ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জার্মানির ইন্টারনেট স্কুল

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১৭ অক্টোবর ২০১৫

জার্মানির ইন্টারনেট স্কুল

বখুম শহরে রয়েছে জার্মানির একমাত্র ইন্টারনেট স্কুল। পপতারকা কিংবা অটিস্ট– সে যাই হোক না কেন সবাই সেখানে পড়াশোনার সুযোগ পায়। সকাল-সকাল ওঠা, স্কুলে যাওয়ার তাড়া নেই। কারণ এর মাধ্যমেই তারা স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারে। জার্মানির স্কুলগুলিতে গ্রীষ্মের ছুটি চলছে এখন। মিউনিখের ১৩ বছরের লিলির জন্য এটা কোন বিষয় নয়। সে এখনও ক্লাস করছে। একই সঙ্গে বাবা-মার সঙ্গে টোঙ্গায় ছুটিও কাটাচ্ছে। তার মা-বাবা সেখানে একটি হোটেল চালান। লিলিও বছরে তিন মাস তাদের সঙ্গে সেখানে কাটায়। জার্মানি থেকে রবিন শাডে তাকে স্কাইপের মাধ্যমে গণিত ও ইংরেজী ব্যাকরণ পড়ান? লিলি মিউনিখে হাই স্কুল বা গিমনাসিয়ুমে পড়ে? পড়াশোনায় যাতে বাধা না পড়ে সেজন্য টোঙ্গাতে বসেও সুবোধ ছাত্রীর মতো ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছে সে। আর এক্ষেত্রে সাহায্য করছে জার্মানির একমাত্র ইন্টারনেট স্কুল। লিলি জানায়, ‘তিন বছর আগে আমি এটা শুরু করেছি। সত্যি খুব ভাল হচ্ছে।’ তিন মাস টোঙ্গাতে থাকাকালীন বখুমের ‘ওয়েব ইনডিভিজুয়াল স্কুল’-এর দু’জন শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করে সে। এই ব্যবস্থা না থাকলে লিলিকে দীর্ঘদিনের জন্য টোঙ্গাতে আনা সম্ভব হতো না বলে জানিয়েছেন তার মা-বাবা। ইন্টারনেট স্কুলে সাতজন শিক্ষক ৯ থেকে ২২ বছর বয়সী ৯০ জনের মতো ছাত্রছাত্রীকে পড়ান। ১২ বছর আগে যাত্রা শুরু হয় স্কুলটির। যারা কোন কারণে নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না, তাদের সাহায্য করার জন্যই এগিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটি। তবে ইন্টারনেট স্কুলটি পরীক্ষা নিতে বা নম্বর দিতে পারে না। ছাত্রছাত্রীদের তাদের হাউপ্টশুলে কিংবা রেয়ালশুলের ফাইনাল পরীক্ষা দিতে হয় কোন সহযোগী স্কুলে, সরকার অনুমোদিত পরীক্ষা কমিশনের সামনে। এ পর্যন্ত ১৫০-এর বেশি শিক্ষার্থী ওয়েব স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে বের হয়েছে। এখন পর্যন্ত কেউ ফেল করেনি। ‘টোকিও হোটেল’ সঙ্গীতগোষ্ঠীর দুই ভাই বিল ও টম কাইলিতস এই স্কুলেই পড়াশোনা করেছেন। জাপান বা আমেরিকা যেখানেই গেছেন, সেখানেই তারা হোটেলে বসে পড়াশোনা করেছেন। ইংরেজীর পাশাপাশি গণিত ও ভূগোলে জ্ঞান অর্জন করেছেন জার্মান ভাষায়। শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কোন জার্মান প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যারা বিদেশে কর্মরত, তাদের সন্তানরাও ইন্টারনেট স্কুলের সাহায্য নিয়ে থাকে। ওয়েব স্কুলের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই শারীরিক বা মানসিক ক্রনিক রোগে আক্রান্ত, যাদের পক্ষে সাধারণ স্কুলে যাওয়া সম্ভব নয়। মাসে ৭৮০ ইউরো টিউশন ফি বহন করে ভারপ্রাপ্ত যুব দফতরগুলো। শুরুতে ই-মেইলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা স্কুলের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিত। ২০০৪ সাল থেকে পরিবর্তন শুরু হয়। আজ স্কাইপ, মোবাইল ও চ্যাটের মাধ্যমে ক্লাস করানো হয়। পড়াশোনা বা ব্যক্তিগত কোন সমস্যা হলে অনেক রাতেও শিক্ষকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা যায়। সাতজন শিক্ষক বখুম ও রুর অঞ্চলের আশপাশে জায়গায় বসবাস করেন। অর্থাৎ ক্লাসরুমবিহীন স্কুলটি থেকে খুব বেশি দূরে থাকেন না তাঁরা। নিয়মিত স্কুলে চাকরি করার সুযোগ থাকলেও ওয়েব স্কুলে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই শিক্ষকরা। আনা গেবার্স-ফ্রিটশে দুই বছর ধরে ১২ বছরের লেওনকে পড়াচ্ছেন। ছেলেটি অটিস্ট। এ্যাসপারজার্স সিনড্রোমে ভুগছে সে, অর্থাৎ মানুষের সংস্পর্শ পছন্দ নয় তার। তাই সানটেন শহরের হাউপ্টশুলেতে তাল সামলাতে পারছিল না লেওন। এখন সে নবউদ্যমে ওয়েব স্কুলে পড়াশোনা করছে। কম্পিউটারের ‘পর্দার আড়ালে’ মানুষের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে পারছে সে, বলেন শিক্ষিকা আনা। গতানুগতিক স্কুলে অটিস্টরা আশপাশের লোকজনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে আড়ষ্টবোধ করে ও নিজেকে গুটিয়ে রাখে। বখুমের ওয়েব স্কুলের শিক্ষকদের অধিকাংশই অতিরিক্ত বিশেষ কোর্স করেছেন। এছাড়া একজন মনস্তত্ত্ববিদ শিক্ষকদের সহায়ক হিসেবে পাশে থাকেন। বিভিন্ন ধরনের অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কী রকম আচরণ করা উচিত, সে সম্পর্কে পরামর্শ দেন তিনি। ইন্টারনেট স্কুলের পাঠ্যসূচীও তৈরি করা হয় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী। যেমন অঙ্ক ক্লাসে হিসাব কষে বের করতে হয়, ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়ন সেবাস্টিয়ান ফেটেল বছরে কত কিলোমিটার পার করেছেন। ভূগোলে সেই সব দেশ সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করা হয়, যেসব দেশে ফর্মুলা ওয়ানের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ইন্টারনেট স্কুল থেকে পাস করে বের হয়েছে ১৯ বছরের লিন মাক্স কেম্পেন। টেনিস খেলাকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে এই তরুণ। দৈনিক ছয় ঘণ্টা ট্রেনিং ছাড়াও বিভিন্ন দেশে টুর্নামেন্টে যেতে হয় তাকে। পাশাপাশি রেয়ালশুলের পরীক্ষার প্রস্তুতি সহজ ছিল না। ওয়েব স্কুলের সহায়তায় এই বৈতরণী পার হয়েছে।
×