ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৯ অক্টোবর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

কৈশোরের আরও স্মৃতি (১৮ অক্টোবরের পর) সিলেট শহরের আশপাশে আমার কৈশোরে যথেষ্ট বন-জঙ্গল ছিল। এসব বন-জঙ্গলে খুব সাবধানে যেতে হতো। কারণ সাপের ভয় খুবই স্বাভাবিক ছিল। এছাড়া মাঝে-মধ্যে এসব বন-জঙ্গলে চিতা অথবা বাঘেরও দেখা মিলত। সাধারণত মানুষখেকো বাঘের সন্ধান পেলেই তাকে মারা হতো। সচরাচর বাঘটিকে প্রথমে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় আবদ্ধ করা হতো। তারপর তাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি এলাকায় নিয়ে যাওয়া হতো এবং সেখানে মহাধুমধামে মারা হতো। বাঘকে আবদ্ধ করার একটি সুন্দর কায়দা ছিল। জঙ্গলের কোন শেষ প্রান্তে বড় বড় বাঁশ দিয়ে খোঁয়াড়ের মতো একটা এলাকাকে তৈরি করে রাখা হতো। যেখানে বাঘটা আছে সেদিকে খোঁয়াড়টাকে উন্মুক্ত রাখা হতো। এই প্রস্তুতি যখন সম্পূর্ণ হয়ে যেত তখন বাঘ শিকারীরা নানা জায়গা থেকে এসে এই জঙ্গলে সমবেত হতো। সাধারণত বাঘ শিকারীরা হয়ত ১৫/২০ জন থাকত; কিন্তু তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আরও ১৫/২০ জন সহচর শামিল হতো। জঙ্গলের যেখানে বাঘটা আছে সেখানে এসে শিকারীরা জমা হতো। তারা ঢাকঢোলের আওয়াজ করে সশব্দে একসঙ্গে এগুতে থাকত। বাঘ স্বাভাবিকভাবে তাতে পলায়নরত থাকত। শিকারীরা আস্তে আস্তে তাদের এলাকা সঙ্কুচিত করে নিয়ে আসত। অবশেষে বাঘটি যখন খোঁয়াড় এলাকায় চলে যেত তখন খোঁয়াড়ের যে মুখটি উন্মুক্ত থাকত সেটি বন্ধ করে দেয়া হতো। অর্থাৎ বাঁশ পুঁতে জাল লাগিয়ে খোঁয়াড়টাকে সম্পূর্ণ করা হতো। মোটামুটিভাবে খোঁয়াড়ের আয়তন হতো প্রায় অর্ধবর্গমাইল। খোঁয়াড়টা সম্পূর্ণ হওয়ার পর সেখানে বাঘ শিকারের মেলা বসত। এসব মেলা আমার মনে হয় ৭/১০ দিন চলত এবং ঘোষণা দেয়া হতো যে, একটি নির্দিষ্ট দিনে বাঘটিকে মারা হবে। সেই নির্দিষ্ট দিনে শিকারীরা খোঁয়াড়ের চারদিকে সমবেত হতো এবং নানাভাবে বাঘটিকে উত্ত্যক্ত করত। আসল উদ্দেশ্য ছিল বাঘটাকে হয়রান করে দেয়া। খোঁয়াড়ের বিভিন্ন দিকে ছাগল রেখে বাঘটাকে আমন্ত্রণ করা হতো। তারপর ছাগলটিকে শিকারীদের আশ্রয়ে নিয়ে আসা হতো। ক্ষুব্ধ বাঘটি শিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় শিকারীদের দিকে তেড়ে আসত। তখন শিকারীরা বর্ষা এবং লাঠি ব্যবহার করে বাঘটাকে তাড়িয়ে দিত। এভাবে বাঘটা নানা দিকে শিকারের সন্ধানে গিয়ে হয়রান হয়ে যেত। হয়রান হয়ে যখন ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে বাধ্য হতো তখন বাঘটাকে গুলি করা হতো। সচরাচর কোন বড় শিকারী অথবা জেলা প্রশাসক বা তার সহকারী বাঘটাকে গুলি করতেন। বাঘটা মরে গেলে (এই বীর শিকারী) বাঘটির মৃতদেহের ওপর পা রেখে ছবি উঠাতেন। সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে একটি গ্রামের নাম কুচাই। সম্ভবত ১৯৪৯ সালে একটি বাঘ সেখানে আসে এবং নিকটস্থ এলাকায় ভীতি সঞ্চার করে। এই বাঘটিকে তখন আবদ্ধ করার ব্যবস্থা হয়, যাতে তাকে মারা যেতে পারে। সেবারের বাঘ শিকার আমি দেখেছি। এ রকম শিকার মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হতো। আমি কিন্তু আর দ্বিতীয় কোন বাঘ শিকার দেখিনি। এই কুচাইর বাঘ শিকারের পর আমাদের বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাসে বাঘ শিকারের ওপর প্রবন্ধ লেখার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিযোগিতায় অবশ্য যারা বাঘ শিকার দেখতে যায়নি তারাও মনের মাধুরী মিশিয়ে বাঘ শিকারের কাহিনী লিখত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগে। কিন্তু কিভাবে দেশ স্বাধীন হবে সেই বিষয় নিয়ে হিন্দু এবং মুসলমানদের বিভিন্ন মতের কারণে সারাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তৃতি হয়। আমরাও সেই আবহাওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম না। কিশোরদের মধ্যে তখন দুটি প্রতিষ্ঠান বেশ সংগঠিত হয়। আজাদ দৈনিক পত্রিকার ‘মুকুল মেলা’ ছিল মুসলমান কিশোরদের সংগঠন এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘মণিমেলা’ ছিল হিন্দু কিশোরদের সংগঠন। এসব সংগঠন ১৯৪৩-৪৪ সাল থেকে গড়ে উঠতে থাকে এবং ১৯৪৫ সালে সিলেটে ‘মণিমেলা’র কিশোর সংগঠনটি হয় বেশ কর্মক্ষম। তারা বার্ষিক খেলাধুলার অনুষ্ঠান করত। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত এবং মাঝে মাঝে সামরিক কুচকাওয়াজও করত, তাদের এই সংগঠন দেখে আমাদেরও একদলের মধ্যে এ রকম কিছু করার বাসনা জন্মে। ১৯৪৬ সালে এ বিষয়ে আমি নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই এবং আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাসির চৌধুরী, হেদায়েত আহমদ, আবু সাঈদ মাহমুদ এবং আমার কনিষ্ঠ ছাত্রছাত্রী ভাইবোনদের নিয়ে ‘মুকুল মেলা’ (পরবর্তীতে ‘মুকুল ফৌজ’) গঠনে মনোনিবেশ করি। এ সম্বন্ধে আরও কথা আমি পরে বলব। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় আমরা কয়েক বন্ধু মিলে একটি ব্যবসা ফেদে বসি। কাজটি শুরু হয় পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা হিসেবে। আমরা লাহোর এবং বোম্বাই থেকে পাকিস্তান বিষয়ক ছবি, পোস্টার, ডাইরি, ক্যালেন্ডারের চটি বই সংগ্রহ করে সেটা প্রায় বিনা লাভে বিক্রয় করতে থাকি। মূলধন আমরা চার বন্ধু মিলে যোগাড় করি- হেদায়েত, নাসির, মাহমুদ এবং আমি। অচিরেই যুক্ত হন আমার ভাই মুহসি। এক সময় আমাদের মূলধন প্রায় ১০০ টাকায় পৌঁছে যায়। আমাদের বিক্রয় সামগ্রীর মজুদ থাকত বন্দরবাজারের আর্ল লাইব্রেরিতে। এই গ্রন্থাগারের মালিক আমাদের খুব ¯েœহ করতেন এবং নানাভাবে সহায়তা করতেন। ১৯৪৬ এবং ১৯৪৭ সালে প্রায় দেড় বছর আমাদের ব্যবসা চলতে থাকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেলে এই উদ্যোগের অবসান হয়। ব্যবসার অবসায়নে বাজারে আমাদের যে পাওনা ছিল তা আর মোটামুটি পাওয়া গেল না। আমাদের মূলধন খোয়া গেল, লাভের খাতায় থাকল প্রত্যেকের জন্য প্রায় ৬ টাকা দামের এক একটি জিন্নাহ টুপি। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানের নিশ্চয়তা মোটামুটিভাবে বোঝা যায়। তখন প্রশ্নটা উঠলো যে, যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ সরকার কিভাবে ভারত ছাড়বে। এই বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট অত্যন্ত শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন যে, ব্রিটিশ সরকারকে ভারত ছাড়তে হবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের অবস্থান ছিল এই প্রস্তাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের পরামর্শের বিরোধিতা করার সামর্থ্য তখন ব্রিটিশ সরকারের ছিল না। সৌভাগ্যবশত যুদ্ধ পুরোপুরি বন্ধ হবার সামান্য আগেই ব্রিটিশ নির্বাচনে উইনস্টন চার্চিলের দল পরাজিত হয় এবং ক্লিমেন্ট এটলি লেবার পার্টির নেতা হিসেবে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হন। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি লগ্নে একটি বিষয় সবিশেষ গুরুত্ব লাভ করে এবং তা ছিল সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার কিভাবে সংরক্ষণ করা যাবে। এ বিষয়ে ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের একটি সিদ্ধান্ত ছিল যে, ভারতের পূর্ব সীমান্তে আসাম এবং বাংলা প্রদেশকে নিয়ে এবং পশ্চিম সীমান্তে পাঞ্জাব থেকে উত্তর-পশ্চিমে সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করা হোক। কিন্তু বাস্তবে ভারত বিভক্ত করার কোন পরিকল্পনাই ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ছিল না। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারিতে ভারতবর্ষে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ দাবি করে, তারাই মুসলিম জনমত ব্যক্ত করার অধিকারী এবং তাদের দাবি অনুযায়ী মুসলমানদের স্বার্থসংরক্ষণ করতে হবে। এই ভোটযুদ্ধে মুসলিম লীগ শুধু বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে মন্ত্রিসভা গঠন করে এবং প্রধানমন্ত্রী হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে জয়ী হন কংগ্রেসপন্থী সীমান্ত গান্ধী ড. আবদুল গফফার খান। পাঞ্জাবে জয়ী হন কংগ্রেস-ঘেঁষা ইউনিয়নিস্ট দলের নেতা স্যার সিকান্দর হায়াত খান। সিন্ধু প্রদেশে টেনেটুনে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করলেন স্যার গোলাম হোসেন হেদায়েতুল্লাহ। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় মুসলিম লীগের প্রার্থীরা সফল হলেও একমাত্র বাংলা প্রদেশ ছাড়া কোথাও কোন মুসলিম নেতা প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী হতে পারলেন না। চলবে ...
×