ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

খালেক বিন জয়েনউদদীন

অক্টোবরে জন্ম নেয়া সেই শিশুটি

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১৭ অক্টোবর ২০১৫

অক্টোবরে জন্ম নেয়া  সেই শিশুটি

অক্টোবর মাস নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের কাছে এই মাসটি বেশি প্রিয় এ কারণে যে, এ মাসের প্রথম সোমবার সারাবিশ্বে বিশ্ব শিশু দিবস উদযাপন করা হয়। জাতিসংঘ প্রণীত শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী এই দিবসটি শিশুদের অধিকার তথা বিকাশের কথা প্রতিবছর স্মরণ করিয়ে দেয়। শিশু অধিকার সনদে শিশুদের মৌলিক অধিকার বিশেষ করে নিরাপত্তা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রতিভা বিকাশের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি অধিকারসমূহ বাস্তবায়ন করার জন্য রাষ্ট্র এবং অভিভাবকদের তাগিদ দেয়া হয়েছে। মোটকথা, অক্টোবর মাসের এই দিন শিশুরা তাদের স্বপ্নের কথা বলে। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম চাহিদাগুলো পূরণের আবদার ধরে। অক্টোবর মাসটি শুধু শিশুদের জন্য উৎসর্গিত। আমাদের দেশে অবশ্য প্রতি বছর বিশ্ব শিশু দিবস পালনের লক্ষ্যে শিশু অধিকার সপ্তাহ পালন করা। বিশ্ব শিশু দিবসের কর্মসূচী শুরু হয় ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে এবং শেষ হয় অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের প্রথম সোমবার। সপ্তাহব্যাপী এই কর্মসূচী পালনের দিনগুলোকে ‘জাতীয় শিশু অধিকার সপ্তাহ’ শিরোনামে অভিহিত করা হয়। অক্টোবর মাসের আরও একটি দিন আমাদের কাছে বেশি আনন্দময়। এই দিন একটি শিশু পৃথিবীর প্রথম আলো দেখেছিল। তার চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন। রঙিন পৃথিবীর একজন ক্ষুদ্র বাসিন্দা হয়ে সে তার স্বপ্ন পূরণ করবে এবং সর্বোপরি বাঁচার অধিকার থেকে কখনও অধিকারহারা হবে না। শিশু অধিকার মাস অক্টোবরের ১৮ তারিখে তার জন্ম। প্রকৃত নাম তার শেখ রিসালউদদীন। তবে ছোট-বড় সকলের কাছে রাসেল নামে পরিচিত ছিল। রাসেল আর দু-দশটি শিশুর মতোই ছিল। তার বেঁচে থাকার অধিকারকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল। যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তার এই অধিকার কেড়ে নেয়া হয়নি। বিপথগামী একদল নরঘাতক তাকে হত্যা করেছিল। তার সেই হত্যাকা- আগস্ট ও অক্টোবর মাসে গোটা শিশুসমাজ তথা মানবসমাজকে কাঁদায়। রাসেল এখন অধিকারহারা শিশুদের প্রতীক। তার জন্মদিন শিশুদের অধিকার আদায়ের কথা বলে। যেসব শিশু অকালে হারিয়ে যায় তাদের স্মৃতি জাগরুক করে। শেখ রাসেল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র এবং বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট ভাই। বাংলাদেশের সংগ্রাম ও স্বাধীনতার মধ্যে তার শৈশবকাল ও বেড়ে ওঠা। তার জন্মদিন, জন্মক্ষণ ও তার কথা শুনলেই এ দেশের ইতিহাসের কথা জানা হয়ে যায়। রাসেলকে নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক ও গান লেখা হয়েছে প্রচুর। কিন্তু তার বড় আপা শেখ হাসিনা ও ছোট আপা শেখ রেহানার স্মৃতিচারণ সবার থেকে আলাদা এবং মর্মস্পর্শী। শেখ হাসিনা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ শীর্ষক একটি রচনায় লিখেছেন : ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর রাসেলের জন্ম হয় ধানম-ি ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় আমার শোয়ার ঘরে। দোতলার কাজ তখনও শেষ হয়নি। বলতে গেলে মা একখানা করে ঘর তৈরি করিয়েছেন। একটু একটু করেই বাড়ির কাজ চলছে। নিচতলায় আমরা থাকি। উত্তর-পূর্বদিকের ঘরটা আমার ও কামালের। সেই ঘরেই রাসেল জন্ম নিল রাত দেড়টায়। আব্বা নির্বাচনী মিটিং করতে চট্টগ্রাম গেছেন। ফাতেমা জিন্নাহ প্রেসিডেন্টপ্রার্থী। সর্বদলীয় ঐক্য পরিষদ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে একটা মোর্চা করে নির্বাচনে নেমেছে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সকল রাজনৈতিক দল। তখনকার দিনে মোবাইল ফোন ছিল না। ল্যান্ডফোনই ভরসা। রাতেই যাতে আব্বার কাছে খবর যায় সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, রেহানা ও খোকা কাকা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজ ফুফু মার সঙ্গে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরাও ঘুমে ঢুলঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমনবার্তা শোনার অপেক্ষায়।’ বন্দী অবস্থায় রাসেল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধের গান শুনত। আবার গানের কলি পাল্টিয়ে পাক-সেনাদের একটি গান শোনাতোÑ জয় জয় জয়, গাছের পাতা হয়। জয় বাংলা শুনলে তারা ক্ষেপে যাবেÑ এ কারণেই এমনটি করত। বেঁচে থাকতে রাসেলের জন্মদিন কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয়নি। তবে ওর আপারা তাকে খেলনাসহ অন্যান্য উপহার দিতেন। মা বাসায় অন্যদিনের চেয়ে একটু ভাল রান্না করতেন। সবাই মিলে তা খেতেন। জন্মদিনে এমনই আয়োজন ছিল তার ছোট্ট জীবনে। রাসেল বাঁচতে চেয়েছিল তার অধিকার নিয়ে। কিন্তু নরাধমরা তার অধিকার খর্ব করেছিল ঠিকই, কিন্তু রাসেলের মৃত্যু শিশুদের চাওয়া-পাওয়ার জগত নতুন করে বদলে দিয়েছে। আমরা তার জন্মদিনে সকল শিশুকে বেঁচে থাকার জন্য অধিকারের কথা বলি এবং যারা শিশুদের অধিকার হরণ করে তাদের ঘৃণা করি।
×