ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভক্তদের ঢল ছেঁউড়িয়ায়

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে

প্রকাশিত: ০৫:০২, ১৮ অক্টোবর ২০১৫

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে

এমএ রকিব ছেঁউড়িয়ায় মানুষের ঢল। শামিল নারী-পুরুষ সবাই। রাত যতই গভীর হয়, মানুষের ঢল ততই বাড়তে থাকে। মূলমঞ্চের সামিয়ানার নিচে কয়েক হাজার লালনভক্ত, অনুসারী ও দর্শক-শ্রোতা। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন শুরু হবে লালন সঙ্গীতের সেই সুরের মূর্ছনা। এই উন্মাদনা বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহর তিরোধান দিবস ঘিরে। শুক্রবার পহেলা কার্তিক ছিল লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবস। প্রথমেই শুরু হয় আলোচনা অনুষ্ঠান। এক সময় আলোচনার পর্দা সরিয়ে প্রবীণ শিল্পী বাউল মোহাম্মদ আলী সাঁই গেয়ে ওঠেন আধ্যাতিক সঙ্গীত, ‘এলাহী আল-আমীন আল্লাহ বাদশা আলামপানা তুমি, আল্লাহ ডুবাইয়ে ভাসাইতে পারো, ভাসাইয়ে কী নাইবা পারো, রাখো মারো...’। উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা সঙ্গে সঙ্গে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানায় শিল্পীকে। এরপর লালন একাডেমির শিল্পীরা একে একে গেয়ে চলেন, ‘দেখা দিয়ে ওহে রাসূল ছেড়ে যেয়ো না, তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাব না...’। ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে, লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না...’। লালনপ্রেমী ভক্ত-শ্রোতারা পরম তৃপ্তিতে তা উপভোগ করতে থাকেন। গভীর রাত পর্যন্ত শিল্পীরা মাতিয়ে রাখেন জমজমাট এই গানের আসর। এভাবেই পহেলা কার্তিক পার হয়ে যায় মরমী গানের স্রষ্টা, আধ্যাত্মিক সাধক ও বাংলার বাউলের শিরোমণি ফকির লালন শাহ’র ১২৫তম তিরোধান দিবস। দিনটি উদযাপন উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও লালন শাহের চারণভূমি কুষ্টিয়ায় আয়োজন করা হয়েছে পাঁচ দিনের অনুষ্ঠান। চলবে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শুরু হয় এ অনুষ্ঠান মালা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতা ও কুষ্টিয়া লালন একাডেমির আয়োজনে এসব অনুষ্ঠানে রয়েছে লালনের জীবনাদর্শন ও স্মৃতিচারণ করে আলোচনা, লালন সঙ্গীতানুষ্ঠান আর বসছে জমজমাট লোকশিল্পের লালন মেলা। এদিকে লালনের তিরোধান দিবস ঘিরে ভক্ত, অনুসারী, দর্শক-শ্রোতা ও বাউল-বাউলানীর পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে আঁখড়াবাড়ি। রাতভর চলছে মন মাতানো সব লালন সঙ্গীত। লালন একাডেমির সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) সেলিম হক বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও দূর-দূরান্ত থেকে নারী-পুরুষ সমন্বয়ে গুরু-শিষ্য, লালনভক্ত-অনুসারীরা ছুটে এসেছেন সাঁইজির পুণ্যভূমি ছেঁউড়িয়ায়। একাডেমির পক্ষ থেকে তাদের জন্য অর্ধাবাস (রাত ১২টার পর খাবার), বাল্যসেবা (সকালের নাস্তা) ও পুণ্যসেবার (ভাত, সবজি, মাছ ও দইসহ দুপুরের খাবার) ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রথম দিন অনুষ্ঠানে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের সমাগম হয় বলে তিনি জানান। শুক্রবার রাত ৯টায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে পাঁচ দিনব্যাপী এ আয়োজন উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এমপি। তিনি বলেন, বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ কোন ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি কোন জাতপাত বিশ্বাস না করে মানবতার কল্যাণে কাজ করে গেছেন। জাতহীন মানবদর্শন ও সঙ্গীত বর্তমান বিশ্বাঙ্গনে সার্বজনীন। তিনি বলেন, বিশ্বময় যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভঙ্গ করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়ে চরম অশান্তি বিরাজ করেছে, তখন আমাদের দেশের সকল ধর্মের মানুষ লালন শাহের অসাম্প্রদায়িক শান্তির বাণী বুকে ধারণ করে সকলে মিলে মিশে শান্তিতে বসবাস করছে। লালন শাহ এমনই একটি অসাম্প্রদায়িক সাম্যের সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কুষ্টিয়া লালন একাডেমির সভাপতি জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেনের সভাপতিত্বে এতে আলোচক ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সরোয়ার মুর্শেদ। অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও খোকসা উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ সদর উদ্দিন খান, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হাজী রবিউল ইসলাম, কুমারখালী উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান খান, কুমারখালী পৌর মেয়র শামসুজ্জামান অরুণ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা ও স্বাগত বক্তব্য রাখেন যথাক্রমে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহেলা আক্তার ও লালন একাডেমির সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) সেলিম হক। লালনের তিরোধান দিবসে পাবনা থেকে আসা লালনভক্ত করিম বলেন, ‘গুরু কিংবা লালন যাই বলুন; ওনারা তো ধীয়ানলোকে বিরাজ করেন। হাত দিয়ে দেখানোর কিছু নেই। তাঁর ভাষায়- ‘গুরুকেই আমি লালন ভাবি। গুরু ভাবনায় থাকতে থাকতে কখনও আবার নিজের মধ্যেই লালন প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। তখন মন অন্যরকম হয়ে যায়। গানের সুর ভাল হয়। মনে হয় যার গান সেই গাইছে, আমি খালি খালি মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি’। বিশিষ্ট লালন গবেষক অধ্যাপক ড. আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, বাউল গানের বিপুল লোকপ্রিয়তার মূলে লালনের অবদান সর্বাধিক ও সর্বশ্রেষ্ঠ। বাঙলার অপর কোন মরমীসাধক বা লোককবি লালনের মতো এত বিপুল পরিচিতি, ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা ও অসামান্য প্রতিষ্ঠা অর্জনে সক্ষম হননি। তাঁর পরিচয় ও প্রতিষ্ঠার পরিধি আজ দেশের গ-ি পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
×