময় মন্দের সাথে মা যেমন যুদ্ধরত, এখানে মন্দের রূপ অসুরের সঙ্গে মায়ের শক্তি আলাদা করে বর্ণনায় আসলে দেখা যায়। যেমন ১. শ্রী লক্ষ্মী ধনশক্তি মা- জগৎ পালিনা মা বিষ্ণু শক্তি, ২. শ্রীশ্রী সরস্বতী- মায়ের জ্ঞানের বা সাত্ত্বিকতার প্রতীক, ৩. শ্রীশ্রী গণেশ- গণদেবতা বা জনশক্তির রূপ/শূদ্র বর্ণ, ৪. শ্রীশ্রী কার্তিক- মায়ের ক্ষাত্রশক্তি পরাক্রমশালী চির তারুণ্য যুব শক্তি, ৫. সিংহ- হিংস্রতা, পশুত্ব এবং রজগুণের প্রতীক, ৬. অসুর- অহঙ্কার, কাম ও তমোগুণের প্রতীক। আসলে সকল শক্তির আধার মা। তাই পশু আর অশুভ (অসুর) শক্তিকে মা রেখেছেন পদতলে অর্থাৎ জগতে কোন ভাল কাজ করতে হলে মাকে যেমন প্রয়োজন দৈব ও কল্যাণ শক্তিরূপে, তেমনি প্রয়োজন ইষ্টলাভের জন্য হিংস্র পশুশক্তি ও অশুভ (কাম) ক্রোধ দম্ভ দর্প অজ্ঞানতাকে পদদলিত করা। মায়ের কাঠামোর ডান পাশে আছে কলাগাছ দিয়ে তৈরি কলা বৌ। আসলে শাস্ত্রগত দিক থেকে তাকে বলা হয় নবপত্রিকা। কারণ মা সন্তানকে পালনে যে সকল ঔষধিরূপে বিরাজ করেন তারই ইঙ্গিত। যেমন কদলী, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বেল, দাড়িম্ব, অশোক, মান ও ধান এই নয়টি। এদের একত্রে সাদা অপরাজিতা লতায় জড়িয়ে কলা বৌ সাজানো হয়। আজকাল দেবী পূজার নামে যে মন্দির, আলো, অপসংস্কৃতির আড়ম্বরের জš§ দেয়া হয়েছে তা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মহাশক্তির আরাধনার নামে পশুশক্তি (পেশিশক্তি) অসুর শক্তি (অশুভ শক্তি) জাগরণই বোঝায়। তবে তার মধ্যে ঐক্য বেশ প্রস্ফুটিত। এই ঐক্যকে যদি সুপথে পরিচালিত করা যায় তবে ক্ষাত্র শক্তির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে অশুভ অকল্যাণ থেকে নিত্য কল্যাণময়ী মাতৃশক্তি প্রভাবে এ মর্ত্যই হয়ে উঠবে মন্দাকিনী তীরে নন্দনকাননে শোভিত শান্তি ঐশ^র্যের লীলাভূমিদের রাজ্য। লেখক : শিক্ষক ও সমাজ সংস্কারক
×