ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মূল : ও. হেনরি। ভাষান্তর: কাজী আখতারউদ্দিন

একটি খবরের কাগজের গল্প

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ১৬ অক্টোবর ২০১৫

একটি খবরের কাগজের গল্প

সকাল আটটায় পত্রিকাটি গিউসেপির পত্রিকা স্ট্যান্ডে পড়েছিল। সবেমাত্র ছাপাখানা থেকে আসার কারণে তখনও একটু একটু ভেজা। গিউসেপি গ্রাহকদের ছেড়ে তার নিজস্ব কৌশলে উল্টোদিক থেকে আসা মানুষটির সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করছিল। সে ওই নীতিতে বিশ^াসীÑ তাকিয়ে থাকলে পাত্রে পানি ফুটবে না। নিজস্ব রীতিনীতি, রূপরেখা অনুযায়ী এই বিশেষ পত্রিকাটি একাধারে একজন শিক্ষক, গাইড, মনিটর, একজন চ্যাম্পিয়ন এবং গৃহ সংক্রান্ত উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করে থাকে। এর বিভিন্ন বিশিষ্টতা থেকে তিনটি সম্পাদকীয় বেছে নেয়া যেতে পারে। একটি ছিল সহজ-সরল, তবে উদ্দীপক ভাষায় অভিভাবক এবং শিক্ষকদের উদ্দেশে, শিশুদের কঠিন শাস্তি অননুমোদন করা নিয়ে। আরেকটি ছিল একজন কুখ্যাত শ্রমিক নেতাকে অভিযুক্ত এবং বিশেষভাবে সতর্ক করে, যিনি তার অনুসারীদের একটি বিরক্তিজনক হরতাল করতে উস্কানি দিতে যাচ্ছিলেন। সুন্দর বাচনভঙ্গিতে তৃতীয়টিতে একটি দাবি তুলে ধরা হয়েছিল, যেন পুলিশ বাহিনীকে সবদিক দিয়ে সমর্থন ও সহযোগিতা করা হয়, যাতে জনসাধারণের অভিভাবক এবং সেবক হিসেবে তাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়। নগরবাসীর উপকারে, গুরুত্বপূর্ণ তিরস্কার এবং প্রয়োজনীয় কিছু চাহিদা ছাড়াও একটি বিজ্ঞ ব্যবস্থাপত্র কিংবা কার্যপ্রণালীর রূপরেখা সম্পাদকের একটি বিশেষ হার্ট টু হার্ট কলামে তুলে ধরা হয়েছিল। এটি একজন যুবকের বিষয়ে, যে তার প্রেয়সীর অনমনীয় মনোভাবের বিষয়ে অভিযোগ করেছিল। তাকে শিখিয়ে দেয়া হচ্ছিল কিভাবে সে মেয়েটির মন জয় করতে পারবে। তারপর ছিল একটি রূপচর্চা বিষয়ক পাতা, এখানে একজন তরুণীর রূপচর্চাবিষয়ক কিছু প্রশ্নের বিশদ উত্তর তুলে ধরা হয়েছিল। সে জানতে চেয়েছিল কিভাবে উজ্জ্বল চোখ, গোলাপী গাল এবং একটি সুন্দর মুখ সে পেতে পারে। আরেকটি আইটেমে একটি সংক্ষিপ্ত ‘ব্যক্তিগত’ কলামে বলা হয়েছিল: প্রিয় জ্যাক, আমাকে ক্ষমা করো। তুমিই ঠিক বলেছিলে। আজ সকাল সাড়ে আটটায় ম্যাডিসনে, তিন নং স্ট্রিটের মোড়ে আমার সঙ্গে দেখা করে। আমরা দুপুরে চলে যাই। প্রায়শ্চিত্ত সকাল আটটায় গিউসেপির পত্রিকা স্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে অস্থির চেহারা নিয়ে একজন যুবক হেঁটে যাচ্ছিল। দুশ্চিন্তায় তার চোখমুখ বসে গেছে। একটি পেনি ফেলে সে স্ট্যান্ড থেকে সবচেয়ে উপরের পত্রিকাটি তুলে নিল। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে সকালে সে দেরি করে উঠেছে। নটায় অফিসে পৌঁছতে হবে আর এই সময়ের মধ্যেই তাকে দাড়ি কামিয়ে এক কাপ কফি খেয়ে নিতে হবে। সে তার পরিচিত নাপিতের দোকানে গেল, তারপর সেখান থেকে বের হয়ে দ্রুত হেঁটে চলল। দুপরে লাঞ্চের সময় পড়বে ভেবে পত্রিকাটি পকেটে ভরল। পরবর্তী মোড় ঘুরতেই সেটা পকেট থেকে পড়ে গেল, সেই সঙ্গে নতুন দাস্তানাজোড়াও মাটিতে পড়ে গেল। তিনটি ব্লক হেঁটে পার হবার পর তার মনে পড়ল দাস্তানাটি নেই। তারপর রাগে গজরাতে গজরাতে পিছন ফিরে চলল। ঠিক সাড়ে আটটায় সে ওই কোণটিতে পৌঁছল, যেখানে দাস্তানাজোড়া আর পত্রিকাটি মাটিতে পড়েছিল। তবে অবাক কা-, সে যা খুঁজতে এসেছিল তার দিকে মোটেই নজর দিল না। বরং শক্তহাতে ছোট দুটি হাত ধরে একজোড়া বাদামি চোখের দিকে তাকিয়ে রইল । তার মন আনন্দে ভরে উঠেছে। মেয়েটি বলল, ‘প্রিয় জ্যাক, আমি জানতাম তুমি এখানে ঠিক সময়েই আসবে।’ ছেলেটি মনে মনে ভাবল, ‘একথাটি বলে সে কি মনে করছে জানি না। তবে ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ পশ্চিম দিক থেকে একটি দমকা হাওয়া এসে রাস্তার পাশ থেকে কাগজটি উড়িয়ে নিল। ভাঁজ থেকে পাতাগুলো খুলে ছড়িয়ে পড়ল এবং ঘুরতে ঘুরতে পাশের রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে চলল। ওই রাস্তা দিয়ে একজন যুবক একটি তামাটে রঙের তেজি ঘোড়াসহ একটি ছ্যাঁকরা গাড়ি নিয়ে চলছিল। এটি সেই যুবক যে হার্ট টু হার্ট সম্পাদকের কাছে লিখেছিল, কীভাবে তার প্রেয়সীর মন জয় করবে, যার জন্য তার দীর্ঘশ^াস পড়ে। দুষ্টুমিভরা চঞ্চল হাওয়া কাগজটি উড়িয়ে নিয়ে তেজি ঘোড়াটির মুখের উপর ঝাপটা মারল। এ অবস্থায় গাড়িসহ তামাটে রঙের ঘোড়াটি চারটি ব্লক পার হলো। তারপর রাস্তার একটি পানির কল সৃষ্টি-রহস্যে এর ভূমিকা পালন করল আর পূর্বনির্ধারিতভাবে এক্কাগাড়িটি দিয়াশলাই তৈরির কাঠে পরিণত হলো। আর এর চালক একটি বাদামি রঙের বেলেপাথরের তৈরি অট্টালিকার সামনের এ্যাসফল্টের রাস্তায় ছিটকে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে রইল। অট্টালিকার ভেতর থেকে লোকজন ছুটে এসে তাকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেল। কারও তোয়াক্কা না করে একজন তার মাথা কোলে নিয়ে তার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলতে লাগল, ‘ওহ্, ববি! সবসময় তোমার বেলায় এসব ঘটে! দেখতে পাওনি কি ঘটছিল? আর তুমি মরলে আমিও মরে যাবো, আর...’ আর এই সুযোগে আমাদের দ্রুত ছুটে যেতে হবে আমাদের কাগজের কাছে। পুলিশ কন্সটেবলটি মনে করলেন এটি চলাচলের জন্য একটি বিপজ্জনক বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বড় বড় আঙ্গুল দিয়ে অগোছালো পাতাগুলো ঠিক করে তিনি শ্যানডন বেল ক্যাফের পারিবারিক প্রবেশ পথ থেকে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়ালেন। থেমে থেমে একটি হেডলাইন জোরে জোরে বানান করে পড়লেন: ‘পুলিশ বাহিনীকে সহায়তার যে কোন প্রচেষ্টায় সংবাদপত্র প্রথম সারিতে থাকবে।’ কিন্ত‘ ওই হুইশশ! দরজার ফাঁক দিয়ে শুঁড়িখানার প্রধান পরিবেশক ড্যানির গলা শোনা যাচ্ছে: ‘মাইক দাদু, একটু গলা ভিজিয়ে নিতে আপনার জন্য সামান্য ড্রিংকস।’ ছড়িয়ে থাকা পত্রিকাটির বন্ধুভাবাপন্ন কলামের পেছনে দাঁড়িয়ে পুলিশ সদস্য ও’ব্রায়ান দ্রুত আসল জিনিসটি সামান্য গ্রহণ করলেন। শেরি পানের পর সতেজ হয়ে তিনি দৃঢ় পদক্ষেপে দায়িত্ব পালন করতে চলে গেলেন। সকাল বেলাতেই তার পরিশ্রমের আশির্বাদধন্য আত্মিক ও আক্ষরিক ফলাফলটি দেখে সম্পাদক হয়তো গর্ব অনুভব করতেন। পুলিশ সদস্য ও’ব্রায়ান কাগজটি ভাঁজ করে খেলাচ্ছলে পাশ দিয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট ছেলের বগলের নিচে গুঁজে দিলেন। ছেলেটির নাম জনি, সে পত্রিকাটি বাসায় নিয়ে গেল। তার বোনের নাম গ্ল্যাডি। সে এই পত্রিকাটির রূপচর্চা বিষয়ক সম্পাদকের কাছে চিঠি লিখে সৌন্দর্যবৃদ্ধির কার্যকরী উপায় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। সেটা কয়েক সপ্তাহ আগের কথা, তারপর সে তার প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছিল। গ্ল্যাডির মুখ মলিন, চোখ নিষ্প্রভ আর চেহারায় সবসময় অতৃপ্তির আভা। বড় রাস্তার দোকান থেকে রেশমি সুতা কিনতে যাওয়ার জন্য সে পোশাক পরে তৈরি হচ্ছিল। জনির আনা পত্রিকার দুটো পাতা সে পিন দিয়ে তার স্কার্টের নিচে লাগাল। যখন সে হাঁটছিল তখন খসখস শব্দটি ঠিক আসল বস্তুটির মতোই মনে হচ্ছিল। রাস্তায় বের হতেই নিচতলার কটা চেহারার মেয়েটির সঙ্গে দেখা হতেই সে কথা বলার জন্য থামল। কটা চেহারার মেয়েটির চেহারা সবুজ হয়ে গেল। প্রতি গজ ৫ ডলার দামের কাপড়েই কেবল এ ধরনের শব্দ হয়, যা সে গ্ল্যাডির হাঁটার সময় শুনছিল। হিংসায় জ্বলতে জ্বলতে ঠোঁট কামড়ে আক্রোশপূর্ণ কিছু মন্তব্য করে মেয়েটি চলে গেল। গ্ল্যাডি বড় রাস্তার দিকে চলল। খুশিতে তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে চকচক করছে। গালে গোলাপী আভা দেখা দিয়েছে। ঠোঁটে বিজয়ীর, দুর্বোধ্য এবং সতেজ প্রাণোচ্ছল মৃদু হাসি তার চেহারা বদলে দিয়েছে। সে এখন একজন সুন্দরী। রূপচর্চা পাতার সম্পাদক তাকে এখন দেখতে পেলে হতো! আমার বিশ^াস সাধারণ চেহারাকে আকর্ষণীয় করার উদ্দেশ্যে অন্যদের প্রতি দয়াসূলভ অনুভূতি দেখাবার বিষয়ে পত্রিকায় তার উত্তরে কিছু একটা ছিল। যে শ্রমিক নেতার বিরুদ্ধে পত্রিকাটিতে ভাবগম্ভীর গুরুভার সম্পাদকীয় নির্দেশ জারি করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন গ্ল্যাডি ও জনির বাবা। তিনি পত্রিকাটির অবশিষ্টাংশটি তুলে নিলেন, যেখান থেকে গ্ল্যাডি সিল্কের মতো সৌন্দর্যবর্ধক নরম ও মসৃণ শব্দ ছিনিয়ে নিয়েছিল। সম্পাদকীয়টি তার নজরে পড়েনি, তার বদলে তার চোখ পড়ল উদ্ভাবনক্ষম মুগ্ধকর একটি বুদ্ধির খেলা বা ধাঁধার দিকে, যা একজন নির্বোধ থেকে শুরু করে জ্ঞানী পর্যন্ত সবাইকে বিমুগ্ধ করে। শ্রমিক নেতাটি পত্রিকার অর্ধেক পাতা ছিঁড়ে নিলেন, তারপর পেনসিল আর কাগজ নিয়ে একটি টেবিলে বসে ধাঁধার সমস্যা সমাধানে আঠার মতো লেগে রইলেন। নির্ধারিত স্থানে তার জন্য তিন ঘণ্টা ব্যর্থ অপেক্ষার পর অন্যান্য রক্ষণশীল নেতারা সালিশ-নিষ্পত্তির সপক্ষে তাদের রায় ঘোষণা করলেন। এর ফলে বিপজ্জনক হরতালটি এড়ানো গেল। পরবর্তী সংস্করণে শ্রমিক নেতার উদ্দেশ্যমূলক অভিসন্ধির বিরুদ্ধে জোরালো ভাষায় পত্রিকাটির সফল অভিযুক্তকরণের কথা লাল কালিতে উল্লেখ করা হয়। কর্মপরায়ণ পত্রিকাটির অন্যান্য পাতাগুলোও আনুগত্যের সঙ্গে এর শক্তি প্রমাণ করে চলল। স্কুল থেকে ফেরার পর জনি একটি নির্জন জায়গায় গিয়ে তার পোশাকের ভেতর থেকে পত্রিকার বাদবাকি কলামগুলো সরালো। কঠোর শাস্তি দেবার সময় শিক্ষকেরা সাধারণত শরীরের যেসব জায়গায় আক্রমণ করে থাকেন, সেসব জায়গায় এই পাতাগুলো সে এমন দক্ষতার সঙ্গে সাজিয়েছিল, যাতে সেই স্থানগুলো রক্ষা করা যায়। জনি একটি প্রাইভেট স্কুলে পড়ত এবং শিক্ষকদের সঙ্গে তার সমস্যা ছিল। যে রকম বলা হয়েছিল, আজ সকালের পত্রিকায় কঠিন শাস্তির বিরুদ্ধে একটি চমৎকার সম্পাদকীয় ছিল এবং নিঃসন্দেহে এটি কার্যকর হয়েছে। এর পরও কি কেউ সংবাদপত্রের ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতে পারেন?
×