ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুকান্ত গুপ্ত

দুর্গাপুজোর উৎসবে

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৯ অক্টোবর ২০১৫

দুর্গাপুজোর উৎসবে

দুর্গোৎসব বাঙালী হিন্দুদের সর্বশ্রেষ্ঠ পুজো, বিভিন্ন পুরান শাস্ত্রে দুর্গাদেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া, চ-ী, উমা, ভগবতী, পার্বতী প্রভৃতি নামে পূজিতা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান, কালিকা পুরান, দেবী পুরান, দেবী ভাগবত প্রভৃতি গ্রন্থে দেবী দুর্গার কাহিনী, কাঠামো ও লীলার বর্ণনা পাওয়া এবং সেখানে কিছু কিছু পার্থক্য দেখা যায়। শরতের দুর্গাপুজো-শারদীয় দুর্গোৎসব মূলত মার্কন্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রী শ্রী চ-ীগ্রন্থ অনুসারে হয়ে থাকে। চ-ীগ্রন্থ খ্রিঃ তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত এবং যা ভাবগত পুরাণের পূর্বে রচিত হয়। মার্কন্ডেয় পুরাণের মূল অংশ চ-ী। কেউ কেউ মনে করেন ভারতের নর্মদা অঞ্চল অথবা উজ্জয়িনীতে চ-ীর উৎপত্তি। কিন্তু অধিকাংশ গবেষক মনে করেন চট্টগ্রামের করালডাঙ্গা পাহাড়ে শ্রী চ-ীর আবির্ভাবস্থল। বৈদিক যুগ থেকেই দুর্গা নাম প্রচলিত। ঋগে¦দে বিশ্বদুর্গা, সিন্ধুদুর্গা, অগ্নিদুর্গাÑ এ তিনটি নাম পাওয়া যায়। দুর্গাপুজোর কেবল শাক্ত সমাজেই নয়, প্রাচীন বৈষ্ণব সমাজেও অনুষ্ঠিত হয়েছে। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব চ-ীম-পেই চুতষ্পঠী চালু করেন। বৈষ্ণব কবি চ-ীদাস, বৈষ্ণবাচার্য নিত্যান্দজীও দুর্গাদেবীর ভক্ত ছিলেন। মার্কন্ডেয় পুরাণমতে সত্যযুগে রাজা সুরথ, সমাধি বৈশ্য দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে পুজো আরম্ভ করেছিলেন। কৃত্তিবাস রামায়ন থেকে জানা যায়, ক্রেতা যুগে লঙ্কার রাজা রাবণ দেবীপুজোর আয়োজন করে। দেবীর আশীর্বাদধন্য হয়েছিলেন। অন্যদিকে রাবণ-বধ এবং জানকীকে উদ্ধার করার জন্য শ্রী রামচন্দ্র বসন্তকালের পূর্বে শরতকালে দেবীপুজো করেছিলেন। উল্লেখ্য, শ্রী রামচন্দ্র দেবী ভগবতীকে অকালে বোধন করেছিলেন। মূলত দেবীপুজো বসন্তকালে হয়ে থাকে আর সেই থেকে শরতে দেবীপুজো অকালবোধন নামে পরিচিত। শরতের এই পুজোই আমাদের দুর্গোৎসব। শরতের সঙ্গে সঙ্গে হেমন্তে কাত্যায়নী দুর্গা, বসন্তে বাসন্তী পুজোরও প্রচলন আছে। বাল্মীকি রামায়ণে দেখা যায়, রামের জয়লাভের জন্য স্বয়ং ব্রহ্মা দুর্গার স্তব করেছিলেন। মহাভারতে পাওয়া যায়, কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশে অর্জুন দুর্গার স্তব করেছিলেন। দেবী দুর্গা দেবতাদের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। সবচেয়ে প্রাচীন মহিষমর্দিনীর মূর্তিটি পাওয়া যায় পঞ্চম শতাব্দীতে। জানা যায়, প্রথম শতকে কুষান যুগে, পঞ্চম শতকে গুপ্ত যুগে, সপ্তম শতকে পল্লব যুগে এবং ১১-১২ শতকে সেন বংশের আমলে দেবী মহিষমর্দিনী রূপে পূজিত হয়েছেন। কুষান যুগে দুর্গা ছিলেন লাল পাথরে তৈরি। পাল যুগে অর্থাৎ ১২৮৯ সালে দেবী ত্রিনয়নী এবং চারহাতবিশিষ্ট। দশভূজা দুর্গার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৮ শতকে। বাংলাদেশে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন হয় মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে ষোড়শ শতাব্দীতে। মোগল সম্রাটের বিদূষক কুল্লুক ভট্টের পিতা উদয় নারায়ণের পৌত্র অর্থাৎ কুল্লুক ভট্টের পুত্র তাহিরপুরের রাজা (বর্তমান রাজশাহী) কংস নারায়ণ রায় প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা ব্যয়ে প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। পরে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাদুড়িয়ার (রাজশাহী) রাজা জগৎ নারায়ণ প্রায় নয় লাখ টাকা ব্যয় করে বাসন্তী দুর্গোৎসব করেন। তারপর থেকে রাজা-ভূঁইয়ারা নিয়মিতভাবে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের সময় বিক্রমপুর পরগনার ভাগ্যকূল জমিদারবাড়ির রাজা ব্রাদার্স এস্টেটের এবং সাটুরিয়া থানার বালিহাটির জমিদারবাড়ির দুর্গাপুজো আয়োজনের ব্যাপকতা আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে। ঢাকা শহরে সর্বপ্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন ঘটে নবাব সলিমুল্লাহর আমলে। সে সময় সিদ্ধেশ্বরী জমিদারবাড়ির বিক্রমপুর হাউসে জাঁকজমকপূর্ণ পুজো হতো। ১৯২২-২৩ সালে আরমানিটোলার জমিদার ছিলেন বিক্রমপুরের রাজা ব্রাদার্সের বাবা শ্রীনাথ রায়। তাঁর বাড়ির পুজোও সে সময়ে বিখ্যাত ছিল। লালবাগ থানার ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুজো অনেক পুরনো। প্রায় ৮০ বছর যাবত এখানে নিয়মিত পুজো হয়ে আসছে। কিংবদন্তি আছে, ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজিতা দুর্গারই আরেক রূপ দেবী ঢাকেশ্বরীর নামেই ঢাকার নামকরণ। দুর্গাপুজোর কথা বলতে গেলে শাঁখারীবাজার ও তাঁতীবাজারের নাম চলে আসে। শাঁখারীবাজারে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয় ইংরেজ আমলের একেবারে শেষের দিকে। এককভাবে পুজোটি করেন ব্যবসায়ী সুরেশ্বর ধর। ১৯৫৫ সালে বারোয়ারী পুজো হয় বলরাম ধরের বাড়িতে। তাঁতীবাজারের মোক্তার ফণীভূষণ ধর নিজ বাড়িতে এককভাবে পুজো করেন ২৫-২৬ বছর একটানা। ১৯৭১-এর পর শ্ঙ্খৃলমুক্ত মাতৃভূমিতে সর্বপ্রথম মাতৃবন্দনার আয়োজন করে শাঁখারীবাজারের প্রতিদ্বন্দ্বী নাট্যগোষ্ঠী। মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি গঠিত হয় ১৯৭৭ সালে। দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠান ব্যাপক। দুর্গাষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত নানা আচার-উপাচার ও ভক্তিশ্রদ্ধায় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অবদান এ পুজোকে সার্বজনীন করে তুলেছে। দুর্গাপুজোতেই আমরা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এক হয়ে যাই সবাই। প্রাণের উৎসবে পরিণত হয় দুর্গাপুজো। ছবি : রুদ্র ইউসুফ মডেল : নীপা, রাকা পোশাক : স্টাইলপার্ক
×