ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম হাসান

মোবাইলে অতিকথন

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ১৯ অক্টোবর ২০১৫

মোবাইলে অতিকথন

কথায় কথায় প্রায়ই লোকজন বলে থাকেন, কথা বলতে আর তো ট্যাক্স লাগে না। কথা বললে সরাসরি ট্যাক্স লাগে না, কথাটি সত্যি, কিন্তু তাই বলে কি কথার কোন মূল্য নেই, কথার কোন খরচ নেই। অবশ্যই আছে। কথার মূল্য বিষয়টির অর্থ ব্যাপক। আমরা সবাই জানি বিদ্বান লোকের কথা কত মূল্যবান, কত শিক্ষণীয়। একজন দেশপ্রেমিক নেতার কথায় কিভাবে মানুষ জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধর্মগুরু বা ধর্মীয় নেতার কথায় মানুষ কিভাবে বদলে যায়। আবার অসংযত কথায় কত অনাসৃষ্টি, কলহ-বিবাদের জন্ম দেয়। কথার কারণেই মানুষ বিব্রত হয় আবার কথার কারণেই মানুষ প্রসংশিত হয়। কথার কারণেই শত্রুতা সৃষ্টি হয়, আবার কথাতেই ভালবাসার জন্ম হয়। কখনও কখনও অতি কথনে কোন নামী দামী লোকেরও পতন ঘটে। কথায় বলে- মুখেই জয়, মুখেই ক্ষয়। যারা জ্ঞানী তারা বিষয়টি ঠিকই উপলদ্ধি করতে পারেন। এ বিষয়ে বাংলার বাঘখ্যাত শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের একটি অতি মূল্যবান কথা উদ্ধৃত করতে চাই। তখন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী। একবার বিদেশ সফর শেষে তিনি যখন বিমানবন্দরে নামলেন তখন সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে অনেক প্রশ্ন করতে লাগল। তখন তিনি সাংবাদিকদের শুধু একটি কথাই বলেছিলেন। তা হলো- “উড়হ’ঃ ধংশ সব ধহু য়ঁবংঃরড়হ, নবপধঁংব সু ঃড়ঁহমব রং সু ড়িৎংঃ বহবসু” মানুষের মুখ নিঃসৃত শব্দ বা কথার মূল্য অনেক। অতি মূল্যবান। তাই একে হিসাব করে ব্যবহার করতে হবে। কথা বলতে হবে মেপে মেপে। প্রয়োজন মতো। এ কারণেই হয়ত সৃষ্টিকর্তা দুটি কান দিয়েছেন শোনার জন্য, দুটি চোখ দিয়েছেন দেখার জন্য, কিন্তু কথা বলার জন্য দিয়েছেন একটি মুখ। বর্তমান আলোচনায় কথার এত মূল্যবান বিষয়ে আলোকপাত না করে কথার আর্থিক মূল্য অর্থাৎ খরচের বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। মুখ এবং কানের মাঝখানে যদি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বায়ু মাধ্যম ছাড়া অন্য কোন মাধ্যম থাকে তখনই খরচের উদ্রেক হয়। জ্বী, হ্যাঁ আমি টেলিফোন বা মোবাইল মাধ্যমের কথা বলছি। যত কথা তত খরচ। তা হলে কি কথা বলব না। অবশ্যই বলব। কিন্তু প্রয়োজনীয় একটি কথা বলার জন্য হাজারো কথা খরচ করে নয়। আজকাল তো মোবাইলে কথা বলার জন্য যেন প্রতিযোগিতা চলছে। কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, দিনমজুর, রিক্সাচালক, ভ্যান-চালক, ঝি বুয়া, দারোয়ান থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী, ধনী-গরিব, বস্তিবাসী সবারই কানের কাছে মোবাইল। চলছে কথার পর কথা। আমাদের এত কথা জমা থাকে যে, স্থান, কাল-পরিবেশ ভুলে যাই। ব্যস্ত রাস্তা পার হচ্ছে, কথা বন্ধ নেই। গাড়ি চলছে, ড্রাইভার কথা বলেই যাচ্ছে। গাড়ি চালাতে সকল ইন্দ্রিয় সজাগ রাখতে হয়। কথার আবেগ অনুভূতির কারণে ইন্দ্রিয় অসজাগ। ফলাফল পত্রিকায় দুর্ঘটনার খবর ও লাশের ছবি। টেলিভিশনের নিহত পরিবারের আহাজারি। নি¤œবিত্ত বা দরিদ্র বস্তিতে যাবেন, দেখবেন পেটে ভাত নেই, নেই শিক্ষা দীক্ষা, কিন্তু উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। চীনাদের বদৌলতে বিভিন্ন চটকদার মোবাইল স্বল্পমূল্যে এখন হাতের নাগালে। সুতরাং কথা বলায় পিছিয়ে থাকা কেন। বাসায় কাজের বুয়ারও দুই ঘণ্টার কাজের মধ্যে কয়েকবার কল আসবে। অথবা সে নিজেই কল করবে। আর গৃহিণীদের কথার ফুলঝড়িতে তো চুলায় রান্না পুড়ে ছাড়খার। অফিসের উল্লেখযোগ্য কর্মঘন্টা নষ্ট হয় এই কথা বলায়। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে দেখা যায় তরুণ-তরুণীরা পাশাপাশি থাকলেও কাছাকাছি নয়। যে যার মতো ব্যস্ত মোবাইলে কথা বলায়। কথা চলে গভীর রাতেও। আর এ কথার বৃষ্টিতে মোবাইল কোম্পানিগুলোর হচ্ছে পোয়া বারো। যত কথা তত লাভ। বছরে হাজারো কোটির টাকার কথার ব্যবসা। ক্ষমা করবেন। আমি মোবাইল ব্যবহার বা কথা বলার বিপক্ষে নই। আমি তো শুধু অতিকথন বা স্থান কাল পরিবেশ না বুঝে অপ্রয়োজনীয় কথা বলার কথা বলছি। মোবাইল ব্যবহারে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল ব্যবহারের দিক দিয়ে বিশ্ব তালিকায় বাংলাদেশের নাম বেশ উপরের দিকে। আমাদের ব্যয়ের সক্ষমতা বা ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে প্রসংশনীয়। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি কমিউনিকেশনের যুগে আমাদের এই অর্জন অন্যদের হিংসা করার মতো। মোবাইলের কারণে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য সহজতর হয়েছে। অন্য দেশও মোবাইল ব্যবহার করে। তারা মনে হয় কবি গুরুর গান, ‘তুমি অনেক কথাই যাও যে বলে, কোন কথা না বলে’- এ ধরনের মনোভাব নিয়ে কথা বলে। অপ্রয়োজনীয় কথা বলে সময় নষ্ট করে না। আর আমাদের হাজার কথার মাঝে আসল কথা খুঁজতে হয়। এখন কথা হলো, যার যা প্রয়োজন সে কথা তো সে বলবেই। কিন্তু যে কথা এক মিনিটে বলা যায় তা বলার জন্য দশ মিনিট ব্যয় করার প্রয়োজন কি? এই অপ্রয়োজনীয় কথার সময় ক্ষেপণে একটি দিনমজুর শ্রমজীবী পরিবারে উপার্জনের বড় একটি অংশ কথা বলায় খরচ হয়। সীমিত বেতনের চাকরিজীবীদের মাসিক বাজেটে বাড়তি চাপ পড়ে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, অতিকথন হলেই অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক কথা হবে। অপ্রাসঙ্গিক কথা হলেই পরনিন্দা, কূটনামী-বদনামী হবে। বাতাসে কান পাতলেই শুনবেন এই পরনিন্দা। যা ঘরে-ঘরে, সংসারে-সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে। এতে কম খেশারত হচ্ছে না, যা আর্থিক খরচের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
×