ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আরিফুর সবুজ

‘ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল’ থেকে

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ১৬ অক্টোবর ২০১৫

‘ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল’ থেকে

সবে আমাদের বিয়ে হয়েছে। হাতে হাত রেখে সময়টা বেশ কেটে যাচ্ছে । এমনকি আমরা যখন দোকানেও যেতাম, তখনও হাতে হাত ধরা থাকত। আমি সব সময়ই তাকে বলতাম ‘ভালোবাসি’। কিন্তু কতটা ভালোবাসি তা আমি বলতে পারতাম না। এ নিয়ে আমার কোন ধারণাও ছিল না। ভালোবাসা তো পরিমাপ করা যায় না। তাই কতটা ভালোবাসি তা বলতে পারতাম না। তবে বুঝতাম এর চেয়ে বেশি হয়তো ভালবাসা যায় না। আমরা থাকতাম ফায়ার স্টেশনের কাছাকাছি এক ডরমেটরিতে। ‘ও’ কাজ করত ওই ফায়ার স্টেশনে। আমাদের সঙ্গে থাকতেন আরও তিন দম্পতি। আমরা সবাই একই রান্নাঘর ব্যবহার করতাম। ডরমেটরিতে রাখা হত একটা ঠেলাগাড়ি। লাল ঠেলাগাড়ি। এটা নিয়েই ছিল তাদের কাজ। ‘ও’ ছিল আমার হৃদয়ের মণিকোঠা, পুরো হৃদয়জুড়ে সবসময়ই টের পেতাম তার উপস্থিতি। আমি সব সময়ই খোঁজ নিতাম ও কী করছে, কোথায় আছে কিংবা কেমন আছে। একদিন রাতে হঠাৎ বেশ শোরগোল শুনতে পারলাম। কৌতুহল নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই তাকে দেখলাম। আমাকে দেখেই ‘ও’ বলে উঠল, লক্ষ্মীটি জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে ঘুমাতে যাও। চুল্লিতে আগুন লেগেছে। আমি খুব দ্রুতই ফিরে আসছি। আমি নিজে তখনও বিস্ফোরণটি দেখিনি। কেবল দেখেছি অগ্নিশিখা। সবকিছুই যেন জ্বলছিল। পুরো আকাশ যেন জ্বলে উঠেছিল সেরাতে। ধোঁয়া কু-লী পাকিয়ে লম্বা লেজ তৈরি করছিল। ভয়ানক গরম লাগতে শুরু করল। আমি ভয় পেয়ে যাই। কারণ ভ্যাসিলো তখনও ফিরে আসেনি। জ্বলন্ত বিটুমিন থেকে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছিল চারিদিকে। ওরা সবাই আগুন নিয়ন্ত্রণের প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিল। জ্বলন্ত গ্রাফাইটকে লাথি দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিল জীবনের পরোয়া না করে। তারা ক্যানভাস গিয়ার না পরেই যে শার্ট পরা ছিল তা পরেই বেরিয়ে পড়েছিল। তাদেরকে এ বিষয়ে কেউ কিছু বলেনি, কোন সর্তকও করেনি। তাদের কেবল বলা হয়েছিল ‘আগুন’। ব্যস, তারা ছুটে বেরিয়ে যায় পরনের শার্ট পরেই। সকাল সাতটার দিকে আমাকে বলা হলো তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দিশাহারা হয়ে আমি দৌড়ে ছুটে গেলাম সেখানে। কিন্তু পুলিশ হাসপাতালের চৌহদ্দি ততক্ষণে ঘিরে ফেলেছে। এ্যাম্বুলেন্স ছাড়া আর কাউকেই তারা ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না। তারা শুধু চেঁচিয়ে বার বার সর্তক করছিল, এ্যাম্বুলেন্সগুলো তেজস্ক্রিয়। আপনারা এখান থেকে সরে যান। আমি সে সময় আমার এক ডাক্তার বন্ধুকে খুঁজতে লাগলাম। বন্ধুটি ওই হাসপাতালেরই ডাক্তার ছিল। দিশেহারা হয়ে যখন তাকে খুঁজছি, তখন হঠাৎ দেখলাম সে একটা এ্যাম্বুলেন্স থেকে নামছে। আমি দৌঁড়ে তার কাছে গিয়ে তার সাদা কোর্টের কোনা আঁকড়ে ধরলাম। ‘আমাকে ভেতরে যেতে দাও’। ‘না, আমি তোমাকে যেতে দিতে পারি না। ওর অবস্থা ভালো নয়।’ কেবল একবার, একনজর তাকে দেখার জন্য বন্ধুটিকে খুব পীড়াপীড়ি করেছিলাম। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে বলল, ঠিক আছে, আমার সঙ্গে আস। তবে মাত্র পনেরো থেকে বিশ মিনিটের জন্য। আমি ‘ও’কে দেখলাম। ‘ও’র দেহ ফুলে গেছে। হাঁপাচ্ছে সে। চোখ দুটি যেন দেখাই যাচ্ছিল না। আমার বন্ধুটি আমাকে বলল, তাকে দুধ খাওয়াতে হবে। অনেক দুধ খাওয়াতে হবে। এখানে যারা আছে তাদের প্রত্যেককে কমপক্ষে তিন লিটার করে দুধ খাওয়াতে হবে। ‘কিন্তু ও তো দুধ পছন্দ করে না।’ ‘ না খেতে চাইলেও, যেভাবেই হোক অবশ্যই এখনই দুধ খাওয়াতে হবে।’ ওই হাসপাতালের ডাক্তার এবং নার্স বিশেষ করে আর্দালিরা যারা এদের সেবাযতœ করছিল, তারা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এবং একটা সময় মারাও গিয়েছিল। কিন্তু তখনও আমরা এসব কাহিনী জানি না। দশটার দিকে ক্যামেরাম্যান শিসোনেক মারা গেল। মৃত্যুর মিছিলে সেই ছিল প্রথম। আমি আমার স্বামীকে বললাম, আমি কী করব? সে চিৎকার করে আমাকে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিল। ‘তোমার পেটে আমাদের বাচ্চা, তুমি চলে যাও। এখান থেকে চলে যাও লক্ষীটি।’ আমি সে সময়টায় প্রেগন্যান্ট ছিলাম। কিন্তু কিভাবে তাকে ছেড়ে আমি সে সময় চলে যাই? কিন্তু সে বার বার বলছিল, এখান থেকে ভাগ আর আমাদের বাচ্চাটিকে বাঁচাও। আমি ‘ও’কে বলেছিলাম প্রথমে আমাকে দুধ সংগ্রহ করতে হবে। তারপর দেখা যাক, আমি কী করি। এমন সময় আমার বন্ধু তানয়া কিভেনক দ্রুত দৌড়ে রুমে ঢুকল । রুমটিতে ওর স্বামীকেও রাখা হয়েছিল। সঙ্গে ওর বাবাও এসেছিল। তার একটি গাড়ি ছিল। আমরা দ্রুত গাড়িতে চড়ে কাছাকাছি একটি গ্রামে গেলাম। তিন লিটারের বোতলের দুই বোতলে মোট ছয় লিটার দুধ কিনেছিলাম আমরা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তারা দুধ খেতে পারছিল না। বমি করে উগরে দিয়েছিল সব দুধ । ডাক্তাররা বলছিল তারা গ্যাসে আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু কেউ তেজস্ক্রিয়তার কথা তখনও বলেনি। আমি ওই দিন সন্ধ্যায় শত চেষ্টা করেও হাসপাতালে ঢুকতে পারিনি। জায়গাটা পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। সেই সমুদ্র ঠেলে আমি ভেতরে যেতে পারিনি। আমি ওর জানালা বরাবর পাশে ঠায় দাঁড়িয়েছিলাম। ‘ও’ জানালার কাছে এসে চিৎকার করে আমাকে কিছু বলছিল। কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু বুঝছিলাম ও খুব কাতরভাবে কিছু একটা বলছে। ভিড়ের মধ্যে কে যেন বলে উঠল ওদের ওই রাতে মস্কো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খবরটা চাউর হয়ে গেলে সকল বউ মিলে আমাদের একটা গ্রুপ হয়ে গেল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরাও যাব ওদের সঙ্গে । ‘আমাদের স্বামীদের সঙ্গে আমাদের যেতে দাও। তোমাদের এ বিষয়ে আমাদের আটকে রাখার কোন অধিকার নেই।’ এরকম নানা বুলিতে আমরা সৈনিকদের সঙ্গে চিৎকার জুড়ে দিয়েছিলাম। এমনকি তাদের দিকে ঘুষিও ছুড়েছিলাম। সৈনিকরা আমাদের পেছনে ঠেলে দিচ্ছিল। ফলে ব্যাপারটা অনেকটা ধস্তাধস্তির পর্যায়ে দাঁড়ালো। তারপর ডাক্তার এসে আমাদের সবাইকে থামিলে বলল, তারা মস্কো যাচ্ছে। এখন প্রয়োজন সঙ্গে করে তাদের কাপড়চোপড় নিয়ে যাওয়া। যে পোশাক পরে তারা স্টেশনে গিয়েছিল, সেগুলো পুড়ে গেছে। এ শুনে আমরা সবাই কাপড় চোপড় আনতে ছুটলাম। ইতোমধ্যে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিরুপায় হয়ে আমরা শহরের ভেতর দিয়ে দৌড়ানো শুরু করলাম। ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে যখন হাসপাতালে ফিরে এলাম, দেখলাম বিমান ইতোমধ্যে ছেড়ে গেছে। আসলে ওরা আমাদের সঙ্গে মিথ্যা বলেছিল। এটা ছিল আমাদের হাসপাতালের সামনে থেকে তাড়ানোর এক কৌশল। আমাদের তখন চিৎকার করে কান্নাকাটি করা ছাড়া আর করার কিছুই ছিল না। পরেরদিন আমি মস্কো যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। যদিও আমি ছিলাম ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট । তারপরেও এটা আমার কাছে তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার মস্কো যাওয়া। যেভাবেই হোক আমাকে মস্কো যেতে হবে। ওর জন্য আমাকে সেখানে যেতেই হবে। মস্কোতে গিয়ে আমরা প্রথম যে পুলিশ অফিসারটিকে দেখলাম, তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘চেরনোবিলের দমকলবাহিনীকে কোথায় রাখা হয়েছে?’ তিনি আমাদের যা বলেছিলেন তা বিস্ময়কর, ‘প্রত্যেকেই আমাদের এমন ভীতভাবে এটা জিজ্ঞাসা করছে যেন এটা খুবই গোপনীয় ব্যাপার। যাই হোক, হাসপাতালের নম্বর ৬। এটা শুচুকিন্সকা স্টপেজে।’ এটি ছিল তেজস্ক্রিয়তার জন্য একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং পাস ছাড়া কেউ এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। এতটাই কড়াকড়ি। নিরুপায় হয়ে গেটে যে মহিলা পাহারা দিচ্ছিল তার হাতে কিছু অর্থ গুঁজে দিলাম। সে অর্থগুলো পকেটে পুরে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিল। আর সামনে যাওয়ার পথ বাতলে দিল। হাঁটতে হাঁটতে মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করে করে প্রধান তেজক্রিয়বিদ এ্যাঞ্জেলিনা ভ্যাসিলেভনা গুস্কোভার অফিসে গিয়ে অবশেষে পৌঁছলাম আমি। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন- তোমার কি কোন ছেলেমেয়ে আছে? এ প্রশ্নের জবাবে আমার কী বলা উচিত? আমি বেশ বুঝতে পারলাম, আমি যে প্রেগন্যান্ট, তা লুকানো উচিত। না হলে তারা আমাকে তাকে দেখতে দেবে না। ভাগ্য ভালো যে, আমি হালকা-পাতলা ছিলাম। ফলে আমাকে দেখে কেউ সহজে আন্দাজ করতে পারতো না যে, আমি প্রেগন্যান্ট। আমি বললাম, হ্যাঁ, আমার ছেলে মেয়ে আছে। কতজন? তার এ কথায় আমি দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। মনে হলো তাকে বলি দুটি সন্তান আছে। যদি বলি একটি সন্তান আছে, তাহলে হয়ত উনি আমাকে ভেতরে যেতে দেবেন না। তাই বুদ্ধি করেই বললাম, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে আছে আমাদের। ‘ও তাহলে তো তোমার আর কোন সন্তানের প্রয়োজন নেই। ঠিক আছে। শোন, তোমার স্বামীর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। সে ¯œায়বিক অস্থিরতায় ভুগছে। তার মাথার খুলি পুরোপুরি বিকল হয়ে গেছে। আমি দেখছি কী করা যায়। আর শোন, তুমি যদি কান্না শুরু করে দাও, তাহলে এখনই তোমাকে লাথি মেরে এখান থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করব। আর শোন, ওকে জড়িয়ে ধরবে না। চুমু দেবে না। এমনকি ওর কাছাকাছিও যাবে না। তোমাকে আমি আধা ঘণ্টা সময় দিলাম।’ কিন্তু আমি জানতাম, আমি যাচ্ছি না। যদি আমি যাই, তবে ‘ও’কে সঙ্গে নিয়েই যাব। এটা আমি মনে মনে নিজেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আমি ভেতরে ঢুকলাম। তারা বিছানায় বসে কার্ড খেলছিল আর হাসছিল। তারা আমাকে দেখে ‘ভাসা’ বলে ডেকে ওঠল। ‘ও’ ঘুরে আমাকে দেখল। ওকে দেখতে বেশ উদ্ভট লাগছিল। ৪৮ সাইজের একখান পায়জামা পরেছিল সে, যদিও তার সাইজ ছিল ৫২। শার্টের হাতা অনেক ছোট। আবার যে প্যান্ট পরেছিল, তাও অনেক ছোট। তবে এখন আর তার মুখ ফোলা দেখাচ্ছিল না। তারা ‘ও’কে তরলজাতীয় খাবার খেতে দিত। ও আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল। কিন্তু ডাক্তার সেই অনুমতি দিল না। ডাক্তার বললেন, ‘বসুন বসুন। এখানে কাউকে জড়িয়ে ধরা যাবে না।’ আমরা বিভিন্ন কৌতুক শুরু করলাম। হাসছিলাম সবাই। কেউ দেখে হয়তো ভাববে না, এটা একটা হাসপাতাল। এই রুমসহ অন্য রুমগুলোতে প্রিপায়াতের লোকদের আনা হয়েছিল। বিমানে করে তাদের ২৮ জনকে একসঙ্গে আনা হয়েছিল। আমি তাকে একান্তে পেতে চেয়েছিলাম। তা কেবল এক মিনিটের জন্য হলেও সই। রুমের বাকিরাও মনে হয় ব্যাপারটি বুঝতে পারছিল। তাই তারা প্রত্যেকেই কোন না কোন কাজের অজুহাত দেখিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এরপর আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম, চুমু খেলাম। এরপর ও দূরে সরে গেল। ‘আমার কাছাকাছি বসো না। একটা চেয়ার নাও।’ ‘এটা পাগলামো।’ আমি বলেছিলাম। এরপর আমাকে ডরমেটরিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডরমেটরিতে প্রথম দিনে তারা প্রথমেই আমার শরীরের তেজস্ক্রিয়তা পরিমাপ করল। আমার পোশাক, ব্যাগ, পার্স, জুতোÑ সবই গরম ছিল। এ সবকিছু আমার থেকে নিয়ে তারা দূরে সরিয়ে রাখল। এমনকি আমার অন্তর্বাস পর্যন্ত। নতুন একটা পোশাক তারা আমাকে দিয়েছিল। আমার কাছে কেবল তারা রেখে গিয়েছিল আমার ব্যাগের ভেতরে থাকা অর্থ। পরদিন যখন আমি হাসপাতালে এলাম, দেখলাম ওরা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ রুমে শুয়ে আছে। তাদেরকে হলরুমে যেতে বারণ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি একে অপরের সঙ্গে যেন কথাবার্তা না বলে, সেই নিষেধও করা হয়েছে। ডাক্তার বলছিল, প্রত্যেকের শরীরেই তেজস্ক্রিয়তার কারণে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। তারা যে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়েছিল কিংবা ধরেছিল, সেটারও তেজস্ক্রিয়তা মাপা হয়েছিল। ডান, বাম, উপর, নিচ সর্বত্রই তেজস্ক্রিয়তা। ওই জায়গার কেউই যেন তেজস্ক্রিয়তা থেকে মুক্ত ছিল না। ওর মধ্যে পরিবর্তন আসা শুরু করে। প্রতিদিনই আমি যেন ওকে নতুন ব্যক্তি হিসেবে খুঁজে পাচ্ছিলাম। পুড়ে যাওয়া স্থানগুলো ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। তার মুখ, জিহ্বা, চিবুকে প্রথমে অল্প পোড়া দেখা গিয়েছিল যা ক্রমশ বড় হতে থাকে। আস্তে আস্তে তার মুখের, তার শরীরের রং পরিবর্তন হতে থাকে। শরীর নীল, লাল, ধূসর, বাদামী রূপ ধারণ করে। এসবই আমার চোখের সামনে। এ বলা অসম্ভব। লেখাও অসম্ভব। কিন্তু পরিবর্তন এত দ্রুতই হচ্ছিল যে, অন্য কোনকিছু ভাবার মতো সময় আমার ছিল না। এমনকি কান্না করার সময়টা পর্যন্ত আমার হাতে ছিল না। চৌদ্দটা দিন পার হয়ে গেল। আর চোখের সামনে একেক দিন একেকজন করে মারা যেতে লাগল। ওই দিনটি ছিল ৯ মে। সেদিন ও আমাকে বলেছিল, তোমার কোন ধারণাই নেই মস্কো যে কত্ত সুন্দর। বিশেষ করে ভি-ডেতে যখন আগুন জ্বালানো হয় তখন অনেক সুন্দর লাগে। সেই অগ্নিশিখা দেখতে সে বায়না ধরেছিল। আমি তার পাশে বসেছিলাম। সে চোখ খুলে বলেছিল, এটা দিন না রাত। এখন রাত নয়টা। জানালাটা খোল। তারা আগুন জ্বালিয়েছে। আমি জানালাটা খুললাম। আমরা ছিলাম আটতলায়। পুরো শহর আমাদের চোখের সামনে ধরা দিল। অপরুপ সাজে সেজেছে পুরো মস্কো শহর। অগ্নিশিখা আকাশে ধোঁয়া ছড়াচ্ছিল। আমি তাকে সেদিকে তাকাতে বলেছিলাম। ও বলল, আমি তোমাকে মস্কো দেখাতে চেয়েছিলাম। এই হলো সেই সুন্দর মস্কো শহর। আমি তোমাকে বলেছিলাম প্রতি হলিডেতে তোমাকে ফুল দেব। এ বলে সে বালিশের নিচ থেকে ফুলের তোড়া বের করে আমাকে দিয়েছিল। নার্সকে টাকা দিয়ে ও ফুল আনিয়েছিল। আবেগাপ্লুত হয়ে আমি ওর কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। চুমোয় চুমোয় ভরে দিয়েছিলাম ওর মুখ। আমার ভালোবাসা। আমার একমাত্র ভালোবাসা। ও মোচড় দিয়ে উঠে বলল, ডাক্তার কী বলেছে মনে নেই? কোন জড়াজড়ি, কোন চুমো নয়। দিনকে দিন তার পরিস্থিতি এতই খারাপ হয়ে উঠছিল যে, আমি তাকে এক সেকেন্ডের জন্যও রেখে কোথাও যেতে পারতাম না। একটু আড়াল হলেই ও পাগল হয়ে উঠত আমার জন্য। ‘ও’ দিনে পঁচিশ থেকে ত্রিশবার পায়খানা করতে থাকে। এর সঙ্গে রক্ত ও আম ঝরতে থাকে। ওর হাত-পায়ের ত্বকে ফাটল দেখা দেয়। যখন সে তার মাথা ঘোরাতো তখন বালিশে লেগে থাকত একগোছা চুল। আমি তাকে হাসানোর জন্য কৌতুক করে বলতাম, ভালোই হয়েছে। এখন আর তোমার মাথা আঁচড়াতে চিরুনির ঝামেলা পোহাতে হবে না। দ্রুত হাসপাতালের লোকজন তার সব চুল কেটে দিতে চাইল। আমি নিজেই তা করলাম। ওর প্রতিটি কাজ আমি নিজে করতে চাইতাম। আমি চাইতাম ওর সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টার প্রতিটি মুহূর্ত থাকি। একদিন একজন বলল, ও তো আর আপনার স্বামী নয়। আপনার ভালোবাসার মানুষ যে, এ সে নয়। এ বিষাক্ত তেজস্ক্রিয় এক পদার্থ। আপনি এর পাশে থেকে নিজেকে নিজে শেষ করে দিচ্ছেন। কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসি। তাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। হোক সে বিষাক্ত, তবু তার পাশেই থাকব আমি। ও যখন ঘুমাতো তখন আমি ওর কানে কানে বলতাম, ভালোবাসি, ভালোবাসি। যখন ওর পায়খানার ট্রে হাতে বাইরে যেতাম, তখনও আওড়াতাম, ভালোবাসি, ভালোবাসি। কেবল তোমায় ভালোবাসি। একদিন রাতে যখন সারা শহর নীরব নিস্তব্ধ, তখন ও আমাকে চুপি চুপি বলেছিল, আমি আমার সন্তানকে দেখতে চাই। আমাদের সন্তানের কী নাম রাখবে? আমি বলেছিলাম, তুমি যা রাখ, সেটাই। ও বলেছিল, যদি ছেলে হয় তবে ভাসয়া আর মেয়ে হলে নাতাশা। আমার মনে হচ্ছিল আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। আমার বুকের কোন স্পন্দনই যেন আমি শুনতে পারছিলাম না। আমি বুঝতে পারছিলাম ও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আমি মনে করতে পারছি সে রাতটির কথা, যেদিন আমি তার পাশের চেয়ারেই বসেছিলাম। তখন রাত আটটা। আমি তাকে বললাম, একটুখানি বাইরে থেকে হেঁটে আসছি। ও চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়েছিল। আর যেতে সায় জানিয়েছিল। আমি হোটেল রুমে গিয়ে সবে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। পরিচ্ছন্নকর্মী মহিলাটি জোরে জোরে আমার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল। হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুললে সে আমাকে দ্রুত হাসপাতালে যেতে বলেছিল। আমাকে দেখার জন্য ও পাগল হয়ে উঠেছে। আমি দ্রুত সেখানে যাওয়ার পথে নার্সকে পেয়ে ওর কথা জিজ্ঞাসা করতেই সে জানাল, ও আর নেই। আমার ভালোবাসার মানুষটি আরও পনেরো মিনিট আগেই চলে গেছে আমাকে ছেড়ে । হাচড়ে পাচড়ে কোনমতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে দেখলাম, নিথর দেহটি সেই বায়োচেম্বারে পড়ে আছে। আমি বাকহারা কিংবা বলা চলে মূঢ় হয়ে রইলাম। যখন ভ্যাসিলো মারা গেল তখন তাকে সমাধিস্থল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পুরোটা রাস্তায় আমি তার সঙ্গে সঙ্গে ছিলাম নিবার্ক হয়ে। মর্গে তাকে আনুষ্ঠানিক একটি পোশাক পরিয়ে দেয়া হলো। তার আনুষ্ঠানিক পোশাকটিও কাটতে হয়েছিল। কারণ তারা ঠিকভাবে পরাতে পারছিল না। মৃত্যুর আগের দু’দিন তার লাংগস, লিভারসহ অনেক নাড়িভুঁড়ি মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। এসব আমি নিজ হাতে পরিষ্কার করেছিলাম। সে বর্ণনা দেয়া কিংবা লেখা আমার পক্ষে অসম্ভব। যাই হোক, পোশাক পরিয়ে তার সঙ্গে দেয়া হলো সার্ভিস ক্যাপ। তারা তাকে জুতো পরাতে পারেনি। কারণ, তার পা ফুলে গিয়েছিল। খালি পায়েই তারা ভ্যাসিলোকে সমাহিত করল- আমার ভালোবাসাকে মাটির নিচে পাঠিয়ে দিল। ওটা কবর ছিল না। ওটা যেন ছিল এক প্লাস্টিকের ব্যাগ। কেবলি ব্যাগ। ওর বাবা-মা, আমার বাবা-মা সবাই এসেছিল। তারা মস্কো থেকে কালো রুমাল কিনেছিল। ইমার্জেন্সি কমিশন আমাদের সঙ্গে দেখা করেছিল। তারা আমাদের সবাইকে একই কথা বলেছিল, আপনাদের স্বামী, আপনাদের সন্তানদের মৃতদেহ আপনাদের কাছে হস্তান্তর করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তারা প্রত্যেকেই তেজস্ক্রিয় এবং তাদের মস্কো সমাধিতে বিশেষভাবে সমাহিত করা হবে। আপনারা কাগজপত্রে সই দিয়ে দিন। কেউ কেউ কফিন বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে তারা বলেছিল, এঁরা বীর, এঁরা দেশের বীর। এঁদের ওপর তাদের পরিবারের চেয়ে রাষ্ট্রের অধিকার বেশি। তারা আমাদের প্লেনের টিকেট ধরিয়ে দিল। পরদিন বাড়ি পৌঁছেই ঘুমাতে চলে গিয়েছিলাম। শরীরকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। টানা তিন দিন বেহুঁশের মতো ঘুমিয়েছিলাম। এ্যাম্বুলেন্স এসেছিল। ডাক্তার দেখে বলেছিল, না, এর কিছুই হয়নি, এ শুধু ভয়ঙ্কর এক ঘুমের মাঝে আছে। আসলে আমি ছিলাম শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত সদ্যবিধবা এক নারী। সেই সময় আমার বয়স ছিল তেইশ বছর। দুই মাস পর আমি আবার মস্কো গেলাম। রেলস্টেশন থেকে সোজা চলে গেলাম সমাধিতে । সমাধিতেই আমি আমার তলদেশে প্রচ- ব্যথা অনুভব করা শুরু করলাম। আমাকে এ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি বাচ্চা প্রসব করলাম। মেয়ে হয়েছিল আমার। নাতাশাঙ্কা বলে আমি তাকে ডাকলাম। ‘তোমার বাপজান তোমার নাম রেখেছে নাতাশাঙ্কা’ বলে বাচ্চাটিকে আদর করলাম। বাচ্চাটি দেখতে স্বাস্থ্যবান হয়েছে। তার হাত, পা সবকিছুই স্বাস্থ্যবান। কিন্তু তার লিভারে সমস্যা দেখা দিল। তার লিভার থেকে শুরু করে হৃদপিন্ড বিকল হওয়া শুরু করল। জন্মের চার ঘণ্টার মাথায় ডাক্তার আমাকে জানাল, বাচ্চাটি মৃত। আমি বাকহারা হয়ে গেলাম। তারা আমার বাচ্চাটিকে আমার কাছে দিতে চাচ্ছিল না। তোমরা কেন আমাকে আমার বাচ্চাটিকে দিচ্ছ না? এটা আমার বাচ্চা, আমি ওকে কাউকে দেব না। (দীর্ঘ নীরবতার পর) কিয়েভে তারা আমাকে একটি এ্যাপার্টমেন্ট দিয়েছে। এটি ছিল বেশ বড় বিল্ডিং যেখানে পারমাণবিক কেন্দ্রের সবাইকে নিয়ে আসা হয়েছে। দুই রুমের বিশাল এ্যাপার্টমেন্ট, যে রকম এ্যাপাটমেন্টের স্বপ্ন আমি আর ভাসা সব সময় দেখতাম। (তিনি দাঁড়ালেন এবং জানালার দিকে গেলেন)। আমার মতো অনেকেই এখানে থাকে। পুরো এলাকায় সবাই আমার মতো। এ এলাকাকে বলা হয় চেরনোবিলস্কা। এ এলাকার লোকজন তাদের পুরো জীবনটাই পারমাণবিক স্টেশনের পেছনে ব্যয় করছেন। তাদের অনেকেই এখনও প্রভেনশিয়াল ভিত্তিতে কাজ করছেন। ওখানে কোন প্রাণ নেই। জনমানবশূন্য এক এলাকা যেন। যারা এখানে আছেন, তাদের সবাই কোন না কোন খারাপ রোগে আক্রান্ত। বাতিলের খাতায় নাম লিখিয়েছেন তারা। তবু তারা তাদের কাজ ত্যাগ করে যাননি। তাদের কাউকেই আর এখন প্রয়োজন নেই। তারা যে কোন মুহূর্তে মারা যেতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই তারা মারা যেতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে কারও কোন আগ্রহ নেই। আমরা কী দেখেছি, কিসের মধ্যে দিয়ে কেটেছে আমাদের জীবন, তা কেউ শুনতে চায় না। কে-ইবা মৃত্যুর খবর শুনতে চায়। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি ভালোবাসা সম্পর্কে। আমার ভালোবাসা...
×